জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল- ৫০
মল্লেশ্বর শিবমন্দির,মল্লেশ্বরপুর(চন্দ্রকোনা শহর) চিন্ময় দাশউত্তর ভারতের বৃন্দাবন থেকে পুরীধাম পর্যন্ত প্রসারিত কতকালের প্রাচীন এক রাজপথ। আদি শঙ্কর (৭৮৮ – ৮২০ খ্রি.) জগন্নাথ মন্দিরকে দশনামী সম্প্রদায়ের ৪টি মঠের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এর পৌণে এক হাজার বছর পরে, চৈতন্যদেবের গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার। দুইয়ের ফলে, লক্ষ-কোটি পুণ্যার্থী শত শত বছর ধরে উত্তরে বৃন্দাবন আর দক্ষিণে পুরীধাম যাতায়াত করেছেন এই পথে। মুঘল আমলে, পথটি সামরিক কাজে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। উত্তর ভারত ও পূর্ব ভারতের গৌড় থেকে দাক্ষিণাত্যে যোগাযোগের এই পথ পরিচিত হয় ‘বাদশাহী সড়ক’ নামে।
গড় মান্দারণ হয়ে বাদশাহী সড়কটি মেদিনীপুরে প্রবেশ করে বালেশ্বর অভিমুখে প্রসারিত। এই প্রাচীন পথের উপরেই চন্দ্রকোণা নগরী। পূর্বকালে এর নাম ছিল– মানা। জনৈক খয়ের মল্ল (৬৯৪ – ৭১০ খ্রি.)-এর রাজধানী ছিল এখানে। একটি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে, খয়ের মল্ল চন্দ্রকোণা থেকে বাঁকুড়ার প্রদ্যুম্নপুরে উঠে যান। পরবর্তীকালে এই বংশের রাজা জগৎমল্ল বিষ্ণুপুরে রাজধানী তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন।
খয়ের মল্লের ৪৯তম পুরুষ ছিলেন হাম্বির মল্ল। বিষ্ণুপুরে মল্লবংশের উজ্বল জ্যোতিস্ক তিনি। চৈতন্যদেবের ঘনিষ্ঠ পার্ষদ শ্রীনিবাস আচার্যের কাছে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন হাম্বির। বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত মন্দিরগুলির উদ্ভব হয়েছিল মল্লবংশ বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণের পর থেকে।
কিন্তু হাম্বিরের পূর্ব পর্যন্ত মল্লবংশ ছিল শিবের উপাসক।
শৈব রীতিতে ধর্মাচরণ করত এই রাজবংশ। রাজা রঘুনাথ মল্ল মল্লেশ্বর শিব মন্দির নামে একটি মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিষ্ণুপুরে। চন্দ্রকোনা থেকে উঠে যাওয়ার আগে, খয়ের মল্লও একটি শিব মন্দির গড়েছিলেন নিজের রাজধানীতে। নিজের বংশের নাম যুক্ত করে, তিনিও নাম করেছিলেন– মল্লেশ্বর শিব মন্দির।
