নরেশ জানা: ১৭৭৫ সালে হেস্টিংস বীরকুলের মনোরম সমুদ্র সৈকতে গ্রীষ্মাবকাশ কাটানোর একটি বাংলো তৈরি করার পর স্ত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন,”কলকাতার কাছাকাছি একটা ব্রাইটন খুঁজে পেয়েছি। বলতে পারো, ব্রাইটন অফ ক্যালকাটা।” হেস্টিংসের অবসর বিনোদনের সেই বাংলোটি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার ১৪৮ বছর পরে ১৯২৩ সালে কলকাতার জুয়েলারি ও ঘড়ি তৈরির প্রসিদ্ধ হ্যামিলটন অ্যান্ড কোম্পানির মালিক জন ফ্র্যাঙ্ক স্নেইথ রামনগরের বালিসাইয়ের বাসিন্দা এক খদ্দেরের কাছ থেকে কাঁথি থেকে ২৪ মাইল দক্ষিনে অখ্যাত পরিচয়হীন সেই দুর্গম গ্রামে হাজির হন হাতির পিঠে চেপে। গ্রামের নাম তখনও বীরকুল। ঝাউ বনের জঙ্গল বেষ্টিত সৈকতের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে সমুদ্রপাড়ে ১১.৫ একর জমি লিজ পেয়ে সেখানেই রানসউইক হাউস তৈরি করেন তিনি।
এরপর দেশ স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গে বিধানচন্দ্র রায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর স্নেইথ প্রতিমাসে তাঁকে একটা চিঠি লিখে গেছেন বীরকুলকে একটি সৈকত নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। হয়ত সেই বারংবার পত্রাঘাতেই বিরক্ত হয়েই মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় কিছু টাকা বরাদ্দ করেন। ধীরে ধীরে তৈরি হয় সৈকতাবাস, জল সরবরাহ-সহ নানা ব্যবস্থা। ১৯৬২ সালে বিধানচন্দ্র রায়ের মায়ের নামে ‘অঘোরকামিনী’ স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি হয়। হাত গুটিয়ে ছিলেন না স্নেইথ সাহেবও। তিনি বছরের ছ’মাস এই সৈকত শহরে থাকতেন। বাকি সময় শিলঙে। সেখান থেকে তিনি বেহালা ফ্লাইং ক্লাব থেকে প্লেনে চেপে আসতেন দিঘায়। সৈকতে প্লেন ওঠানামা দেখতে ভিড় জমাতেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সেই সময় এলাকায় স্কুল স্থাপনের জন্য নাড়াজোলের রাজাকে দিঘায় বাড়ি তৈরি করতে সাহায্য করেন স্নেইথ সাহেব। এছাড়াও পযর্টকরা যাতে সরাসরি সড়ক পথে দিঘায় আসতে পারেন তার জন্য কলকাতা-দিঘা সড়ক তৈরির জন্য রাজ্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানান। এভাবেই বীরকুল থেকে দিঘা। ১৯৬৪ সালে মারা যান দিঘার প্রথম আবাসিক জন ফ্র্যাঙ্ক স্নেইথ সমুদ্র উপকূলবর্তী দুর্গম বীরকুল পরগনাকে আমূল বদলে বাঙালিকে দিয়ে গেলেন আজকের সৈকত সুন্দরী দিঘা।
যদিও বাঙালি তখনও দিঘাকে চেনেনি। এক আধ ডজন বাঙালি আ্যডভেঞ্চার আর আইআইটি খড়গপুরের ভূতত্ত্ব ও ভূপদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ও পড়ুয়ারা দিঘায় আসতেন গবেষনার কাজে। সাতের দশকে বাংলার রোমান্টিক সিনেমা আর পিন্টু ভট্টাচার্যর কন্ঠে ‘চলোনা দিঘার সৈকত ছেড়ে ঝাউ বনের ছায়ায়…..” গান শুনেই কার্যত দিঘায় হামলে পড়ল কলকাতা আর তারপর সবটাই সবার জানা।
