Homeএখন খবরখড়গপুরকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন 'আন টোল্ড স্টোরি 'র নায়ক সুশান্ত সিংহ রাজপুত

খড়গপুরকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন ‘আন টোল্ড স্টোরি ‘র নায়ক সুশান্ত সিংহ রাজপুত

নরেশ জানা: খবরটা শুনেই চায়ের কেটলিটা হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল টমাসের। সাউথ ইনস্টিটিউটের সামনে ভারতীয় ক্রিকেটের অধিনায়ক ধোনির বদান্যতায় এই চায়ের দোকানটা সাজিয়ে দিয়েছে খড়গপুর রেল। না দিয়ে উপায় নেই, রেলের টিকিট চেকারের দায়িত্ব সামলে টমাসের দোকানেই পাউরুটি আর ঘুগনি সাঁটিয়ে পেছনের সেরসা স্টেডিয়ামে গিয়ে ছক্কা হাঁকাতেন ধোনি। আকাশ ছুঁয়েও ধোনি ভুলে যাননি টমাসকে। রেলকে বলেই করিয়ে দিয়েছিলেন এই স্পোর্টস লিজেন্ট দোস্তি ক্যান্টিন। সবে লকডাউনের ধকল কাটিয়ে খুলেছে ক্যান্টিন, রবিবার দুপুর দুটো নাগাদ খবরটা এসে পৌছালো, আর তখুনি হাতটা কেঁপে গেল টমাসের। মাত্র কয়েকটা বছর আগে সুশান্ত সিংহ রাজপুত যে এই সেরসা স্টেডিয়ামেই শ্যুটিং করে গেল!২০১৫ র জুন মাসের ১৮তারিখ পাক্কা টি.টির বেশেই খড়গপুর রেল স্টেশন থেকে ধোনির মতই প্র্যাকটিসের শ্যুটিংয়ে সেরসা স্টেডিয়ামে চলে এলেন সুশান্ত। বন্দুক খানা হয়ে আ্যডিশনাল এসপি খড়গপুর আর রেলওয়ে পুলিশ সুপারের বাংলো পেরিয়ে দাঁড়ালেন, টমাসের চায়ের দোকানের সামনে। টমাস বলছেন, “আরে ভাই ম্যায় তো চৌক গিয়া, পাক্কা ধোনি জ্যায়সা। ঠিক উসি তরহা লম্বা লম্বা বাল আর চিকনা বদন! কসম সে, ম্যায়না শোচা ফির ধোনি কা ডিউটি গিরা ইধার। তো উননে আয়া, বাত চিত হুয়া, তভি মেরে কো পাতা চলা কি ইয়ে মুম্বাই বালা ওহি আ্যকটর হ্যায় জো কি ধোনি কা রোল নিভায় গা।”(আরে ভাই আমি তো চমকে গেছিলাম, অবিকল ধোনির মত দেখতে। ওরকমই লম্বা লম্বা চুল আর রোগাটে গড়ন। আমি ভাবলাম ধোনি বোধহয় আবার খড়গপুরেই চাকরি করতে ফিরে এল। উনি এলেন আমার কাছে, কথাবার্তা বললেন আর তখুনি জানলাম ধোনির ওপর যে সিনেমাটা হচ্ছে তাতে ধোনির ভূমিকায় এই মুম্বাইয়ের অভিনেতাই অভিনয় করবেন।)

পাক্কা ২মাস আইআইটির গেস্ট হাউসে ছিলেন সুশান্ত সিংহ রাজপুত। ধোনির প্রিয় বন্ধু দীপক সিং এর সত্যপ্রকাশদের। সাথে শ্যুটিংয়ের ফাঁকে আড্ডা দিয়েছেন। দীপক সিং জানালেন, ” শ্যুটিংয়ের শেষে কোনও কোনও চলে যেতাম খড়গপুর সাউথ সাইডের একটা ফুচকা দোকানে। খুব ফুচকা খেতে ভাল বসতেন সুশান্ত।” সেদিনের স্মৃতি মনে করতে গিয়ে দীপক জানাল, “একদিন রাত ১১টার সময় আইআইটির গেস্ট হাউস থেকে ফোন করল সুশান্ত । বলল, ” খুব জিম করতে ইচ্ছা করছে কোথাও খোলা পাওয়া যাবে জিম। সেই রাতে কৌশল্যার এক বন্ধুকে বলে জিম খুলিয়ে সুশান্তকে নিয়ে এলাম জিম করাতে।”

