অশ্লেষা চৌধুরী: ভয়াবহ স্বাস্থ্য কর্মীর সঙ্কটে দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা কার্যত ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে ফলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সবলে আছড়ে পড়ছে ওই সকল রাজ্য গুলিতে বাড়ছে মৃত্যুর পরিমান। যার মধ্যে রয়েছে ছত্তিশগড় যেখানে কার্যত লাশের পাহাড় জমা হচ্ছে প্রতিদিন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত টেকনিশিয়ান পাওয়া যাচ্ছেনা। পাশাপাশি কোথাও দেখা দিয়েছে আ্যম্বুলেন্স সঙ্কট আর সেই কারণেই ক্রমশই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে করোনা পরিস্থিতি। কয়েকটি রাজ্য সাহায্য চেয়েছে কেন্দ্র কিংবা পার্শ্ববর্তী রাজ্যের কাছে।
দেখা যাচ্ছে এই পরিস্থিতির ভয়াবহ সঙ্কটে বিশেষ করে মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব এবং ছত্তিশগড়ের স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবাকে কাবু করে ফেলেছে করোনা। পাশাপাশি সিসিইউ স্পেশালিস্ট, অক্সিজেন এবং ভেন্টিলেটর সহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদেরও ঘাটতির পরিমান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত দলগুলি মহারাষ্ট্রের কমপক্ষে আটটি জেলা, পাঞ্জাবের তিনটি, ছত্তিশগড়ে তিনটিতে স্বাস্থ্য কর্মীদের অভাবের কথা উল্লেখ করেছে এবং মহারাষ্ট্রের চারটি জেলায় অক্সিজেন সরবরাহ এবং ছত্তিশগড়ে অ্যাম্বুলেন্সের অভাবের কথা জানিয়েছে।
কেন্দ্র মহারাষ্ট্রের কোভিড- ১৯ রোগীদের ভেন্টিলেটর পাঠানোর জন্য দুটি রাজ্যকে অনুরোধ করেছে এবং উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সিসিইউ স্পেশালিস্টের অভাবের কারণে পাঞ্জাবের রূপনগর জেলার ভেন্টিলেটরগুলি ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না বলে। শনিবার মহারাষ্ট্রের উপ-মুখ্যমন্ত্রী অজিত পাওয়ারের সাথে বৈঠকের পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভাদেকর বলেছেন, গুজরাট থেকে ৭০০টি এবং অন্ধ্র প্রদেশ থেকে ৪২১ টি ভেন্টিলেটর মহারাষ্ট্রে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রালয়, শনিবার মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব এবং ছত্তিসগড়কে পাঠানো চিঠিতে তিন রাজ্যের জনস্বাস্থ্য দলগুলির দ্বারা প্রাপ্ত ঘাটতির কথা তুলে ধরেছিলেন। দলগুলি মহারাষ্ট্রের পুনে, ভান্ডারা, পালঘর ও ওসমানাবাদ এবং ছত্তিশগড়ের রায়পুরে সীমিত অক্সিজেন সরবরাহের খবর জানিয়েছে। দুর্গ, ছত্তিশগড়ের অ্যাম্বুলেন্সের অভাব, মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গবাদে ক্রিটিক্যাল কেয়ার সরঞ্জামের অভাব, বালোরে কোভিড-১৯ টেস্টের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। ছত্তিশগড়ে দুর্গ ও কোরবাতে এবং মহারাষ্ট্রের লাতুর ও সাতারাতেও ভেন্টিলেটরগুলি যথেষ্ট ত্রুটিযুক্ত এটাও তারা জানিয়েছে। পাশাপাশি তারা মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গবাদ, জলগাঁও, জলনা, লাতুর, নন্দুরবার, পালঘর, সাতারা ও ইয়াওয়াতমাল, ছত্তিশগড়ের দুর্গ, যশপুর এবং রাজনন্দনগাঁও এবং পাঞ্জাবের পতিয়ালা, রূপনগর ও এসএএস নগরে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের যথেষ্ট অভাবের কথা জানিয়েছেন।
হেলথ অ্যান্ড ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশালিস্টেরা গত বছরই পূর্বাভাস দিয়েছিলেন যে মহামারীটির এই লাগামহীন বৃদ্ধির ফলে হাসপাতালে পর্যাপ্ত শয্যা এবং ভেন্টিলেটরের সংকট দেখা দিতে পারে। এছাড়াও মানবসম্পদ সম্পর্কিত বিষয়গুলি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ।
