জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল – ৪০
শীতলা মন্দির, কর্ণগড় (শালবনি)
চিন্ময় দাশ
১৭৯৯ সাল। কর্ণগড়ের রানি শিরোমণি দেবীকে বন্দি করে, ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে নিয়ে গিয়েছিল ইংরেজরা। সেসময় অবাধ লুন্ঠনের পর, রাজপ্রাসাদ ধূলিসাৎ করে দেয় ইংরেজের সেনারা। মুক্তিলাভের পর, মেদিনীপুর নগরীর সংলগ্ন আবাসগড়ে বাস করেছেন শিরোমণি। একেবারে মৃত্যু পর্যন্ত। কোনও দিন কর্ণগড়ে ফিরে যাননি। প্রাসাদ আগেই গিয়েছিল। অবহেলায়, অনাদরে, অব্যবহারে দেবালয়গুলিও এক এক করে অবলুপ্তির পথে গিয়েছে। দুটি মন্দির, যাদের মন্দিরের কঙ্কাল বলাই শ্রেয়, কোনরকমে টিকে আছে আজও। তারই একটি হল– শীতলা মন্দির।
সুরম্য প্রাসাদ, তোষাখানা, দাবদাহের দিনে শীতল বাতাসের জন্য দীঘির মাঝখানে গড়ে তোলা হাওয়াখানা (জলহরি নামে পরিচিত), অনেকগুলি দেবালয় নির্মাণ করেছিল রাজপরিবার। তার উল্লেখ আছে ও’ম্যালি সাহেবের জেলা গেজেটিয়ারেও– “The fort contains a tank, in the centre of which there is a building made of stone. There are many temples in and about the ruins in various stages of dilapidation, from most of which the images have been removed.” — `BENGAL DISTRICT GAZETTEERS MIDNAPORE ‘ / L.S. S. O’Maley.
ক্ষত্রীয় রাজপুত জনৈক সুরথ সিংহ ছিলেন অযোধ্যাগড়, আড়াসিনি, বলরামপুর আর কর্ণগড়ের অধিপতি। রাজধানি ছিল চাঙ্গুয়াল। তাঁর নিজেরই দেওয়ান লক্ষ্মণ সিংহ, গড় সর্দার ভীম মহাপাত্র এবং অন্য এক সহযোগীকে নিয়ে সুরথকে হত্যা করে। তিন ভাগে ভাগ করা হয় সুরথের রাজ্য। কর্ণগড় নিয়েছিল লক্ষ্মণ সিংহ। সাতজন রানি ছিলেন সুরথের।
সহমরণে যাওয়ার সময় চিতায় উঠে, তিন পাতকীকে অভিসম্পাত দিয়েছিলেন পাটরানি– সাত পুরুষে নির্বংশ হয়ে যাবি তোরা। দেওয়ান থেকে কর্ণগড়ের রাজা হয়েছিলেন লক্ষ্মণ সিংহ। তাঁর বংশের ৬ষ্ঠ রাজা যশোবন্ত সিংহ। বংশের শ্রেষ্ঠতম রাজা ছিলেন তিনি। শোনা যায়, মহামায়ার মন্দিরের পঞ্চমুন্ডীর আসনে বসে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন তিনি। ধর্মপ্রাণ যশোবন্ত বহু দেবালয় নির্মাণ করেছিলেন নিজের জীবনে। অনুমান করা হয়, রাজপ্রাসাদের লাগোয়া শীতলা মন্দিরটি তাঁরই কীর্তি।
যশোবন্তের পুত্র অজিত সিংহ। অপুত্রক অবস্থায় অজিতের মৃত্যু হয়। দেখা যায়, অজিতের মৃত্যুতে সাত পুরুষেই দেওয়ান লক্ষ্মণ সিংহের বংশ বিলুপ্ত হয়ে যায়।
যাক সেসব কথা। অজিতের মৃত্যুতে তাঁর দুই পত্নী– রানী ভবানী এবং রানী শিরোমণি জমিদারীর অধিকারিণী হন। মাত্র ২ বছর পরে, ভবানী প্রয়াত হলে, শিরোমণি জমিদারীর পরিচালক হন। সেসময় ইংরেজের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের সুবাদে দিকে দিকে চুয়াড় বিদ্রোহের দাবানল দেখা দিয়েছে। রানী শিরোমণি সেই বিদ্রোহে সামিল হয়েছেন, এই অভিযোগে রানিকে গ্রেপ্তার করে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ামে বন্দী করে রাখে ইংরেজরা। সেই সাথেই কর্ণগড়ের রাজপ্রাসাদ লুন্ঠন করে, ধ্বংস করে দেওয়া হয়। তখন থেকেই গড়ের ভিতর ও বাইরের মন্দিরগুলিও ধ্বংস হতে শুরু করেছিল।