ধোনির বায়োপিক করার কথা মাথায় আসতেই পরিচালক নিরজ পান্ডে খড়গপুরের কথা ভেবেছিলেন আগে। সেই খড়গপুর যে খড়গপুরের মাটিতে ধোনিকে ধোনি করে গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তৎকালীন ডিআরএম অনিমেষ গাঙ্গুলি। নিরজ পান্ডে সেই খড়গপুরের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা যেখানে যেখানে ধোনি পা রেখেছিলেন সেখান দিয়ে হাঁটিয়েছেন সুশান্ত সিংহ রাজপুতকে। আগস্ট নাগাদ শ্যুটিংয়ের শেষ পর্যায়, খড়গপুর স্টেশনের ২নম্বর প্ল্যাটফর্মের সাবওয়ে ঘেঁষে ৩ আর ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে যেখানে ধোনির ডিউটি পড়ত ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে সুশান্ত পোজ দিলেন, ঘড়িতে ১০টা বেজে গেছে ধোনির মতই সুশান্ত এবার দৌড়াবেন স্টেডিয়ামের দিকে। সেখানে অনিমেষ গাঙ্গুলি হাতে বল নিয়ে অপেক্ষা করছেন। ট্রলিতে ক্যামেরা রোল, চোখ রেখে দেখছেন নিরজ পান্ডে। তার আগে, তখনও ৭ আর ৮নম্বর প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়নি খড়গপুরে। ফাঁকা জায়গায় একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন এনে মহড়া হয়ে গেছে সুশান্তের।

স্টেশন থেকে সেরসা স্টেডিয়াম যাওয়ার রাস্তায় ভিড় জমে গেছে। সেরসা স্টেডিয়ামের সামনে জনতার ভিড় টপকে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছেন তখন ইটিভির সাংবাদিক শঙ্কর রাই আমরা যাকে বিল্লি বলে ডাকি, ওপাশে প্রতিদিন আর দ্য টেলিগ্রাফের চিত্র গ্রাহক সৈকত সাঁতরা, সুশান্তের একটা শট পাওয়ার অপেক্ষায়। সুশান্তের বাউন্সারদের সাথে তুমুল ধস্তাধস্তি। আমি আরও দুরে দাঁড়িয়ে মজা দেখছি। নিরজ নিজে এসে হাত জড়ো করে বললেন, আমি কথা দিচ্ছি, “ইন্টারভিউ করিয়ে দেব। পরে আসুন।” শর্ত ছিল একাই যেতে হবে। সেই মত রাতে আইআইটি গেষ্ট হাউসে গিয়ে ইন্টারভিউ নিতে গেলাম। কিন্ত দুর্ভাগ্য সেদিনই জ্বরে কাঁপছেন সুশান্ত। দু-চারটে মামুলি কথা বলে হাত মিলিয়ে বিদায় নিলেন নিজের রুমে, সত্যি সে হাত পুড়ে যাচ্ছিল।    সেদিনের সেই ২৯বছরের সুশান্তের করতলের আগুন এখনও যেন আমার হাতের তালুতে লেগে!    যদিও এর আগে এই গেষ্ট হাউসে বসেই ভারতীয় ক্রিকেটের কিংবদন্তি আজহারউদ্দিনের ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম যা আমার তখনকার কাগজ দ্য টেলিগ্রাফ বড় করে ছেপেছিল।

কী আশ্চর্য! সেটাও জুন মাস! আজ রবিবার, ১৪ই জুন ঠিক চার দিনের মাথায় ১৮ই জুন। আজ বৃষ্টি হচ্ছে খড়গপুরে। তুমুল বৃষ্টি ছুঁয়ে যাচ্ছে সেরসা স্টেডিয়াম, গোলখুলির দুর্গা মন্দির, যার পাশের কোয়ার্টারে ধোনি থাকতেন, ক্রিশ্চান কবরখানার পেছনের মাঠ আর বিএনআর গ্রাউন্ড যেখানে যেখানে ধোনি ক্রিকেট খেলে গেছিলেন সব, সব জায়গা ছুঁয়ে গেছিলেন সুশান্ত। খড়গপুর-ধোনি-সুশান্ত মিলে মিশে একাকার। খড়গপুর যেমন ধোনিকে দিয়েছে, ধোনিও খড়গপুরকে দিয়েছেন। আর এই খড়গপুর আর ধোনিকে দেশের আমজনতার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন সুশান্ত। সেই সুশান্ত সিং রাজপুত নেই খবরটা পেয়ে শুধু টমাসের হাতের কেটলি নয়, গোটা খড়গপুরের হৃদয় কেঁপে গেছে। বৃষ্টি হচ্ছে খড়গপুরে, তুমুল বৃষ্টি, না হলে ঠিক বোঝা যেত খড়গপুর কাঁদছে। যে কান্না ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে, সেই বৃষ্টির জল। খড়গপুর  চাইছে আবার খড়গপুরে আরও একটা বায়োপিক হোক যার চরিত্র হবেন সুশান্ত সিংহ রাজপুত।

RELATED ARTICLES

Most Popular