ওয়াশিংটন ডিসি ও নয়াদিল্লীর সদর দফতরের স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি কেন্দ্র, সেন্টার ফর ডিজিজ ডায়নামিক্স ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিসির প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক রামনান লক্ষ্মীনারায়ণন বলেছেন, “বর্তমানে যা পরিস্থিতি, আমাদের ধারণা ছিল লকডাউন না করলেই এটি ঘটবে।” কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক শুক্রবার বলেছিল যে দেশজুড়ে সক্রিয় রোগীদের মধ্যে ০.৪৬ শতাংশ ভেন্টিলেটর, ২.৩১ শতাংশ নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট এবং ৪.৪১ শতাংশ অক্সিজেনের আওতায় থাকবেন।
রবিবার ভারতে পাঁচটি সর্বাধিক জনবহুল রাজ্য সহ একাধিক রাজ্যে সংক্রমণের তীব্র প্রবৃদ্ধি সহ ১,৫২,০০০ টিরও বেশি নতুন কোভিড ১৯ এর কেস রেকর্ড করা হয়েছে, এটি ইতিমধ্যে আগের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে। এদিন থেকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে রেকর্ড হওয়া নতুন মামলার ক্ষেত্রে মহারাষ্ট্রের পরিমাণ ছিল ৩৬ শতাংশ, তবে প্রতিদিনের নতুন মামলার সাত দিনের গড় উত্তর প্রদেশ এবং বিহারে ৩৪ গুণ, বাংলায় ৯ গুণ এবং মধ্য প্রদেশে ৬ গুণ বেড়েছে মার্চ মাস থেকে।
একটি কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, “নতুন কেসগুলি উদ্ভূত হওয়ার সাথে সাথে ভাইরাসটি এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আরও বেশি সুযোগ পেয়ে গেছে – বিশেষত যে সমস্ত লোকেরা সাবধানতা অবলম্বন করছে না।” তিনি আরও বলেন, “আমরা এখন যে বৃদ্ধি দেখছি তাতে বোঝা যাচ্ছে যে প্রতিদিনের কেসের সংখ্যা আমাদের এখনকার চেয়ে অনেক উচ্চ স্তরে উঠতে পারে। যদি প্রতিদিনের নতুন আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক দিনের মধ্যে ২,০০০০০ পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তবে আমি অবাক হব না।“
স্বাস্থ্য মন্ত্রালয়গুলি রাজ্যগুলিকে যতটা সম্ভব সর্তকতা অবলম্বন করে জনগণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আহ্বান জানিয়েছে, এছাড়াও পজিটিভ রোগীদের যথাযথ চিকিত্সা করারও নির্দেশ প্রদান করেছে। তবে জনস্বাস্থ্য দলগুলি “মহামারী ক্লান্তি” নামক এমন একটি প্রবণতা পর্যবেক্ষণ করেছে যা গত বছর কিছু কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞরাও সতর্ক করেছিলেন। নির্দেশিকাগুলিতে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতিটি পজিটিভ রোগীর জন্য বিশেষ যত্ন এবং তাদের কোয়ারেন্টাইন করে রাখার কথাও বলা হয়েছে। একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, “মহামারীটি বিশাল আকার ধারণ করেছে – আসন্ন সমস্ত দৃষ্টিপাত মৃত্যুর প্রতিরোধে হওয়া উচিৎ।”
একদিকে যখন এমন উদ্বেগের কথা জানান দিচ্ছেন তারা, ঠিক সেই সময় করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভয়ঙ্কর দৃশ্য ধরা পড়ল ছত্তিশগড়ে। একের পর এক মৃতদেহ খোলা আকাশের নিচে আবার কখনও হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে রয়েছে। রাইপুরের ডাঃ ভীমরাও আম্বেদকর মেমোরিয়াল হাসপাতালের এই ছবি দেখলে শিউরে উঠবেন যে কেউ। করোনায় মৃতদের দ্রুত শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে স্তূপীকৃত করা হচ্ছে। হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট এবং অক্সিজেন-সজ্জিত শয্যাগুলি গত এক সপ্তাহ ধরে প্রায় ১০০ শতাংশ দখল রয়েছে। বেডের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, “কেউ অনুমান করতে পারে নি যে একসাথে এত বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটবে। আমাদের কাছে সাধারণ মৃত্যুর সংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ফ্রিজার রয়েছে। তবে আমরা বুঝতে পারছি না যে এক থেকে দু’জনের মৃত্যুর জায়গাগুলি কীভাবে ১০-২০ জনকে রাখা হবে। আমরা যদি ১০-২০র জন্য প্রস্তুত করি তবে ৫০-৬০ জন লোক মারা যাচ্ছে। আমরা এভাবে একসাথে এত লোকের জন্য ফ্রিজারের ব্যবস্থা কিভাবে করব?”
