নিজস্ব সংবাদদাতা: ভয়াবহ বন্দী সংঘর্ষে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল পশ্চিমবঙ্গের দমদম সংশোধনাগার। দিনভর ভাঙচুর, আগুন আর বোমাবাজি, ইটবৃষ্টির পর দিনের শেষে মৃত ৩ জেলবন্দী, আহত আরও ৫। আহত বহু কারারক্ষী থেকে জেল সুপার এবং খোদ কারামন্ত্রী। শনিবার রাজ্যের গোয়েন্দা ব্যর্থতাকে প্রকট করে একের পর এক বন্দী বিদ্রোহ ও আগুন লাগানো, বিস্ফোরণের আওয়াজ, গুলি,বোমা, ইট, পাথর নিয়ে পুলিস ও বন্দীদের যুদ্ধের পরিস্থিতি দেখল গোটা দেশ।
খাগড়াগড় কাণ্ডের আসামী থেকে মাওবাদী আসামী সহ কুখ্যাত অপরাধীদের ঠিকানা দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার। সেখানেও রাজ্য প্রশাসনের চরম উদাসীনতা। বারুইপুরের সংশোধনাগারের পরে দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে বন্দীদের বিক্ষোভে কয়েকঘন্টা ধরে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে গেল। শনিবারের গুরুতর আহত পাঁচজনকে আর জি কর হাসপাতাল ভর্তি করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে শুক্রবার থেকেই যেখানে বন্দীদের বিক্ষোভের আঁচ পাওয়া গেছিল সেখানে কারারক্ষী থেকে রাজ্য প্রশাসন উদাসীন থাকল কি করে যার পরিণতিতে ঘটে গেল এত বড় ঘটনা ! উল্লেখ্য দমদম সংশোধনাগারে বন্দী আছে খাগড়াগড় কাণ্ডের থেকে বহু মাওবাদী আসামী। সেখানে আরো বেশী নজরদারির থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল। অন্যদিকে আর জি কর হাসপাতালে দাঁড়িয়ে বন্দীদের পরিবারের পক্ষ থেকে পুলিসের বিরুদ্ধে মাথায় গুলি করার অভিযোগ করেছে। আর দমদম কেন্দ্রীয় সংশধনাগারে বিক্ষোভের খবর ছড়িয়ে পরার কিছু সময়ের মধ্যে প্রেসিডেন্সি জেলেও বন্দীরা বিক্ষোভ শুরু করে।
এদিনের ঘটনায় বন্দীরা যেভাবে ইট, পাথর ছুঁড়েছে, বোমা ছোঁড়ার আওয়াজ পাওয়া গেছে তাতে সংশোধনাগারের নজরদারি নিয়ে কারারক্ষী থেকে পুলিসের দুর্নীতির যে ছবি প্রকাশ্যে এলো তাতে পুলিস মন্ত্রীর আরো এক ব্যর্থতার উজ্জ্বল উদাহরণ। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের মধ্যে যাদের দশ বছর সাজা খাটা হয়ে গেছে তারা আবেদন করলে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত প্যারোলে মুক্তি পেতে পারে। এই সিদ্ধান্তের খবর সংশোধনাগারে এসে পৌঁছতেই অশান্তির শুরু। সূত্র মাধমে জানা গেছে শুত্রুবার থেকেই ক্ষোভ প্রকাশ শুরু হয়। দশ বছরের কিছু কম সময়ের আসামী থেকে বিচারাধীন আসামীরাও ক্ষোভ দেখিয়ে তাদেরও প্যারোলের দাবি জানাতে থাকে। অন্যদিকে কোর্ট বন্ধ হয় যাওয়ার কারণে কোনো বিচার হচ্ছে না, জামিনের আবেদনও করা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নেয় ৩১শে মার্চ পর্যন্ত বন্দীদের পরিজনদের সাথে দেখা করাও যাবে না। আর এতেই ক্ষেপে উঠে বন্দীরা। শুত্রুবারের পরে শনিবার সকাল সাড়ে দশটা এগারোটা থেকে বন্দীরা একই দাবিতে সোচ্চার হয়। প্রশাসনের কোনো ইতিবাচক ভূমিকা না থাকায় দুপুর একটা নাগাদ বন্দীরা বিক্ষোভ শুরু করে ও হিংসার পথ নেয়। মূল প্রবেশ পথের বাঁদিকের অংশে আগুন লাগিয়ে দেয়।জেলারের ঘর, ডায়েরি ঘর ব্যাপক ভাঙ্গচুর শুরু করে। তছনছ করতে থাকে বিভিন্ন অংশে। কারারক্ষীরা , দমদম থানার পুলিস আটকানোর চেষ্ঠা করলে তাদের উপর আক্রমণ হয়। পুলিস একাধিকবার পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপরে উত্তর ২৪পরগনা জেলার পুলিস সুপার মহেশ ভার্মার নেতৃত্বে ও বারাকপুর পুলিস কমিশনারেটের বিশাল পুলিস বাহিনী আসে। দমকলের প্রথমে তিনটে ও পরে আরো একটা ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে আসে। দমকল কর্মীরা আগুন নেভানোর চেষ্ঠা শুরু করে। কিন্তু একদিকে নেভায় তো অন্যদিকে জ্বলতে শুরু করে। বিশাল পুলিস বাহিনী আসলেও বন্দীরা পিছু হটেনি। তারা আরো হিংস্র আক্রমন শুরু করে। ইট, পাথর বৃষ্টির মতো পরতে থাকে। বোমার আওয়াজে আশেপাশের অঞ্চল কেঁপে উঠে। ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনা যায়।