খয়ের মল্লের রাজধানি ছিল চন্দ্রকোণা। এই নগরীতে ছিল রাজার পরিখা দিয়ে ঘেরা বারো -দুয়ারী গড়। গড়ের ভিতর রাজপ্রাসাদ, দেবালয়, দীঘি-জলাশয়, বাজারও। প্রাসাদ আজ আর নাই। সেই পরিখার চিহ্ন, বা গড়ের চিহ্ন খুঁজলে, হয়তো চোখে পড়বে। কিন্তু গোঁসাই বাজার, জোহরা দীঘি বহাল আছে। আর আছে মল্লেশ্বর শিবের মন্দিরটি। শহরের দক্ষিণ অংশে, মেদিনীপুর মুখী প্রাচীন বাদশাহী সড়কের গায়েই মন্দিরটি অবস্থিত।
মন্দির হিসাবে নয়, চিরকাল এটিকে ‘মল্লেশ্বর ঠাকুরবাড়ি’ নামেই অভিহিত করা হয়ে এসেছে। যেমন আর একটি ঠাকুরবাড়ি গড়া হয়েছিল চন্দ্রকোণা শহরে, অযোধ্যা মহল্লায় রঘুনাথবাড়ি। একেবারে দাক্ষিণাত্য এলাকার দুর্গ-মন্দিরের আদলে গড়া হয়েছিল এটি। ভিতরে দেবতার ব্যবহারের জন্য ‘সিদ্ধি পুস্করিণী’ নামের নিজস্ব জলাশয়, ‘জপ-স্থান’ নামের ছোট আকারের একটি আটচালা, চার-চালা রীতির একটি বৃষভ মন্দির, আট-চালা রীতির একটি মনসা মন্দির ইত্যাদি। ছিল ষোড়শ-দ্বারী নাটমন্দির, ধনাগার, পাকশালা, সান্ত্রী-ঘর, রোশনচৌকির জন্য নহবতখানা, অতিথিশালা — কী ছিল না? সবই নির্মিত হয়েছিল মল্লেশ্বর ঠাকুরবাড়িতে।
মূল মন্দিরটি সহ অনেকগুলিই টিকে আছে আজও, দেখতেও পাওয়া যায়। তবে অতি জীর্ণ অবস্থা সবগুলিরই।
জীর্ণ মন্দিরটি দেখতে পাওয়া যায়, দেখা যায় না মন্দিরের দেবতাকে। গর্ভগৃহে বিশাল একটি পাথর খন্ডের উপর তিনটি শিলাখন্ড শিব, দূর্গা এবং গঙ্গা হিসাবে অধিষ্ঠিত। মূল মল্লেশ্বর এখানে অদৃশ্য। পাথরটির নীচে গম্ভীরার ভিতর বিগ্রহটি স্থাপিত আছে। ১৫৬৭ – ৬৮ খ্রি. কালাকড়ি গ্রামে শিলাবতী নদী পার হয়ে, কালাপাহাড় যখন অভিযানে অগ্রসরমান, পুরোহিতগণ পাথর চাপা দিয়ে বিগ্রহ রক্ষা করেছিলেন। সেই আবরণ আর সরানো হয়নি।
ইতিহাস রেখে, এবার আমরা একটু মন্দিরের বিষয়ে কথা বলে নিই। বেশ বড় মাপের পঞ্চ-রত্ন মন্দির এটি। ইট এবং পাথর দুই উপাদানেরই মন্দির আছে চন্দ্রকোণায়। মল্লেশ্বরের পূর্বমুখী এই সৌধটি নির্মিত হয়েছে মাকড়া বা ল্যাটেরাইট পাথর দিয়ে। প্রায় বর্গাকার অবয়ব– দৈর্ঘ্য সওয়া ২৯ ফুট, প্রস্থ পৌনে ২৬ ফুট। মন্দিরের উচ্চতা আনু. ৪৫ ফুট।
প্রশস্ত প্রদক্ষিণ পথের উপর সৌধটি স্থাপিত। এই মন্দিরের অন্যতম গরিমা– চারদিক জুড়ে চারটি অলিন্দ নির্মিত হয়েছে। প্রত্যেক অলিন্দে খিলান-রীতির তিনটি করে দ্বারপথ। তবে, গর্ভগৃহের প্রবেশদ্বার একটিই। কোনো নিষ্ক্রমণ-পথ নাই। উল্লেখের বিষয়, গর্ভগৃহের বাইরের চার দেওয়ালেই চারটি ‘প্রতিকৃতি জগমোহন’ রচিত আছে, তাতে সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়েছে মন্দিরের।
