নিত্য গুপ্ত: মাননীয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, আপনি চলে গেলেন! ৪০দিনের একটা অসম লড়াই, লড়াই বার্ধক্যের বিরুদ্ধে, লড়াই ক্ষয়ে যাওয়া প্রোস্টেটের বিরুদ্ধে, সর্বোপরি একটা নতুন, ভয়ঙ্কর অতিমারির বিরুদ্ধে। হ্যাঁ এই লড়াই আপনি জিততে পারেননি কিন্তু তাতে কী? কবে,কোথায়,কে সব লড়াই জিতেছে? আর জিততে হবেই বা কেন? লড়াইটাই যেখানে বড় কথা সেখানে হারা জেতা যে বড় মামুলি শব্দ! তাছাড়া এই যাওয়াটাই তো এক সময় অনিবার্য, যা সবাই জানে কিন্তু মানতে মারেনা অনেকেই। শুধু একটাই প্রশ্ন থেকে গেল, মার্জনা করে গেলেন তো?
আপনার কি মনে ছিল যে আপনার বিরুদ্ধে একটা মামলা করা হয়েছিল? দেশদ্রোহিতার মামলা! সেই আপনি, যে আপনি সারা জীবন ধরে দেশের জন্য, জাতির জন্য, প্রানভরা আলো ছড়িয়ে গেলেন, সেই আপনার বিরুদ্ধে একটা মামলা ঠোকা হয়েছিল। আপনারা ক’জন মিলে প্রধানমন্ত্রীকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। লিখেছিলেন, ঈশ্বরের নামে পিটিয়ে মারা বন্ধ হোক। বলেছিলেন, রামের নাম করে গনপিটুনি বন্ধ হোক। না, রামকে অপমান করেননি, প্রধানমন্ত্রীকেও অপমান করেননি। শুধু পিটিয়ে মারা কতগুলো অসহায় মানুষের হয়ে কেঁদেছিলেন, ব্যস! আপনার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা!
আপনি মার্জনা করে গেলেন কিনা জানিনা কিন্তু কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চ থেকে আপনাকে দুরে ঠেলে দেওয়ার অপরাধ বাঙালি করেছে। অন্ততঃ প্রতিবাদে তো মুখর হয়ে ওঠেনি। বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির ভীষ্ম, দ্রোন, কৃপাচার্য, কর্ন আদি রথী মহারথীরা শাসক তাম্বুল চর্বন করতে করতে দেব শূন্য সেই দেউল উপভোগ করেছে বিনা বাক্য ব্যয়ে! বিশ্বের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে মহিমান্বিত সেই চলচ্চিত্র উৎসব, যেখানে বিশ্বচলচ্চিত্র জগতের ঈশ্বররা আসেন সেই উৎসবে আপনি বয়কট!
সেই আপনি যাঁকে শুধু চলচ্চিত্রে অভিয়ের জন্যই বিশ্ব একাধিকবার পুরষ্কৃত করেছে। যাঁর হাত বিশ্ব পর্যবেক্ষণ করেছে ভারতীয় চলচ্চিত্রের ভিন্ন দুনিয়াকে, সেই আপনাকেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু টুঁ শব্দ করেনি সংস্কৃতির কুরুকুল। সেই অপরিসীম ক্লীবত্ব আপনাকে দংশন করেছিল কিনা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়না কিন্তু যাওয়ার আগে সেই ক্লীবত্বকে আপনি মার্জনা করে গেলেন তো?
আপনি নাকি এদেশকে একের পর চলচ্চিত্র উপহার দিয়ে গেছেন, গুণমানে তা বিশ্ব চলচ্চিত্রের সমান, অন্ততঃ বাঙালি তো সেরকমটাই দাবি করে। যে সমস্ত সিনেমা করে গেছেন তার ১০টা সিনেমা করেই তিন পুরুষ নাকি বসে খাওয়া যায় বলিউডে। আর আপনাকে এই ৮৫ বছরের দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে কেন অভিনয় করে যেতে হত? খোঁজ রেখেছে কেউ। আপনি এই বুড়ো বয়সে এসে নাকি টাকার লোভে বিজ্ঞাপন করতেন! কেউ কী জানে আপনার ছেলে যে একদিন ইংরেজীতে কবিতা লিখে চমকে দিয়েছিল, সামান্য একটা চাকরির পর অবসর নিয়ে সে আপনারই গলগ্রহ। আপনার স্ত্রী রোগশয্যায় দুরারোগ্য ক্যান্সারে মৃত্যুর দিন গুনছেন।
আপনার বিবাহ বিচ্ছিন্না কন্যা আপনার কাছেই থাকেন এবং তাঁর পুত্র একটি দুর্ঘটনায় শয্যাশায়ী। এতগুলো জীবন, এত যন্ত্রনা বহন করার জন্যই এই করোনাকালেও আপনাকে কাজে নামতে হয়েছে! ঠিক একজন বৃদ্ধ পিতা, অতি বৃদ্ধ, যাঁকে সংসার চালাতে এখন রাস্তায় নামতে হত এমনই সাধারন বাঙালি হয়ে আপনাকে চলে যেতে হল! যে পিতা মৃত্যুর আগেও যন্ত্রনা নিয়ে যায়! মাননীয়, আপনাকে অবসরের আনন্দ দেয়নি যে জাতি তাকে আপনি মার্জনা করে গেলেন তো? যদি আপনি মার্জনা না করে যান তাহলে আপনার চলে যাওয়ার পর আপনার জন্য রাখা বাদ বাকি সমস্ত শোক আর শোকের আয়োজন, আড়ম্বর সবই বড় অর্থহীন, বড় হাস্যকর হয়ে পড়ে যে।