ডঃ নারায়ণচন্দ্র রানা :এক আলোকবর্তিকা -২ অনিন্দিতা মাইতি নন্দী
না ফেরার দেশে
১৯৬৯ সাল, বোর্ডের পরীক্ষায় ‘সাউরী ভোলানাথ বিদ্যালয়’ -এর জয় জয়কার, ‘নারাণ’ রাজ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় সারা গ্রামকে চমকে দিয়েছিলেন। সারা ‘সাউরী’ গ্রাম সেদিন আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছিল। বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি, পরের দিন কলকাতার নামী সাংবাদিক ফটোগ্রাফারদের আগমনে।এবার যাত্রারম্ভ প্রেসিডেন্সি কলেজে, পদার্থ বিদ্যায় অনার্স। সাউরী স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক মহাশয়, শ্রীযুত শ্রীনিবাস নন্দ পড়াশুনোর আর্থিক দায়ভার বহন করেন এই কলেজ জীবনের। ‘নারাণ’ রয়ে গেলেন বেলঘোরিয়া রামকৃষ্ণ মিশনে মহারাজের আশ্রয়ে। তাঁদের সমৃদ্ধ লাইব্রেরী ছিল ‘নারাণ’ এর সারা জগৎ। কথায় কথায় একবার এই সাউরী স্কুলের প্রধান শিক্ষক মহাশয়কে নারাণ বলেন, “স্যার, আমি একটা অনার্স কেন ৩টা বিষয়ে অনার্স নিয়ে প্রথম বিভাগে পাশ করতে পারি।”
পদার্থবিদ্যার সাথে বিষয় হিসাবে গণিত এবং ভূতত্ব (Geology) সমন্বয়কারী বিষয় নিয়েছিলেন ডঃ রানা। অত্যন্ত প্রখর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন তিনি। কলেজে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন অধ্যাপক অমল কুমার রায়চৌধুরীকে। পরবর্তীকালে অধ্যাপক হিসেবে চঞ্চল মজুমদার, কার্তিকচন্দ্র দাস ও নিত্য রঞ্জন পান মহাশয়দের শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন তিনি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে এম.এস.সি. উত্তীর্ন হন। এখানেই তিনি Practical -এ অধ্যাপক নিত্যরঞ্জন পানের কাছে সমস্ত Practical যেন পৃথিবীতে প্রথম করছেন এমন ভাবেই করতেন।M. Sc. করা কালীন ডঃ রানার শারীরিক অসুস্থতা ক্রমশই বাড়তে থাকে, চিকিৎসা চলে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ Dr. R N Chatterjee তত্বাবধানে।
এবার গন্তব্যস্থল মুম্বাই। TIFR এর পরীক্ষা দিতে পাড়ি দিলেন বোম্বাই (মুম্বাই), পরীক্ষক ছিলেন ডঃ জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার।১৭ জন ছাত্রকে নির্বাচন করা হয় ২৫৬ জনের মধ্যে, ডঃ রানা সেখানে প্রথম নির্বাচিত ছাত্র। ১৯৭৭ সালে অধ্যাপক বিজ্ঞানী নারলিকার এর তত্বাবধানে গবেষক হিসাবে যোগদান করেন, বিষয় ছিল ‘Cosmic Micro-wave Radiation’।তাঁর জ্যোতিপদার্থবিদ্যার গবেষণা পাত্রের শিরোনাম এন ইনভেস্টিগেশন অফ টি প্রপার্টিজ অফ ইন্টার গ্যালাকটিক ডাস্ট (An Investigation of the Properties of intergalactic Dust) – যা তাঁকে Distribution of Chemical Elements in the Universe নিয়ে পড়তে আগ্রহী করে তোলে।
তাঁর গবেষণার কিছু বাধা সৃষ্টি করে তাঁর শারীরিক অসুস্থতা। অত্যন্ত বড় মাপের হার্ট এটাক হয় ১৯৭৮ সালে, শেষ অব্দি TIFR এর সহায়তায় সম্পূর্ণ করেন Ph.D. ১৯৮১ সালে। তাঁর এই গবেষণা ‘বিগ ব্যাংগ তত্ব’ অর্থাৎ প্রায় ১৫০০ কটি বছর আগে মহাবিস্ফোরণে বিশ্ব সৃষ্টি হবার ঠিক পরের কয়েক সেকেন্ড অবয়বহীন মহাশক্তিপুঞ্জ থেকে কিভাবে আদি দুই মৌল হাইড্রোজেন এবং হিলিমাম তৈরী সম্ভব হলো তার উপরে নতুন ভাবে আলোকপাত করে।