গুলির শব্দও পাওয়া যায়। জেলের রান্নাঘরে থাকা গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ বলেই মনে করা হচ্ছে। পুলিস বাহিনী ভিতরে ঢুকতেই বারবার ব্যর্থ হয়। এমন কি দমকল মন্ত্রী সুজিত বসু ঘটনাস্থলে আসলে তাকে লক্ষ করেও ইট ছোঁড়া হয়। তাঁর পিঠে ইট লাগে। পুলিসও কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে থাকে, গুলি চালাতে শুরু করে। কয়েক রাউন্ড গুলি চালায়। তাতেও দমে না বন্দী বিক্ষোভকারীরা। রীতিমতো পুলিসকে দৌড়ে পালাতে দেখা যায়। রর্যাফ , কমান্ডো বাহিনী এসে পরিস্তিতি নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। প্রায় দুপুর একটা থেকে শুরু হলেও শেষ সাড়ে তিনটে নাগাদ বিস্ফোরণের আওয়াজ পাওয়া যায়। চারটের পরেও খেলার মাঠের পাশে আগুন লাগানো হয়। তিনটে থেকে কয়েকজন বন্দী হাত তুলে বেরিয়ে এসে পুলিসের কাছে আত্মসমর্পণ করতে থাকে। কিন্তু আক্রমণ একবারে থামে না। জেলারের অফিস, ডায়েরি ঘর, রান্নাঘর সহ জেলের মূল ফটকের ভিতরে একধিক জায়গা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এরই মধ্যে খবর আসতে থাকে অনেক বন্দী মই, দড়ি দিয়ে দেওয়াল টপকে পালানোর চেষ্ঠা করছে। সমগ্র জেল অঞ্চল বাইরে থেকে পুলিস ঘিরেতে শুরু করে। গোড়াবাজার, যশোর রোড সেন্ট্রাল জেল মোড় সর্বত্র চাঞ্চল্য ছড়ায়। মানুষও আতঙ্কিত হয়ে পরে। দুপক্ষের গুলি, বোমা, কাঁদানে গ্যাসে সংলগ্ন জনবহুল অঞ্চলে মানুষ সন্ত্রস্ত হয়ে পরে। তিনটের কিছু পরে থেকে পুলিস অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। আহতদের বের করে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা শুরু হয়।
এরই মধ্যে দেখা যায় একটা নিথর দেহ পরে আছে। দুটো আমবুলেন্সে করে একাধিক আহতকে নিয়ে যেতে দেখা যায়। পাঁচ জনকে নিয়ে যাওয়ার কথা জানতে পারে গেলেও সংখ্যাটা আরো বেশী হতেই পারে। এদের একজনের মাথায় ব্যান্ডেজ জড়ানো ছিল। তাকেই মাথায় গুলি করার অভিযোগ। আহতদের নিয়ে যাবার সময় কিছু আসামী হাতের আঙ্গুল দেখিয়ে কিছু বলার চেষ্ঠা করছিল। তারা আহত না মৃতর সংখ্যা বোঝাচ্ছিলো কিনা বোঝা যায়নি। কারাদপ্তর সূত্রে তিনজন বন্দীর মৃত্যুর খবর মিলেছে। পুলিস , কারারক্ষীরা আহত হলেও তাদের মৃত্যুর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। অন্ধকার না হওয়ায় অবধি উত্তেজনা ছিল।
উল্লেখ্য দমদম সংশোধনাগারে বর্তমানে সাড়ে চার হাজার আসামী আছে। তার মধ্যে ৬০০জন সাজা প্রাপ্ত।এদের মধ্যে ২২১ জনকে ছাড়া হবে বলে জানা গেছে। বাকি সব বিচারাধীন। তারাই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে খবর। জেল প্রশাসন ও পুলিসের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠেছে তাদের দুর্নীতি ও নজরদারির অভাবেই বন্দীদের কাছে ইট, পাথর, অস্ত্র পৌঁছেছে। আবার জেল প্রশাসন ও পুলিস রাজ্য সরকারকেই দুষছে। তাদের বক্তব্য প্যারোলে মুক্তির বিষয়টা গোপনে জানানো উচিত ছিল। ঘোষণা করায় ক্ষোভ জানানোর সুযোগ হয়েছে। ভয়ঙ্কর এই ঘটনার জন্য কে দায়ী জানার জন্য তদন্ত কমিশন হয়তো হবে। কিন্ত অন্য অনেক কমিশনের মতো এর রিপোর্ট প্রকাশ হবে বলে কেউই মনে করছে না। বন্দীদের পরিবার , পরিজনরা জেল চত্বর থেকে আর জি কর হাসপাতালে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছে পুলিসের দুর্নীতির কথা। টাকা দিলে জেলের ভিতরে সব পরিষেবা পাওয়া যায়। টাকা দিতে না পারলে চলে নির্যাতন। বিভিন্ন সূত্রে চেষ্ঠা করা হলেও কেউ মুখ খুলতে রাজি না। তবে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়ার সম্ভবনা রয়েছে।