দিঘা মানেই যে ঝাউবন সেই ঝাউয়ের হাজার হাজার লাশ এখন সৈকত জুড়ে।আমফান তান্ডবে লন্ডভন্ড উপকূলের ঝাউবন, উপড়ে-ভেঙে পড়েছে লক্ষাধিক ঝাউগাছ।সৈকতের কিনারে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে গগনমূখী ঝাউবন এখন মাটিতে শুয়ে। গত দু’দশকে ভাঙনের গ্রাসে হারিয়ে গিয়েছিল সৈকতের সারিসারি ঝাউবন। শহুরে দিঘার অবশিষ্ট বাকি ঝাউবনটুকু, তাও এবার হারিয়ে গেল, ঘূর্ণিঝড় আমফানের অভিঘাতে। ফিরে গিয়েও সুন্দরী দিঘার উপকূলজুড়ে শুধুই ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে আমফান।ঝড়ের তান্ডবে মাটিতে উপড়ে পড়েছে সারিসারি অগণিত ঝাউগাছ।পুরনো ঝাউবনের ক্ষতি হয়েছে সর্বাধিক।
শুধু কি দিঘা, পাশের মন্দারমণি, তাজপুর, শঙ্করপুর, খেজুরি, কাঁথি, জুনপুট, জলধা, নন্দীগ্রাম, হলদিয়ার দীর্ঘতম সবুজ বেষ্টনী পুরোপুরি লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে এই ঝড়ে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার উপকূল এলাকার কাঁথি, বাজকুল আর হলদিয়া রেঞ্জের ৪০০ হেক্টরেরও বেশি ঝাউবনে থাবা বসিয়েছে আমফান। ভেঙে-উপড়ে গেছে প্রায় লক্ষাধিক ঝাউগাছ। প্রচুর ম্যানগ্রোভ গাছও ভেঙে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বহু দুষ্প্রাপ্য গাছও। জেলা বন দপ্তরের দাবি, প্রাচীন গুঁড়ি ,কাণ্ডের চেহারা নিয়েছে এমন অধিকাংশ বড় ঝাউগাছই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা বনাধিকারিক স্বাগতা দাস বলেন,’আমফানের চরম তাণ্ডব কার্যত ধ্বংস করে দিয়েছে জেলার ঝাউবন। দিঘা-কাঁথি, নন্দীগ্রাম-হলদিয়া সর্বত্রই এক চিত্র। ক্ষতি অপরিসীম।’ঝড়ে বিধস্ত ঝাউবনের বিভিন্ন অংশ শুক্রবার পরিদর্শন করেন বন দপ্তরের আধিকারিকরা। উপকূলের ঝাউবনকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য তা নিয়ে শুরু হয়েছে পরিকল্পনা। এর জন্য বিশেষ তদারকি কমিটিও গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বনাধিকারিক। সর্বাধিক ক্ষতি হয়েছে বাজকুল এবং হলদিয়া রেঞ্জে এলাকার ঝাউবন।
হলদিয়ার রেঞ্জ অফিসার প্রকাশ মাইতি বলেন, ‘এমন ক্ষতি আগে দেখিনি। কত গাছ ভেঙেছে তার এখনও হিসাব নেই। প্রাথমিক হিসেবে হলদিয়া রেঞ্জ এলাকায় ৩৫ হাজার ঝাউগাছ নষ্ট হয়ে গিয়েছে।’ বাজকুলের রেঞ্জ অফিসার বাণীব্রত সামন্ত বলেন,’ খেজুরি-নন্দীগ্রামের উপকূলে ঝাউগাছ প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে গেছে আমফান।ক্ষতি অপরিসীম।’ কাঁথির রেঞ্জ অফিসার প্রবীর সাহা বলেন, দিঘার অবশিষ্ট ঝাউবনটুকু আর রইল না।কাঁথি, তাজপুর, শঙ্করপুরের ঝাউবন আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নতুনভাবে আবার গাছ বসাতে হবে।’ ঝাউবন উপকূলের জীববৈচিত্রের সবচেয়ে বড় আধারই শুধু না, তা আমাদের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচও। কিন্তু এভাবে যে বড় ক্ষতি হল, তা কীভাবে সামাল দেওয়া যাবে ভেবে পাচ্ছেন না কেউই। ঝাউ শুধু ঝাউ নয়, এ যে সৈকতের মৃত্তিকা সংবন্ধন! ঝাউয়ের সমাধি তাই সৈকতেরও সমাধির অপেক্ষায়। আর ঝাউয়ের বন না থাকলে বাঙালি কী করে পাবে আরেকটা পিন্টু ভট্টাচার্য?