মন্দিরের পাঁচটি রত্ন শিখর-রীতির। বাঢ় এবং গন্ডী জুড়ে ‘রথ-বিভাজন’ করা। কেন্দ্রীয় রত্নে সপ্তরথ আর কোণেরগুলিতে পঞ্চরথ বিন্যাস। গন্ডী অংশে পীঢ় রীতিতে থাক কেটে সৌন্দর্যায়ন হয়েছে। পাঁচটি রত্নেরই মাথায় বেঁকি, আমলক, কলস এবং ত্রিশূল-দন্ড স্থাপিত।
অলিন্দগুলির ভিতরের ছাদ বা সিলিং গড়া হয়েছে ‘টানা-খিলান’ রীতিতে। গর্ভগৃহের সিলিংয়ে চারটি ছোট ‘পাশ-খিলান’-এর মাথায় গম্বুজ স্থাপিত হয়েছে, দেখা যায়। খিলান আর গম্বুজ– এই দুইয়ের ব্যবহার দেখে অনুমান করা যায়, এটি খয়ের মল্লের নির্মিত আদি মন্দিরসৌধ নয়। কেননা, সেকালে খিলান আর গম্বুজ এদেশে প্রচলিত হয়নি। পরবর্তীকালে ইসলামীয় সংস্কৃতির হাত ধরে এগুলির প্রচলন হয়েছিল।
এর কারণ খুঁজতে আবার একবার ইতিহাস উলটাতে হবে আমাদের। সময় ১৬৯৬ খ্রি., চন্দ্রকোনায় রাজা তখন জনৈক রঘুনাথ সিংহ। ‘বাংলার শিবাজী’ নামে খ্যাত বরদার অধিপতি শোভা সিংহ বর্ধমান আক্রমণ করে, কৃষ্ণরামকে হত্যা এবং বর্ধমান অধিকার করে নেন। সেই যুদ্ধে রঘুনাথ সিংহ ছিলেন শোভার সহযোগী।
পরবর্তীকালে ১৭০২ খ্রি. কৃষ্ণরামের পৌত্র কীর্তিচাঁদ ভয়ানক যুদ্ধে রঘুনাথকে হত্যা করে চন্দ্রকোণা অধিকার করে নেন। সেই যুদ্ধে যে বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল, বিশালাকারের বহু দেবালয়ও ছিল তার তালিকায়। এই মল্লেশ্বর মন্দিরও তার একটি।
১৮৩১ খ্রি. কীর্তিচন্দ্রের প্রপৌত্র মহারাজ তেজচন্দ্র চন্দ্রকোণার ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরগুলি পুনর্নির্মাণ এবং সংস্কার করেছিলেন। সেসময় এই মন্দিরেরও সংস্কার করে দিয়েছিলেন তিনি। সংস্কৃত এবং বাংলায় লেখা দুটি জীর্ণ সংস্কারলিপিতে এই ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছিল। ঠাকুরবাড়ির মূল প্রবেশদ্বারের মাথায় লিপিগুলি দেখা যায়। সংস্কৃত লিপি দিয়ে ভারাক্রান্ত না করে, বাংলা লিপিটি এখানে দেওয়া যেতে পারে– ” মল্লেশ মন্দির নাট্যমন্দির প্রাচীন। ধনগৃহ পাকগৃহ সিদ্ধ পুস্করিণীর।।
পঙ্কোদ্ধার শ্রীশ্রীস্বরূপ নারায়ণাগার। জপস্থান দ্বারপাল গৃহ পুনর্ব্বার।। উজ্জ্বল করিলা মোহারাজাধিরাজেন্দ্র। শ্রীলবর্দ্ধমানধীপ নৃপ তেজচন্দ্র।। শকাব্দা সতর শত তিপ্যান্ন আস্মিন। ব্রহ্মপক্ষে অংক্য করে লভে শুভদিন।। সন ১২৩৮ “। সমীক্ষা সহযোগী : সর্বশ্রী গনেশ চন্দ্র দাস– চন্দ্রকোণা। পার্থ দে– তমলুক। শোভন মাইতি– কলকাতা।যাওয়া-আসা : মেদিনীপুর শহর, চন্দ্রকোণা রোড স্টেশন থেকে সরাসরি, কিংবা পাঁশকুড়া থেকে ঘাটাল হয়ে, চন্দ্রকোনা পৌঁছানো যাবে। প্রচ্ছদ -রামকৃষ্ণ দাস