মাঘ নিশীথের কোকিল ! বিনোদ মন্ডল জনাব আজহারউদ্দীন খান জন্মেছিলেন পয়লা জানুয়ারি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে। বাংলা মাসের হিসাবে পৌষের মাঝ বরাবর। তাঁর প্রিয় শব্দবন্ধ ছিল জীবনানন্দের ‘মাঘ নিশীথের কোকিল’ চূর্ণ পংক্তিটি। এই নামে একটি বহুল আলোচিত গ্রন্থ আছে তাঁর। কিন্তু অনেকাংশে এই অভিধাটি তাঁর চরিত্রের সঙ্গে বড়ো মানানসই মনে হয়। বিনোদন সর্বস্ব চটুল লেখালেখিতে যখন বাংলা সাহিত্যে বসন্তের কোকিল-দল পিউকাঁহা ডাকে উচ্চকিত, তখন আজহার – জেঠু ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা। তিনি মাঘ নিশীথের কোকিল।
তরুণ বয়সে সংস্কৃতি কর্মী হওয়ার সুবাদে বড় কাছ থেকে দেখেছি তাঁকে। আদ্যন্ত বাঙালি ছিলেন তিনি। অমায়িক, স্বল্পভাষী। সভা সমিতিতে বক্তব্যে এবং লেখায় খাপ খোলা তরবারির মতো ক্ষিপ্র ও তীক্ষ্ণধার ছিলেন। কিন্তু তার বাইরে পাবলিক প্লেসে, আড্ডায়, যানবাহনে নীরব শ্রোতা। কখনো কোনো পরচর্চায় অংশ নেননি। কারো প্রতি অসূয়া বা নিন্দাবাক্য বা রাগ প্রকাশের অভিযোগ করার উপায় নেই । তবে তরুণদের সব ধরনের আলোচনার সাথে মানিয়ে নিতেন। মৃদু হেসে সম্মতি বা অমত জানাতেন।
আধুনিকতা পোশাকে নয়, মননশীলতায় বা Plain living, high thinking কথাগুলি তাঁর চরিত্রের সাথে মিলে যায়। নয়ের দশকে মালদা শহরে আয়োজিত একটি তিনদিনের সাহিত্য সম্মেলনে তাঁর সহকর্মী হিসেবে অনেকের সাথে আমিও ছিলাম। আমরা যারা তরুণ, আমাদের থাকবার ব্যবস্থা হয় যুব আবাসে। বিশিষ্ট জনদের জন্য গৌড় ভবন বরাদ্দ ছিল। প্রথম দিন সন্ধ্যায় সভা শেষে তাঁর সঙ্গে আমরা গৌড় ভবনে গেলাম, রাজকীয় বৈভবে নির্মিত ভবনটি দেখার আশায়। বাপরে! এলাহি ব্যাপার! ওঁর কক্ষে ঢোকার পর উনি বললেন, এখানে আমি থাকতে পারবনা। তোমাদের কাছে নিয়ে চলো। অগত্যা উদ্যোক্তারা সে ব্যবস্থা করলেন,বলা ভালো বাধ্য হলেন।
সঙ্গে কোনো ঝোলা ব্যাগ কখনো পারতপক্ষে নিতেন না। জেলা এবং জেলার বাইরে বহু সভা-সমিতিতে তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে গেছি, সমৃদ্ধ হয়েছি নিরন্তর। শরীর ঠিক থাকলে যেকোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যাওয়ার অনুরোধ কখনো ফেরাতেন না। একবার বেলদাতে নজরুলের আবক্ষ মূর্তির আবরণ উন্মোচনের জন্য তিনি আমন্ত্রিত হন। বাড়িতে গাড়ি নিয়ে হাজির এই বান্দা! জেঠিমা আমাকে হঠাৎ বললেন — আমিও যাবো তোমাদের সঙ্গে। জেঠু তখন গাড়িতে উঠে বসে গেছেন। আমি এসে ওনাকে বললাম -জেঠিমাকে নিয়ে যাব। উনি বেঁকে বসলেন, পথে নারী বিবর্জিতা। আমিও নাছোড়। আমি জেঠিমাকে নিয়ে যাবো, কথা দিয়েছি। সেই একবারই ক্ষুন্ন হয়েছিলাম ওনার আচরণে। তবে দুজনেই গেলেন শেষ তক্।
