জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৭৩
রাধাকান্ত মন্দির, পিংলা (থানা– পিংলা, মেদিনীপুর)
চিন্ময় দাশ
বহু প্রাচীন কালের এক দেবী– পিঙ্গলাক্ষী। তাঁর নাম থেকেই জনপদটির নাম হয়েছিল পিংলা। মাহিষ্যরাই ছিলেন পিংলার মুখ্য জাতি সম্প্রদায়। তিন-চার শ’ বছর আগের কথা। বাংলার বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েকটি বনেদি ও সম্ভ্রান্ত পরিবার এসে পিংলায় বসত গড়ে তোলেন। উল্লেখযোগ্যভাবে তাঁরা সকলেই ছিলেন কায়স্থ জাতিভুক্ত। তাঁদের অনেকেই ছোট-বড় নানা মাপের কয়েকটি জমিদারীও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
বড়লাট কর্নওয়ালিশ-এর প্রচলিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথায় গজিয়ে ওঠা অর্বাচীন কালের জমিদারী নয়। মেদিনীপুরের ইতিহাস থেকে জানা যায়, দশসালা বন্দোবস্তের আগে থেকে, ২৯টি প্রাচীন জমিদারবংশ ছিল মেদিনীপুর জেলায়। এঁদের সাথে ৩০টিরও বেশি স্থানে বড় মাপের অনেকগুলি তালুকদার বংশও প্রতিষ্ঠিত ছিল মেদিনীপুরে। পিংলা তার ভিতর অন্যতম। পিংলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ধর্মাচরণ– যা কিছু ঐতিহ্য, সবই গড়ে উঠেছিল এই বনেদি তালুকদার পরিবারগুলির হাত ধরেই।
পিংলার তালুকদারদের একটি ছিল পালবংশ। দক্ষতার সাথে জমিদারি পরিচালানর সুবাদে, নবাব দরবার থেকে ‘চৌধুরী’ খেতাব পেয়েছিলেন তাঁরা। নিজেরা পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ‘পালচৌধুরী’ হিসাবে। তাঁদের বসতভিটে, জলাশয়, মন্দির, রাসমঞ্চ– সবকিছু আজও ‘চৌধুরী গড়’ নামেই পরিচিত হয়ে আছে।
এই নিবন্ধের মন্দিরটি কার হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা আর জানা যায় না। কেবল মন্দিরের সংস্কারক হিসাবে জনৈক আনন্দলাল পাল-এর নাম পাওয়া যায়। কিন্তু সমীক্ষার সময় আমরা পাল কিংবা চৌধুরী কোনও বংশের সন্ধানটুকুও পাইনি। কারণ হল, আনন্দলালের বংশধারা লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। বংশের শেষ পুরুষ অন্নদা শংকর চৌধুরী ছিলেন অপুত্রক। পরবর্তীকালে তাঁর দৌহিত্রগণ এসে মন্দির এবং দেবতার দায়ভার গ্রহণ করেছিলেন। বর্তমানে জনৈক বিমান চন্দ্র দে সেবায়তগণের পক্ষে দায়িত্ব পালন করছেন।
বিস্তৃত এক প্রাঙ্গণের ভিতর মন্দিরটি অবস্থিত। পাদপীঠের অনেকটা অংশই ইতিমধ্যে ভূমিগত হয়েছে। মন্দিরকে বেষ্টন করা প্রদক্ষিণ-পথটি বেশ প্রশস্ত। ইটের তৈরী দক্ষিণমুখী এই মন্দিরটি আয়তাকার। দৈর্ঘ্য ২৬ ফুট, প্রস্থ ২২ ফুট, আর উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট। কোনও প্রতিষ্ঠালিপি নাই, তবে মন্দিরে একটি সংস্কারলিপি দেখা যায়। তার হুবহু বয়ানটি এরকম– ” শ্রীশ্রীরাধাকান্ত জিউ / হাল মেরামত হঅ / সকাব্দা ১৭৭৯ / সন ১২৬৪ সাল / কর্তিক শ্রীযু. আনন্দলাল পাল চৌধুরী শ্রী হরি… /দাস মিস্ত্রি সাং দা (স)পুর পঃ / চেতুয়া। ” অর্থাৎ ইং ১৮৫৭ সালে শ্রীযুক্ত আনন্দলাল পাল চৌধুরী মন্দিরটির সংস্কার করিয়েছিলেন। মিস্ত্রী ছিলেন দাসপুরের জনৈক হরিদাস মিস্ত্রী।
মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকালটি প্রত্যক্ষভাবে জানা যায় না। তবে, পূর্ববর্তী পুরাগবেষকগণ তাঁদের বিবরণে অনুমান করেছেন, মন্দিরটি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে নির্মিত হয়ে থাকবে।
