মাইথনে একদিন
মীর হাকিমুল আলি
আমাদের টিচার ট্রেনিং কলেজ থেকে একবার মাইথন ঘুরতে যাওয়া ঠিক হলো l এতো কাছে ঘুরতে যেতে আমরা কেউ রাজি হচ্ছিলাম না l সবাই দার্জিলিং বা সিকিম এর দাবি ধরে চিৎকার ফেলে দিলাম l আমাদের উত্তম বাবু বললেন হবে না l ‘সে অনেক খরচ l কম খরচে হাতের কাছেই আছে পাহাড় জলের মিলন l ভালো না লাগলে আমাকে বলবে যে স্যার একটা বাজে জায়গায় নিয়ে এসেছে l তাছাড়া একসাথে ঘোরাটাই আসল l জায়গা এতটা ফ্যাক্টর নয় ‘l আমরা শেষে রাজি হলাম l
নির্ধারিত দিনে পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলদা থেকে রিজার্ভ দুটি বাস আমাদের নিয়ে ছুটে চললো রাতে l প্রথমে NH 60 ধরে তারপর NH 6 ধরে বাস ছুটতে লাগলো l রাতে বাইরে কিছু দেখা গেলোনা l অন্ধকারে রাস্তার দুপাশের সৌন্দর্য্য কিছু দেখা যায়না l এদিকে বাসের মধ্যে রীতি মতো উধুম নাচ গান শুরু হয়েছে lএই প্রসঙ্গে বলে রাখি আমাদের কলেজটা শুধু ছেলেদের জন্য l না ঘুমিয়েই আনন্দ করতে করতে ঘন্টা 3/4 ঘন্টা গেলাম l তারপর আস্তে আস্তে সবাই নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে গেলাম l যখন ঘুম ভাঙলো তখন সকালে হয়ে গেছে আমরা প্রায় এসে গেছি মাইথন l
পৌঁছে সবাই ব্রাশ করতে করতে ড্যামের দিকে গেলাম l চারদিকে ছোট ছোট সবুজ গাছে ভরা পাহাড় l আর বিশাল জলাশয় l তার মাঝে মাঝে আবার ছোট ঢিবির মতো পাহাড় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে l মনে হচ্ছে ব্যাঙ গুলো মাথা তুলে আছে l নাহ যতটা খারাপ ভেবেছিলাম ঠিক ততটাই ভালো লেগে গেল জায়গাটা l স্বচ্ছ জলের প্রেমে পড়ে গেলাম l গিয়ে মুখ ধুলাম l জল খুব ঠান্ডা l সকালের টিফিন খেয়ে আমরা একটা দলে ভাগ হয়ে গেলাম l সবারই এরকম গ্ৰুপ থাকে কলেজে এটা জানা কথা l একদম সকালে মুখ ধুতে গিয়ে আমার এক মোবাইলের 2 মেগা পিক্সেল ক্যামেরা দিয়ে কয়েকটা ছবি তুলেছিলাম l এখন ঘুরতে বেরিয়ে প্রথমেই আমরা গেলাম ড্যাম ধার দিয়ে যে প্রধান রাস্তা চলে গেছে সেটা বরাবর l আমরা বিভিন্ন পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে বসে ছবি তুলছিলাম l এমন সময় একটা পুলিশ এসে একটা বন্ধুর পেছনে একটা সপাটে বেত্রাঘাত করলেন l আমরা তো রীতিমতো ভয় খেয়ে গেলাম l ব্যাপার টা কী হলো জানার ইচ্ছে প্রকাশ করার আগেই পুলিশ মামা বললেন ‘ ইধার ফোটোগ্রাফি মানা হ্যায় l সাইন বোর্ড দিখাই নেহি দে রাহা হ্যায় কিয়া??? ‘ আরও একজন পুলিশ বেরিয়ে এলো l আমরা তো হকচকিয়ে গেছি l বললাম সরি স্যার l পাতা নেহি থা l এই বলে বন্ধুদের নিয়ে সোজা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চললাম পুলিশের গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে l ভালো ভাবে বলতে পারতো l আচমকা কেউ মারে এভাবে !? যাইহোক ওপর থেকে ডান দিকে বিশাল জলরাশির সাগর মনে হচ্ছে আর বাম দিকে অসংখ্য জল বের করে দেওয়ার গেট l আর বরাকর নদী পাথর শিলা নিয়ে সামনের ঝোপের দিকে নেমে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে l জল নেই খুব একটা l সামনে একটা পার্ক এর মতো দেখা যাচ্ছে ওপর থেকে l সেখানে হরিণ দের ঘুরতে দেখা যাচ্ছিল l মোবাইল বার করে ভয়ে ভয়ে টুক করে দু তিনটা পিক তুলে নিলাম l না কেউ দেখেনি l চললাম এগিয়ে l ব্রীজ এর শেষে গিয়ে বন্ধুর মোবাইল নিয়ে ছবি তোলা শুরু করলাম l বাম দিকের নীচের দিকে নেমে গেলাম l নীচে আছে পার্ক আর খুব সুন্দর সাজানো গাছপালা, কংক্রিটের পশু পাখি দিয়ে সাজানো মনোরম জায়গা l ওদিক থেকে ড্যাম এর গেট গুলির দৃশ্য খুব পরিষ্কার দেখা যায় l বর্ষায় দেখার মতো নাকি সেই অপূর্ব দৃশ্য l ওখানে কিছুক্ষন কাটিয়ে আমরা আবার ফিরে গেলাম রাস্তায় l সেখান থেকে অটো করে একটা পাহাড়ের ওপরে মন্দির আছে সেখানে গেলাম l অনেক সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় l খুব কষ্টকর l যাইহোক গরম খুব লাগছিলো নেমে এলাম তাড়াতড়ি l দুপুর হয়ে গেল l স্নান করতে গেলাম ড্যামে l পাথর খুব