বালিপাল গ্রাম ও সাবিত্রী মন্দিরের ইতিহাস। উপেন পাত্র
ঝাড়গ্রামের সাবিত্রী মন্দির নিয়ে নানা জনশ্রুতি, নানা লোককথা,নানা কল্পকথা প্রচলিত আছে।
এই বিষয়ে নানা মুনির নানা মত অর্থাৎ নানা গবেষকের নানা মতও আছে।এ সবের মধ্য থেকে প্রকৃত ইতিহাস খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।তবুও বাস্তবতার ছাঁকনিতে ছেঁকে কিছুটা সত্যের কাছাকাছি যাওয়া যেতে পারে।
অতীতে সুবর্ণরেখা তীর থেকে কাঁসাই তীর পর্যন্ত এলাকা ছিল শ্বাপদসঙ্কুল ঘন অরণ্যে আবৃত। বিষ্ণুপুর ও ময়ুরভঞ্জের মধ্যবর্তী এই এলাকা ছিল প্রকৃতপক্ষে নো ম্যানস ল্যান্ড।
একদা বিরাট রাজকন্যার সাথে ময়ুরভঞ্জ রাজপুত্রের বিবাহ হয়।প্রথামত বিরাটরাজ নানা যৌতুকের সাথে কিছু গাভী ও গোরক্ষক সেনা দেন(গোরক্ষক থেকে গোর্খা কথাটি এসেছে কি না, তা ভাবার বিষয়)।ময়ুরভঞ্জরাজ ঐ সেনাদের কিছু জায়গির দেন।কিন্তু তারা ছিল দুদ্ধর্ষ প্রকৃতির, ফলে চাষবাসে মন না দিয়ে দস্যুবৃত্তি শুরু করে।জোরপূর্বক এদেশীয় আদিবাসী কন্যা হরণ ও বিবাহ করে।
এরা নিজেদের মল্ল/মাল বা পালোয়ান বলে পরিচয় দিতো।তাই মল্ল বা মাল নামে সংকর জাতির উদ্ভব হয়।এদের মধ্যে দস্যুসর্দার মনিমল দহতমলে(লোধাশুলির কাছে) ও রণমল ঝাড়গাঁয় তাদের ডেরা গড়ে।
অন্যদিকে জাজপুরের রাজা হরিকৃষ্ণদেব পাঠান আক্রমণে নিহত হওয়ায় রাজপুত্র সুরঙ্গদেব, তৎপত্নী ইন্দুমতী,রাজপুরোহিত গজপতি মিশ্র কন্যা শর্মিষ্ঠা সহ পালিয়ে এসে ময়ুরভঞ্জরাজের শরণাপন্ন হন।ময়ুরভঞ্জরাজ তাদের থাকার জন্য চিয়াড়া মহলের ডুলং নদীর তীরে গড়বন দুর্গে(বালিপাল গ্রামের কাছে)পাঠিয়ে দেন।ইন্দুমতীর সন্তানাদি না হওয়ায় তিনি পুরোহিত কন্যা শর্মিষ্ঠার সাথে সুরঙ্গদেবের বিবাহ প্রস্তাব দেন।
এদিকে দহতমলের মনিমল অতর্কিতে আক্রমণ করে শর্মিষ্ঠাকে হরণ করে।পরে সুরঙ্গদেব দহতমল আক্রমণ করে শর্মিষ্ঠাকে উদ্ধার ও বিবাহ করে। তাদের সাবিত্রী নামে এক কন্যাসন্তান হয়।এরপর দহতমল ও ঝাড়গাঁর দুই দস্যুসর্দার সম্মিলিত আক্রমণে সুরঙ্গদেবকে হত্যা করে সকন্যা শর্মিষ্ঠাকে হরণ করে নিয়ে যায়।শর্মিষ্ঠা আত্মহত্যা করায় সাবিত্রী মনিমলের কন্যারূপে পালিত হয়।
অতঃপর ওড়িশার রাজা কপিলেন্দ্রপাল বড় রাজকুমারকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করায় ছোট রাজকুমার বলবন্ত বিদ্রোহী হন।রাজা তাকে ত্যাজ্যপুত্র করায় সে কিছু অনুচর সহ ভাগ্য অন্বেষণে বেরিয়ে পড়ে।অরণ্যপথে বিচরণ করতে করতে তারা গড়বন দুর্গের কাছে আসে।এখানে বলবন্ত সাথীহারা হয়।ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে সে এক কেঁদ গাছের নীচে নিদ্রা যায়।নিদ্রান্তে সে কেঁদ গাছের ফল খেয়ে নবজীবন পায়।ইতিমধ্যে অনুচররা তাকে খুঁজে পায়।তারা পরিত্যক্ত গড়বন দুর্গে আশ্রয় নেয়।
বলবন্তপালের নাম থেকে গ্রামের নাম বালিপাল ও কেঁদগাছের নীচে বলবন্ত কুলদেবী প্রতিষ্ঠা করায় ঐ স্থানের নাম কেঁদুয়া থান হয়।
বলবন্ত ক্রমশ শক্তিবৃদ্ধি করে এবং দহতমলে মনিমলের ডেরা আক্রমণ করে সাবিত্রীকে হরণ ও বিবাহ করে।সাবিত্রী ও বলবন্তের একটি পুত্রসন্তান হয়,তার নাম রাখা হয় সর্বেশ্বর। প্রতিশোধ নেবার জন্য মনিমল ও রণমল একযোগে গড়বন আক্রমণের পরিকল্পনা করে।তা জানতে পেরে বলবন্ত একরাতের মধ্যে আগে দহতমল ও পরে ঝাড়গাঁ আক্রমণ করে দুই দস্যুসর্দারকে হত্যা করে এবং নিজেকে রাজা বলে ঘোষণা করে।বলবন্ত ও সাবিত্রীর সন্তান সর্বেশ্বর উগালষণ্ড মল্লদেব উপাধি নিয়ে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
মল্ল সর্দারদের হত্যায় মাল জাতির লোকেরা প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করে।কিন্তু রাজমাতা সাবিত্রীর তৎপরতা ও কূটবুদ্ধিতে তারা সংযত হয় এবং বলবন্ত ও সাবিত্রীকে তাদের কন্যা-জামাতা রূপে স্বীকার করে নেয়।
রাজমাতা সাবিত্রীর মৃত্যুর পর সর্বেশ্বর একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন।পরবর্তী কালে সাবিত্রী মন্দির নির্মিত হয় এবং কালক্রমে সাবিত্রী লৌকিক দেবীতে পরিণত হন।