বাংলা আকাদেমিতে নানা উপলক্ষ্যে ওনার সাথে গিয়েছি। কত কিংবদন্তী সাহিত্যিকের চোখে মুখে দেখেছি ওনার প্রতি সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধা মেশানো চাউনি। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, পবিত্র সরকার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়,পূর্ণেন্দু পত্রী , জ্যোতির্ময় ঘোষ, তপোধীর ভট্টাচার্য, অরুণ মিত্র প্রমুখের নাম তাৎক্ষণিক মনে ভাসছে। বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দির প্রাঙ্গণে আয়োজিত বইমেলায় একবার একটি সান্ধ্য অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন ঘোষিত প্রধান অতিথি। আমন্ত্রণপত্রে সভাপতি হিসাবে রাজনীতিক এক যুবকের নাম ছাপা হয়। যে কোনো কারণে ঘোষিত সভাপতি অনুপস্থিত থাকায় তাঁকে তাঁর পূর্ব সম্মতি ছাড়াই সভাপতির আসন অলংকৃত করতে মাইকযোগে অনুরোধ জানান উদ্যোক্তারা। তিনি তাঁর কথারম্ভে বলেন, ‘অপরের জুতো পায়ে দেওয়ার মতো বয়স এখন আর নেই। তবু অগত্যা…..জাতীয় কথাগুলি।
তাঁর জীবনের মুখ্য কাজ নজরুল গবেষণা। এই সুবাদে নজরুল থেকে মুজফফর আহমদ সহ তখনকার বহু বিদগ্ধজনের সান্নিধ্যে এসেছেন তিনি। ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ গ্রন্থটি এখন ধারে ভারে অপ্রতিম। নজরুল গবেষণা সিদ্ধির কারণে দুই বাংলার বিদ্বদসমাজে তিনি প্রথম পরিচিতি লাভ করেন। এছাড়াও বাংলা সাহিত্যে মোহিতলাল, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রমুখকে নিয়ে তাঁর মৌলিক গ্রন্থ রয়েছে। ‘বঙ্কিমচন্দ্র: অন্য ভাবনা’-গ্রন্থটির ভূমিকা অংশটি লেখার পর টাইপ করে তিনি কয়েকজনকে পড়তে দেন। এই আমার মত অভাজনের কাছেও এক কপি রয়েছে। পড়ে দেখি – সে তো অ্যাটম বোম্! ততদিন পর্যন্ত যা যা লেখা ও বলা হয়েছে বঙ্কিম মূল্যায়ণে,আজহার সাহেব যুক্তি তথ্য ও চিন্তার দ্যুতিতে অনেক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। পরে তা নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে। তিনি অনড় থেকেছেন।
অখন্ড মেদিনীপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু পত্রপত্রিকায় লেখার জন্য অনুরোধ আসত। লিখেওছেন। তবে লঘু রচনায় কখনো পাঠককে ভারাক্রান্ত করেননি। প্রতিটি প্রবন্ধে তথ্য ঠাসা থাকত। যেকোনো লেখায় প্রাসঙ্গিক কারণে যত ঐতিহাসিক মানুষের রেফারেন্স ব্যবহার করতেন, চেষ্টা করতেন তাঁদের জন্ম মৃত্যু সাল প্রয়োগের। প্রচার বিমুখ মানুষটি একসময় পত্র মিতালিতে দক্ষ ছিলেন। বহু বিখ্যাত সাহিত্যিকের ব্যক্তিগত পত্রাবলী সযত্নে সংগ্রহে রেখেছেন যা ভবিষ্যতে আর একটি মূল্যবান গ্রন্থের জন্ম দেবে।
‘শব্দের মিছিল’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন কিন্তু নিজে কখনো পত্রিকার জন্য প্রবন্ধ দেননি স্বতঃ প্রণোদিত হয়ে। আমরা, তরুণরা বারবার তাগাদা দিয়ে লেখা আদায় করেছি, কয়েকবার। বহুবার সসঙ্কোচে ফিরিয়ে দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নজরুল পুরস্কার গ্রহণের জন্য উনি যখন কলকাতার নজরুল মঞ্চে যান, ওনার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আমিও সফরসঙ্গী ছিলাম,ভাবতে আনন্দ হয়। আজ যখন প্রচারের ঢক্কা নিনাদে উচ্চতুচ্ছ একাকার, ভাবতে অবাক লাগে এই মানুষটি আপন বৈদগ্ধকে সযত্নে আবৃত রাখতেন। কোনও দেখনদারি ছিলনা। তাঁকে হারিয়ে আজ আমাদের মন খারাপ, আকাশও মেঘলা। তাঁর বিরল গুণাবলি অনুসরণ এবং প্রবন্ধাবলি নিপুণ পাঠ ও প্রচারের মধ্য দিয়ে তাঁর স্মৃতি আমাদের জাগরুক রাখতে হবে। জেঠু আজহারউদ্দীন খান কে আমার প্রাণের প্রণতি জানাই।