পঞ্চ-রত্ন মন্দির, কিন্তু নির্মিত হয়েছে একটু ভিন্ন রীতিতে। প্রথমে একটি গর্ভগৃহ নির্মাণ করে তার মাথায় রত্ন স্থাপন করলে, রত্নমন্দির নির্মিত হয়। একটিমাত্র রত্ন স্থাপিত হলে, মন্দির হয় এক-রত্ন। যখন গর্ভগৃহের মাথার ছাউনির উপর চার কোণে আরও চারটি রত্ন স্থাপিত হয়, তখন সেটি পঞ্চ-রত্ন হয়ে ওঠে। কিন্তু এই মন্দিরের গড়নে একটু ব্যতিক্রমী রীতি দেখা যায়।
প্রথমে একটি দালান বা চাঁদনি রীতির গর্ভগৃহ নির্মাণ করে, সেটির সমতল ছাউনির উপর রত্ন-রীতির মন্দিরটি স্থাপন করা হয়েছে। দালানের দুটি অংশ– সামনে খিলান-রীতির তিন-দুয়ারী অলিন্দ। পিছনে এক-দুয়ারী গর্ভগৃহ। তবে, গর্ভগৃহের দু’দিকে দুটি ছোট কক্ষ আছে, সেগুলির দ্বারপথ গর্ভগৃহের সাথে যুক্ত। অলিন্দের সিলিং হয়েছে টানা-খিলান রীতিতে। গর্ভগৃহের সিলিং গড়া হয়েছে দুটি খিলানের মাথায় ভল্ট নির্মাণ করে।
প্রথমে একটি দালান বা চাঁদনি রীতির সৌধ নির্মাণ করে, সেটির সমতল ছাউনির উপর রত্ন-রীতির মন্দিরটি স্থাপন করা হয়েছে। দালানের দুটি অংশ– সামনে খিলান-রীতির তিন-দুয়ারী অলিন্দ।
পিছনে এক-দুয়ারী গর্ভগৃহ। তবে, গর্ভগৃহের দু’দিকে দুটি ছোট কক্ষ আছে, সেগুলির দ্বারপথ গর্ভগৃহের সাথে যুক্ত। অলিন্দের সিলিং হয়েছে টানা-খিলান রীতিতে। গর্ভগৃহের সিলিং গড়া হয়েছে দুটি খিলানের মাথায় ভল্ট নির্মাণ করে।
দালানের উপরে স্থাপিত সৌধটি একেবারে স্বতন্ত্র একটি রত্নমন্দির। সামনে একটি তিনদুয়ারী অলিন্দ। তার পিছনে একদ্বারী গর্ভগৃহ। এই অংশের মাথায় চালা-রীতির ঢালু ছাউনি। তার উপরেই পাঁচটি রত্ন স্থাপিত হয়েছে।
ব্যতিক্রম আরও আছে এখানে। চতুস্কোণ নয়, পাঁচটি রত্নই ‘আট-কোণা’ করে নির্মিত হয়েছে। যা সচরাচর দেখা যায় না। রত্নগুলির বাঢ় অংশে আটটি করে দ্বারপথ। গন্ডী অংশে কলিঙ্গধারায় পীঢ়-ভাগ করা। অভ্যন্তরে শূন্য গর্ভগৃহ। রত্নগুলির শীর্ষক অংশ ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত। আমলক ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নাই।
আমরা রত্নগুলি বলছি বটে, বর্তমানে কেবল কেন্দ্রীয় রত্নটি এবং বায়ুকোণের রত্ন– এই দুটিই কোনও রকমে টিকে আছে। বাকি তিনটি রত্ন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
অনেক পরে, একটি পঞ্চ-রত্ন রাসমঞ্চ নির্মিত হয়েছিল দেবতার উৎসবের জন্য। এছাড়া, সপ্তরথ শিখর দেউল রীতির একটি শিবমন্দিরও আছে এই পরিবারের।
উল্লেখ করবার মত অন্য অলংকরণ নাই কোথাও। কেবল রাধাকান্ত মন্দিরের গর্ভগৃহের দ্বারপথের দু’পাশে দুটি দ্বারবর্তিনী মূর্তি দেখা যায়। একটি মূর্তি ভিনিশীয় রীতির দরজার প্রান্তে শিশুসন্তান কোলে মাতৃমূর্তি। শিবের মন্দিরটিতে নারীসঙ্গী এক বিলাসীবাবুর
মূর্তি সহ গুটি চারেক টেরাকোটা ফলক– এই যা।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী বিমান (মাণিক) দে, রাজনারায়ণ বসু, জয়দেব বসু– পিংলা।
যাওয়া-আসা : মেদিনীপুর, খড়গপুর, ডেবরা কিংবা বালিচক স্টেশন– যে কোনও জায়গা থেকে ময়নাগামী পথের উপরেই পিংলা। পিংলা ঢোকার মুখেই উত্তরপাড়ায় চৌধুরীগড় এবং মন্দির।