দ্বিতীয় তরঙ্গ দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এমন দশটি রাজ্যের মধ্যে ছত্তিশগড় রয়েছে। রবিবার ১০,৫২১টি নতুন কোভিড সংক্রমণ হয়েছে। এখনও পর্যন্ত মোট করোনা সংক্রমিতের সংখ্যা ৪,৪৩,২৯৭। মৃত্যু হয়েছে ১২২ জনের।সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ রাইপুর ও দুর্গ জেলা – যা লকডাউনের আওতায় রয়েছে।একদিনে রাইপুরে আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ৮৩৩ জন। দুর্গ জেলায় একদিনে আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ৬৫০ জন।
একই সঙ্গে মহারাষ্ট্র ও পশ্চিমবঙ্গেও করোনার তাণ্ডব অব্যাহত। সোমবার রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বঙ্গে একদিনে আক্রান্ত হয়েছে ৪,৫১১ জন এবং করোনার বলি হয়েছেন ১৪ জন। মহারাষ্ট্রেও বাধ ভাঙছে করোনা; তাই সংক্রমণ রুখতে সম্পূর্ণ লকডাউন করার কথা ভাবছে মহারাষ্ট্র সরকার। মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্য মন্ত্রী রাজেশ তোপে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে জানিয়েছেন, রাজ্যে লকডাউনের ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে ১৪ এপ্রিল সিদ্ধান্ত নেবেন।
নাইট কারফিউ, আংশিক লকডাউন, যাবতীয় তৎপরতার পরেও প্রতিদিন সামনে আসছে দৈনিক সর্বোচ্চ সংক্রমণ; কিছুটেই রাশ টানা যাচ্ছে না করোনার সংক্রমণে। দেশ জুড়ে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১ লক্ষ ৬১ হাজারেরও বেশি মানুষ। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আক্রান্ত হয়েছেন ১ লক্ষ ৬১ হাজার ৭৩৬ জন। মৃত্যু হয়েছে ৮৭৯ জনের। এই নিয়ে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ১ কোটি ৩৬ লক্ষ ৮৯ হাজার ৪৫৩ জন। মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ ৭১ হাজার ৫৮ জন। দেশে বর্তমানে অ্যাক্টিভ মামলার সংখ্যা ১২ লক্ষ ৬৪ হাজার ৬৯৮। গত ২৪ ঘণ্টায় ৯৭ হাজার ১৬৮ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। দেশে এখনও পর্যন্ত সুস্থ হয়ে উঠেছেন মোট ১ কোটি ২২ লক্ষ ৫৩ হাজার ৬৯৭ জন। করোনা রুখতে ইতিমধ্য়েই দেশজুড়ে শুরু হয়ে গিয়েছে ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়া। এখনও পর্যন্ত ১০ কোটি ৮৫ লক্ষ ৩৩ হাজার ৮৫ জনকে করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে।