মকর অনুসঙ্গে ( সে এক পুরা কালের কাহিনী )
শুভঙ্কর দত্ত
সকাল বেলায় ঘুম ভাঙত ঢেঁকির পাড় ভাঙার শব্দে।ঘুমভাঙা বাতাসে চালের সুগন্ধি আঘ্রাণ। গোয়াল ঘরের পাশে ঢেঁকিশালে প্রতিবেশী ঠাকুমা জ্যেঠিমা কাকিমা দের ভিড়। বয়স্কা ঠাকুমা হাঁক দেন, কই লো বউ এখনো চা দিলিস নাই যে। মা শশব্যস্তে উত্তর দেন,এই যে যাই জ্যেঠিমা । হঁ, জলদি আন | তোদের আজকালকার বউদের কুনো দিশা নাই | তোর ব্যাটার হাতে টুকু দোক্তা চুন পাঠাবি লো বউ | আর তোকে এখন চাল কুটতে হবেক নাই | দুপরে তখন আস্যে তোর বেটার ঘরের গুলা কুটে দিয়্যে যাব |
চাউড়ির দিনে ছোটো ছোটো পায়ে ঢেঁকি শালের দিকে গিয়ে এককোনে বসে থাকতাম আমরা | ভাই বোনেরা | সুগন্ধী আতপের গন্ধে বিভোর ছোটো ছোটো হাত বাড়িয়ে মুখে পুরতাম আধভেজা চাল গুলো | সস্নেহ তিরস্কার ভেসে আসত, কাঁচা চাল গুলান খাস নাই বাপ, পেট কামড়াবেক | সেধারকে বোস ।এঁঠা ঝুঠা করিস না। গুটি গুটি পায়ে এসে অচেনা ঠাকুমা কে বলতাম , ও ঠাকুমা একটা গান কর না । ঠাকুমা একগাল হেসে বলতেন, সে বয়স কি আর আছে বাপ। ঢেঁকিশাল থেকে আওয়াজ আসত, হঁ হঁ দিদি , গাও না দু -এক খান।
দড়ির খাটিয়ায় বসে বুড়ি ঠাকুমা গান ধরত
…পুখর আড়ায় ঘর করেছি ধেকের পেকের করে লো…
কাল আন্যেছি পরের ঝি কে পাছে ডুবে মরে লো…। ইসব লয়, ই সব লয় । বুড়ি ফোকলা হাসে , তা রসের গান কি এখন জইমবেক… আঁধার নামুক, খেজুর গাছের রস ঘন হোক ,যুবতী বউদের বুক টনটনাক তবে তো রসে মজবি …।পিচিত করে পিক ফেলে বুড়ি । আচ্ছা এখন দুএকটা গাও না… ‘…ফুল ফুট্যেছে গাছের মাঝখানে
কত ভ্রমর আস্যে গুণ-গুণে….।
বলি, শুনছু লো,
ফুল ফুট্যেছে গাছের মাঝখানে…’
একটার পর একটা গান গেয়ে চলে বুড়ি ঠাকুমা | ‘….বিহা করে একি দায় হল্য
বরং আইবুড়ো তে ভাল ছিল
বিহা করা বিরাট জ্বালা তোমরা সবাই বল
যে করেছ্যে সেই বুঝেছ্যে নাই করা উচিত ছিল্য
বিহা করে একি দায় হল্য….’
বউ ঝি রা ঢেঁকি শাল থেকে বেরিয়ে আসে | মুখে আঁচল চাপা দেয় |আরো কত গান | তখন সেসব বোঝার বয়স নয় | বোঝার চেষ্টাও ছিল না | শুধু গানের সুর, মা-কাকিমা -জ্যেঠিমা দের খিল খিল হাসি তে, তাঁদের সারা শরীরে অনাবিল আনন্দের ছটায় আমরাও ভরে উঠতাম |মুড়ি আর পাকুড়ি খেতে খেতে কখনো সখনো এক জ্যেঠিমা গলা তুলে বলে উঠত, একটা লঙ্কা পুড়িয়ে দিবিস তো বউ |
কাঁসার ঘটি তে ছোপ ছোপ দাগ দেখে এক কাকিমা এগিয়ে আসত হঠাৎ ,দে দে একটুকুন তেঁতুল দে তো বউ, ঘটি টা মেজে দিই | পাড়া-বেপাড়া, আত্মীয় -অনাত্মীয় , ধনী-দরিদ্র, এক সহজ সরল অধিকারবোধ, অনাবিল স্বার্থশূন্য সম্পর্কের এক সংজ্ঞাহীন বন্ধনে বাঁধা ছিল সবাই |
চাউড়ি বাউড়ি দুদিনই ঘর জমজমাট | বীনা পিসি একবস্তা মুড়ি ভেজে দিয়ে গিয়েছিল | শেষ | এবার কেদার জ্যেঠুর দোকান ভরসা | বাউড়ির দিনসকাল থেকেই ব্যস্ততা চরমে | বাজার হাটে ভিড় | রাস্তাতেও | এদিকে ঢেঁকির দখল কেউ ছাড়বে না | যে দু চার ঘরে এখনো ঢেঁকি আছে সেখানে আগের থেকেই লম্বা লাইন | অগত্যা চাল নিয়ে যাওয়া মেশিনে কুটতে | মেশিনের গুঁড়ি তে কি আর ভালো পিঠা হয় !
নতুন সরা,কুলা, ঝুড়ি, টুসু ঠাকুর কিনে মাথায় চাপিয়ে ঘরে মুখো হওয়া | বাবাও কিনে আনত টুসু | গোবর নিকানো তুলসী তলায় পাতা হত টুসুর আসন | চাল গুঁড়ির আলপনা, নতুন ধান আর দুর্বাঘাস দিয়ে আসন সাজিয়ে দিত বুড়ি বড়মা | আকন্দ , গেঁদা ফুল আর হলুদ কাপড়ে সাজত টুসু খুব করে | দুপুর থেকেই ব্যস্ততা চরমে | পিঠের পুর তৈরী ,গরম জলে গুঁড়ি মেখে ভেজা কাপড় জড়িয়ে রাখা ,আরো কত কি |
সন্ধ্যা বেলা শাঁখের আওয়াজের প্রায় সাথে সাথেই প্রথম পিঠের চড়া টা নামলে তুলসী তলায়, টুসুর থানে আর কুলায় করে গোয়ালে গরু দের মুখে তুলে দেবার পর আমাদের ডাক পড়ত | এরপর পাড়ার বাড়ীতে বাড়ীতে পিঠে বিলি করার পালা | বাবার বন্ধু রা সব আসত | গল্প গুজব শেষ করে উঠবার সময় মা এসে বলত, আর একটু বসে যান | দুধ পিঠেটা এখনো হয়নি | ততক্ষণ এই পোস্তর পিঠে গুলো একটু খেতে থাকুন |
রাত দশটার সময় হঠাৎ মনে পড়ত ইসস্ , সতীশ দাদুর বাড়ীতে তো পিঠে পাঠানো হয়নি ! মা কাঁচুমাঁচু মুখে বাবাকে বলত, একবার সতীশ জ্যাঠার বাড়ীতে যাবে ? এত রাতে কাকে আর বলি ? তখনকার ঘন ঘন লোডশেডিং এর দিনে দু -একবার পিঠেতে কেরোসিনের গন্ধও মিশে থাকত | বুড়ি বড়মা হারিকেন টা জ্বালিয়েই পিঠে করতে বসে গিয়েছিল যে ! সেগুলো সরিয়ে রাখা হত | পরের দিন তেল মশলা দিয়ে ভেজে নিলেই সব গন্ধ উধাও |
তখন মাইকের রমরমা নেই | ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে সারা রাত ধরে সমবেত স্বরে গেয়ে চলা টুসু জাগরণ গীত শুনতে শুনতে কখন চোখ বন্ধ হয়ে যেত | গভীর রাতে মা কখন শুতে আসত কোন দিন ই জানতে পারিনি | পরের দিন সকাল হতে না হতেই সবাই চলত মকর সিনানে | মেয়ে বউ রা সব হেঁটে | দুএকটি সম্পন্ন পরিবার গরুর গাড়ীতে | আর যাদের সাইকেল আছে , তাদের কথা আলাদা |
মাথায় টুসু ঠাকুর | মুখে গান | হাতের ঝোলায় কালকের বানানো পিঠে আর নতুন জামা কাপড় | মকরডুব দিয়ে নতুন জামা কাপড় পরতে হয় যে ! যাবার সময় মা কে দেখতে পেলে দু একজন কাছে এসে, ও বউ মুখটা খুল , বলে একটা পিঠে জোর করে খাইয়ে দিয়ে যেত | দাঁড়ান দিদি, বলে , মা ও কতকগুলো পিঠে ঠোঙায় করে তুলে দিত তাদের হাতে | খাবেন দিদি | আমি তো ঠিক বানাতে পারি না | অল্প চেনা মুখ রগড় করে – ‘… পিঠা লিব নাগো তোর সনে
শাড়ি লিব গো দেখে শুনে
চাকরি দিদিমনির সনে…’
ও বউ , আমদের সঙ্গে একবার চ না মকর সিনানে, দমে মজা হবেক | মা হাসে | বেলা বাড়তে থাকে | রোদের মিষ্টি আমেজে টুসু সমস্ত রাস্তা পাক খেতে খেতে এগিয়ে চলে |টুসু গানে বন্দী থাকে সমস্ত চরাচর |
আমরা বায়না করি নদী যাব | বহু আবেদন নিবেদনের পর অনুমতি মেলে | আর পঞ্চাশ পয়সা মাত্র |দড়ির খাটিয়ায় পুরানো খবর কাগজের উপর রাখা মকরমেলার ধুলো মাখা গুড়ের শুঁটির সে কি স্বাদ! একপাশে মুরগী লড়াই অন্য দিকে মিনি ফুটবল | একদিকে জুয়ার আড্ডা অন্যদিকে হাড়িয়ার ঠেক |
মাঝে দুই গ্রামের বউ -ঝি দের মধ্যে ঝগড়া লেগেছে | টুসু গানের সুরেই তার চাপান উতোর চলছে | চট জলদি সুরে কথা বসিয়ে আদরিণী টুসুকে সাক্ষী রেখেই চলছে বাদানুবাদ | দৈহিক বিভঙ্গ আর আদিরসাত্মক অশ্লীল শব্দবন্ধে তরজা বেশ জমজমাট | ফচকে ছোঁড়ারা কুলকুলি দেয় | দুই গ্রাম এক হয়ে তীক্ষ্ণ বাক্যবানে বিঁধতে থাকে বেধামড়া – খালভরা দের | ছোঁড়ারা পালিয়ে যাবার পথ পায় না |
সুয্যিমামা কান্ত শরীরে পশ্চিমে ঢুলতে থাকে |চড়া রোদ গায়ে মেখে বুক ভরা অম্বল আর ধুলো মাখা শরীরে লাল চোখে বাড়ী ফেরার পথে তখন মন খারাপের গান | ‘…টুসুকে মোদের দিয়ে আলম কাঁসাই লদীর জলে গো
বছর দিনে আসবি টুসু ঘরকে আলো করবি গো….’
রাত বাড়লে কাঠের উনুনের পাশে বসে মাটির সরায় তৈরী একটা একটা করে আস্কে পিঠে তৈরী করে বড়মা |পিতলের হাঁড়িতে মরা আঁচে বসানো ঘন খেজুর গুড়ের পায়েস হাতা দিয়ে ক্রমাগত নেড়ে চলে মা | আর আঁচল দিয়ে চোখটা ক্রমাগত মুছে নিতে থাকে | এবার ও পৌষ সংক্রান্তি তে মামাবাড়ী যাওয়া হল না মায়ের | সেদিকে একবার দেখে নিয়ে খেতে খেতে বাবা বলে, কাল কে আখান যাত্রা | তোর দাদু আসবে | পিঠে তো হবেই | এবং চালের রুটি আরহাঁস মাংস | কি বল | মা বাবার থালায় আর একটা পিঠে তুলে দিতে দিতে বলে , কাল তাহলে দুটো নারকেল এনে দিও | বাবা নারকেলের পিঠে ভালোবাসে | বাবা হাসতে হাসতে বলে, ‘আমোদ হল না মকর দিনে
বাপের ঘরে আসবে বলে
ধোঁকা দিল এই দিনে
আমোদ হল না মকর দিনে
আর কি হবে কালকে এলে
আমার গিন্নি ভাসেন চোখের জলে
এখন ভুলাই তারে কেমনে
এখন ভুলাই তারে কেমনে….’
খড়ের চালার নীচে কালিপড়া হারিকেনের মৃদু আলোয় সুর কাঁপন লাগায় | মায়ের আগুনে রাঙা মুখ আরো রাঙা হয়ে ওঠে |
যাই, গরুগুলোকে একটু খড় দিয়ে আসি, বলে মা তড়িঘড়ি উঠে চলে যায় | বাবা হো হো করে হেসে ওঠে | বিছানাতে বাবার পাশে শুয়ে শুয়ে গভীর রাত পর্যন্ত আমরা চোখ বড়বড় করে শুনতে থাকি পুষ্যা নক্ষত্র , তিষ্যা – তুষ্টু- তুষু- টুসুরাণীর কথা ও কাহিনী | রাত বাড়ে | মা দরজায় আগল দেয় |