পিচ্ছিল l সাবধানে পা দিতে হয় l এই গরমে শীতল জলে শরীর মন জুড়িয়ে নিয়ে এসে দুপুরের ভোজ ভাত, খাসি মাংস /মাছ, সবজি, আলু পোস্ত, ডাল, মিষ্টি, পাঁপড়, চাটনি ইত্যাদি সহযোগে সাঙ্গ করলাম lপ্রিয় দাদা ও স্যার দের পরিবেশন করে খাওয়ালাম l তারপর বসে বসে আড্ডা দিতে দিতে গল্প গুজব, মজা, খুঁনসুটি দিনটাকে অন্য মাত্রা দিল l আমি ভূগোলের ছাত্র তাই সব জায়গাতেই ভূগোল খুঁজে বেড়াই l তাই নেট খুলে মাইথন ড্যাম নিয়ে কিছু তথ্য পড়ছিলাম এক মনে l জানতে পারলাম কিছু জিনিস l আপনাদের সাথে সেগুলো সংক্ষেপে শেয়ার করি তবে শুনুন —
মাইথন পশ্চিমবঙ্গ আর ঝাড়খণ্ডের সীমানা বরাবর অবস্থিত একটু বহুমুখী নদী উপত্যকা পরিকল্পনা l এটি আসানসোল থেকে প্রায় 30কিমি l আর ধানবাদ থেকে 48কিমি l মাইথন কথার অর্থ ‘মা এর খান বা বাসভূমি l এখানেই রয়েছে ডি ভি সি এর সবচেয়ে বড়ো জলাধারটি l মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টেনেসি ভ্যালি প্রকল্পের থেকে অনুপ্রাণিত এই প্রকল্পটি করা হয়েছে, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও 60000 কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য l এটি বরাকর নদীর উপর নিৰ্মিত l
এখানে রয়েছে অনন্য ভূগর্ভস্থ পাওয়ার স্টেশন, এই ধরণের পাওয়ার স্টেশন দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম l জলাধারটি 65 বর্গ কিমি দীর্ঘ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত l এটা 15712 ফুট (4789মি ). দীর্ঘ ও 165 ফুট (50 মি ) উঁচু l
বাঁধ এর উদ্দেশ্য :
বন্যা নিয়ন্ত্রণ
সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন
শিল্প এবং গার্হস্থ্য ব্যবহারের জন্য জল সরবরাহ
ন্যাভিগেশন ও নিষ্কাশন
বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদন ও বিতরণ
পর্যটন ইত্যাদি l
1942 সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটি বন্যা সংঘটিত হয় দামোদর উপত্যকা অঞ্চলে যা কলকাতাকে বাকি দেশের থেকে প্রায় দশ সপ্তাহ বিচ্ছিন্ন করে রাখে l শীঘ্রই সরকার টেনেসি ভ্যালি অথরিটি এর একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার Mr. W. L. Voord কে ডাকেন এ ব্যাপারে সমাধান করার জন্য l তিনি 1945 সালের মধ্যেই বাঁধের পরিকল্পনা সম্পূর্ণ করেন l অবশেষে স্বাধীন ভারতে প্রথম বাঁধ (তিলাইয়া বাঁধ ) শুরু হয় 7জুলাই, 1953 তে l শীঘ্রই তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে কোনার, মাইথন এবং পাঞ্চেত শুরু হয় যথাক্রমে 1955, 1957, 1959 সালে l
পড়তে পড়তে সবাই হৈ হৈ করে উঠে বললো ‘চলো চলো সবুজ দ্বীপ যাবো ‘l সেটা আবার কোথায়??? সেটা ড্যামের মাঝে l যেমন কথা তেমন কাজ, বোটে করে সবাই ভেসে চললাম সবুজ দ্বীপ l জলের ওপর দিয়ে যেতে কী ভীষণ দারুন অনুভূতি হয় যারা যায় তারা জানে l হাত টা জলে ডুবিয়ে জল ছিটাতে ছিটাতে বন্ধুদের সাথে খুঁনসুটি কোন দিন ভোলার নয় l এই নৌকা বিহার ই ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয় আর আনন্দদায়ক lছোট দ্বীপ, সবুজদ্বীপ, চামচ দ্বীপ দেখলাম l ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা প্রায় হয় হয় l আর দেরি নয় আমাদের বাসে উঠে যেতে হবে কেননা ফিরতে হবে এতটা পথ l রাত থাকতে পারলে হয়তো আরও কিছু জায়গার সৌন্দর্য্য আস্বাদন করা যেত l কিন্তু এরকম পিকনিকে গিয়ে তা সম্ভব নয় l যাইহোক ফেরার পথে দূর থেকে কয়লা খনি, কয়েকটা কলকারখানা দেখলাম l স্মৃতি পটে থেকে গেল একদিনের মাইথন l 2016সালের সেই স্মৃতির পাতা থেকে আজ লেখলাম আপনাদের জন্য l কেমন হলো জানাতে ভুলবেন না l পাশে থাকুন পরের ভ্রমণ কাহিনীর জন্য l
**** যারা ট্রেনে মাইথন যেতে চান তাঁরা ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেস ধরবেন হাওড়া থেকে l নামবেন কুমারডুবি স্টেশন এ l ওখান থেকে 9/10 কিমি অটো তে মাইথন l
হোটেলে আছে অনেক l খুঁজে নেবেন l মজুমদার হোটেলে খুব ভালো শুনেছি l আমার অভিজ্ঞতা নেই l