১৯৮৩ সালে ডঃ রাণার এই কাজ শ্রেষ্ঠ গবেষণার সম্মান “Geeta Udgonkar Medal” পুরস্কারে ভূষিত হয়। ঐ বছরই TIFR এ তাঁর গবেষণা জীবনের একটি বড় পুরস্কার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেয়- তিনি রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার ‘Best Young Scientist Award’ পান INSA থেকে (Indian National Science Academy) তাঁর একটি অসামান্য গবেষণা পত্র ‘রেলিকস অফ টি আর্লি ইউনিভার্স’। ডঃ রানা থামতে জানেন না, তিনি ‘সুদূরের পিয়াসী’ – শুধু জীবন মানে বাঁচা নয়, সুন্দরভাবে বাঁচতে শেখা। জীবন মানে তাঁর কাছে – ‘A way of life’. এবার এসেছে সুদূর বিদেশের আহ্বান দিতে হবে পাড়ি – ইংল্যান্ড গন্তব্যস্থল। “Post Doctoral Fellowship (PDF)” গবেষণার হাতছানি।
ডঃ রানা চললেন বিদেশ ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে Prof.Arnold Wolfdale এর তত্বাবধানে “Post Doctoral Fellow” হিসেবে, এখানে “Chemical Evolution of Our Galaxy” এর উপর ১০টি অতি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ লেখেন, দুটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন ডঃ রাণা।
“Time travels in drivers passes with driver paces I’ll tell you who time ambles withal, who time trofs withal, who time gallops withal and who he stands still withal” –
প্রখ্যাতকবি Shakespeare এর line গুলি – সময় কারো কাছে সহজ চলে, আবার কারো কাছে সেই সময়ই আস্তে চলে, থমকে দাঁড়ায়, খুঁটিয়ে চলে। – ডঃ রাণার কাছে সময় বড্ড মূল্যবান, এক একটি অমূল্য মুহূর্ত জানান দিয়ে যায় শারীরিক অসুস্থতার তীব্রতা। তবু তিনি বেগবান।
Prof. Arnold আবার হয়ে যান ডঃ রাণার পান্ডিত্যের গভীরতায়, শারীরিক প্রতিকূলতার কথা ভেবে ডঃ রাণা কে ground floor এ আলাদা ঘর সহ লাইব্রেরী ব্যবস্থা কথা হয়। এই সময় দুটি পুরস্কার পান “Common Wealth’ Bursary Award” ও “SERC Fellowship”. ডঃ রাণার মত অনুসারে, “Through most Astrophysicists Thought much of The Universe was made of exotic Particles in the form of invisible of so called ‘dark matter’ – all of that in the immediate neighbourhood of the sun could be in the form of non-luminous stars.” -এই মতবাদের জন্য ডঃ রানা সারা পৃথিবীতে সপ্তম স্থান অধিকার করেন।
এরপর দেশে ফিরে ১৯৮৫ তে আবার TIFR এ যোগদান করে রিসার্চ এসোসিয়েট হিসাবে, পরে Reader হন। একের পর এক গবেষণপত্র (প্রায় ৭০টি) এবং বই রচনা করতে থাকেন। অবশেষে গুরু ডঃ নালিকারের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান Inter University Centre for Astronomy and Astrophysics (IUCAA) -যোগদান করেন, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এখানেই অধ্যাপনা ও গবেষণার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। IUCAA তে থাকাকালীন শারীরিক সমস্যার জন্য একটু দেরীতে উঠলেও নিয়মিত আহ্নিকে বসতেন। রামকৃষ্ণদেবের মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন বেলুড়মঠে। আসলে ডঃ রাণা ছাত্রজীবনের প্রথমার্ধেই গীতা, রামায়ন, মহাভারত কণ্ঠস্থ করে নিয়েছিলেন। বৈদিকমন্ত্র নিয়মিত উচ্চারণ করতেন। কথিত আছে যে এক একটি বৈদিক শব্দ উচ্চারিত হলে মানুষের মনে ও চিন্তায় অনুরূপ অনুসরণ হয়। উচ্চারণকালে শ্লোকগুলি এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় যে স্নায়ুকেন্দ্রাগুলিতে একটি সুন্দর আবেগ উৎপত্তি হয়।