রাজা বা জমিদারগণ কেবল পৌরাণিক দেবদেবীর মন্দির গড়েছেন, এমনটা নয়। লৌকিক দেবদেবীর মন্দিরও গড়েছেন তাঁরা। শীতলার মন্দির গড়েছেন, এমন নজিরও আছে মেদিনীপুর জেলায়। মুগবেড়িয়ার জমিদার নন্দ পরিবার শীতলার মন্দির গড়েছেন মেদিনীপুর শহরের সুজাগঞ্জ মহল্লায়। পটাশপুর পরগনার জমিদার শীতলার পঞ্চরত্ন মন্দির গড়েছেন তাঁদের পঁচেটগড় জমিদারবাড়িতে। মেদিনীপুর জেলায় শীতলার সব সেরা মন্দিরটি আছে দাসপুর থানার সুরতপুর গ্রামে। সূত্রধর সমাজের সেরা কারিগর ঠাকুরদাস শীল এটি নির্মাণ করেছিলেন।কর্ণগড়ের শীতলা মন্দিরটি আকারে তেমন বড় নয়। দক্ষিণমুখী মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে চালা-রীতিতে।
তবে, এমনই ভগ্নদশা সেটির, চার-চালা না আট-চালা– কোন রীতিতে নির্মিত হয়েছিল, বোঝার তেমন উপায় নাই। তবে নিবিড় পর্যবেক্ষণে অনুমান হয়, আট-চালা হয়ে থাকতে পারে। দ্বিতলের দেওয়াল নাই, কেবল ছাউনি অংশটুকু মাত্র। সেটিও আবার নিচের চার-চালার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জোড়া।দুটি অংশ এই মন্দিরের। সামনে একটি অলিন্দ, পিছনে গর্ভগৃহ। অলিন্দে খিলান-রীতির তিনটি দ্বারপথ। থামগুলি ইমারতি রীতির। গর্ভগৃহে দক্ষিণের দ্বারটি ছাড়া, পশ্চিমেও একটি নিষ্ক্রমণ পথ আছে। এই দুটি দ্বারপথও খিলান-রীতির।অলিন্দ এবং গর্ভগৃহের সিলিং হয়েছে লহরা-রীতিতে। ধাপে ধাপে বসানো ল্যাটেরাইট পাথরের খাঁজগুলি স্পষ্ট দেখা যায় এখন। রক্ত-মাংসহীন কংকালের চেহারা এখন এই মন্দিরের। তা থেকে দেখা যায়, কী মুন্সিয়ানার সাথে পাথর আর ইট দুই উপাদানই ব্যবহার করা হয়েছিল মন্দিরে।
সম্পূর্ণ মন্দিরটি উৎকৃষ্ট পঙ্খের প্রলেপে মোড়া। টেরাকোটার কোনও অলংকরণ নাই মন্দিরে। তবে, পাথর কেটে তাতে চুনের প্রলেপ দেওয়া পঙ্খের কিছু মূর্তি রচিত আছে। সামনের কার্ণিশের নীচ বরাবর সেগুলি স্থাপিত।
ছোট্ট আকারের এই মন্দির একদিন ছিল মুক্তোদানার মত উজ্বল, অতুলনীয়। আজ তার কংকালটুকু ছাড়া কিছু নাই। নাই কর্ণগড়ের আরও অনেক কিছুই। রাজার প্রাসাদ, তোষাখানা, জলহরি, পারাং নদী থেকে কাটা গড়খাই, ছড়ানো ছিটানো মন্দিরগুলি– কিছুই নাই, দুটি একটি টুকরো-টাকরা চিহ্ন ছাড়া।
সবগুলিরই কয়েকটি ছবি দেওয়া হল। বাড়ি বসেই মানস ভ্রমণ হতে পারবে পাঠক-পাঠিকার।
যাওয়া-আসা : মেদিনীপুর শহর থেকে উত্তরমুখে বাঁকুড়াগামী রাস্তায় ৫ কিমি দূরে ভাদুতলা। সেখান থেকে আরও ৫কিমি উত্তর-পূর্বে, মহামায়া মন্দির ছাড়িয়ে, কর্ণগড় গ্রাম। সেখানে শীর্ণ পারাং নদীর সোঁতা পার হলেই রাজার গড়। আবার, ভাদুতলা থেকে বাঁকুড়া অভিমুখে আরও খানিক এগিয়ে গোবরু। সেখান থেকে পুবদিকের রাঙামাটির পথ সরাসরি জলহরি দীঘির পাড় পর্যন্ত গিয়েছে। এবার কেবল গড়ের ভিতর ঢুকে পড়ার অপেক্ষা। এ পথে নদীর ঝামেলা নাই। পুরোটাই মোটর চলাচলের উপযোগী।
সমীক্ষা-সঙ্গী : উদয় নারায়ণ জানা, ভূমি রাজস্ব আধিকারিক, মেদিনীপুর।
প্রচ্ছদ-রামকৃষ্ণ দাস