ডঃ রাণার স্বল্পায়ু জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শেষ কাজ হল সূর্যের সঠিক ব্যাস নির্ণয়। আসলে “কোন কিছু প্রমাণিত হয়েছে বলেই তাকে মেনে নিতে হবে, এরকম বিধান মানুষের আত্মার পক্ষে ক্ষতিকারক” -এ যেন গ্যালিলিও নন ডঃ রাণার মনের কথা।১৯৯৫ সাল, অক্টোবর মাস – প্রায় ২০০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন ডঃ রাণা। দিল্লী জয়পুর সড়কে প্রায় আট কিলোমিটার জুড়ে রয়েছেন তাঁরা সাথে নিজেদের তৈরী প্রায় ৪০০ শত ফটো ডিটেক্টর যন্ত্রের সাহায্যে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের নিখুঁত গ্যাস নির্ণয়ের প্রচেষ্ঠায়। ২৪ শে অক্টোবর, ১৯৯৫ তে অবশেষে তাঁর পরিশ্রম সার্থক হয়। তিনি প্রথম একজন ভারতীয় জ্যোতিঃপদার্থ বিজ্ঞানী যিনি সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে নতুন ভাবে সূর্যের নির্ভুল ব্যাস পরিমাপ করেন এবং Astrophysicist Mr. Es Panck ও Mr. Fiala -এর তত্বকে ভুল প্রমান করতে পেরেছিলেন। ওনার মতে, “Our tentative value for the measurement of the Physical radius of the Sun at 3.02 hour UTC on October 24, 1995 may be placed as 6,96,500 k.m.”
“ডঃ রাণা বলেন, এই সূর্যগ্রহণের সময় চাঁদের ছায়া ভারতের ওপর দিয়ে প্রায় ৫৫০০ কিলোমিটার বেগে চলে গেছে, তাই ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এর সাথে কথা বলে তিনি রাজি করান ভারতীয় বিমান বাহিনীর দুটি বিমানকে, যারা পৃথিবীপৃষ্ঠের উপর দিয়ে চলে যাওয়া চাঁদের ছায়াকে অনুসরণ করবে, আর এই সময় তারা যে তথ্য পাবে তা ডঃ রানা সংগ্রহ করবেন, প্রস্তুতিপর্ব হিসাবে পরবর্তী সূর্যগ্রহণের জন্য। কিন্তু ভাগ্য লিখন বোধহয় আড়ালে হেসেছিল কারণ এই তরুণ জ্যোতির্বিজ্ঞানী জটিল হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন যা ডাক্তারি পরিভাষায়, “Idiophathic Hypertrotic Subaoric Stenosis with complete left, Bunde Branch Block.”
অদম্য লড়াকু বিজ্ঞানী ডঃ রানা বলেছিলেন তাঁর স্কুল জীবনের শিক্ষকদের কাছে, “স্যার আমি যদি আরো ৪-৫ বছর টিকে থাকতে পারি তাহলে নোবেল লোরিয়েটদের টনক নড়িয়ে দিয়ে যাবো।” সময় পেলেন না – সময় দিলেন না ঈশ্বর – এ যেন বিশ্বকবির সেই বাণী –
‘ফুরাইলে দিবসের পালা
আকাশ সূর্যের জপে
লয়ে তারকার জপমালা।’
‘সাউরী’র ভাগ্যাকাশে হলো নক্ষত্র পতন। ২২শে আগস্ট ১৯৯৬ তে মহানিদ্রায় চিরনিদ্রার দেশে এই তরুণ বিজ্ঞানী মহাকাশ পথে চলেছেন নীহারিকা মন্ডলে, ছায়াপথের সন্ধানে মহাবিশ্বের মহাকাশে – “আপনারে বিস্তারিয়া ঢাকি বিশ্বভূমি, সুস্নিগ্ধ আঁধারে।”
Reference (তথ্য সূত্র):
১. ‘ডঃ নারায়ণ চন্দ্র রানা’র ভাই শ্রীযুত সুজন কান্ত রানা এর সাক্ষাৎকার।
২. প্রবন্ধ: ডঃ নারায়ণ চন্দ্র রানা, বঙ্কিম বিহারী মাইতি।
৩.মেদিনীপুরের বিশ্বজয়ী ডঃ নারায়ণ চন্দ্র রানা-বাদল চন্দ্র দে।