আশিস মিশ্র: যেখানে এই পৃথিবীরই সীমা ছাড়াতে পারিনা সেখানে এক মহাপৃথিবীর বাসিন্দা যিনি হতে পারেন তিনি নিশ্চিতভাবেই কবি শম্ভু রক্ষিত। আকাশচারি হয়ে নয়, এক গন্ডগ্রামের মাটিতে পা রেখে মহানগর মাড়িয়েই সেই মহাপৃথিবী রচনা করেছিলেন কবি। কবির সেই গ্রাম বিরিঞ্চিবেড়িয়া আমার গ্রাম বড়বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। আমফাম বয়ে গেছে কয়েকদিন হলো। আমার মাটির বাড়ির আর কোনো অস্তিত্ব নেই। কবি শম্ভু রক্ষিতের বাড়িটিও ঝড়ে ক্ষত হয়েছে। সেই বাড়িতে কয়েকবার আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। সামান্য ইট ও মাটি দিয়ে একটি কাঠামো। কোনো রকম বসবাস করা যায়। সামনে একটু ছোট উঠোন। একটি পুকুর। আহামরি কিছু নয়।সেই বাড়ির বাইরের দরজায় লেখা ‘ নন্দায়ন’। এটাই বাড়ির নাম। অথচ সেই বাড়ির শরীরে কোনো সরকারি প্রলেপ লাগেনি। যা হতে পারতো।
আমফামের আগে কতো ঝড় বৃষ্টি বয়ে গেছে। ভিজে গেছে কবির বইপত্র। তাই একদিন আড্ডায় কবি শম্ভু বলেছিলেন, আমার জীবনের দুটি বস্তুই শ্রেষ্ঠ — এক, বই। দুই, মদ। তবে মদ খেয়ে তাঁকে কোনদিন মাতাল হতে দেখিনি। না খেলেও তাঁর কোনো আফসোস ছিলো না। কিম্বা মদ ব্যাগে নিয়ে ঘোরার কোনো বিলাসিতাও তাঁর ছিলো না। তবে একদিন একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। বেশ কয়েকবছর আগে আমিও কলকাতায়। কলেজস্ট্রিটে কেনাকাটা করছি। বেশ গরম। হঠাৎ দেখলাম, শম্ভুদা মাথায় ব্যাগের ফিতে ঝুলিয়ে হেঁটে আসছেন। আমি দ্রুত তাঁর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু তিনি কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি খুঁজছি। হঠাৎ চোখ পড়লো শম্ভুদা শুয়ে গেছেন কলেজ স্কোয়ারের পুকুরপাড়ে। ব্যাগ মাথায় দিয়ে । ব্যাগ থেকে বেরিয়ে আছে ভদকার একটি বোতল। আমি আর তাঁকে ডাকলাম না। কিছুক্ষণ তাঁর কাছাকাছি বসে একটু পরে চলে এলাম। শম্ভুদা জানতেও পারেননি।
শম্ভুদা এমনই ছিলেন। বিরিঞ্চিবেড়িয়া ছেড়ে, স্ত্রী,পুত্র, কন্যাদের ছেড়ে, হঠাৎ কোথাও উধাও হয়ে যেতেন। পাঁচ ছ’ মাস বাড়ি আসতেন না। কোথায় কোন বন্ধুর বাড়ি থাকতেন, তা কেউ জানতেও পারতাম না। হঠাৎ এসে হাজির হতেন। আমাদের আড্ডায় বসতেন। রাতে থেকেও যেতেন। যখনই আসতেন তখনই আমরা তাঁকে নিয়ে মেতে উঠতাম। মনে হতো শম্ভুদা মানেই কবিতার অসীম আনন্দ। আড্ডার প্রাণ। লিটল ম্যাগাজিনের আত্মা।
তাঁর সম্পাদিত ‘ মহাপৃথিবী’ ৫০ বছর অতিক্রম করেছিলো কয়েকমাস আগে। ২০১৬ থেকেই তিনি শারীরিক ভাবে অচল হতে থাকেন। তবে আমি ৩৫ বছর ধরে শম্ভুদাকে রুগ্নই দেখেছি। সেই অবস্থায় তিনি সর্বত্র যেতেন। কয়েক বছর তাই পত্রিকার দেখভাল করতে পারতেন না। দু’একটা সংখ্যা কবি জ্যোতির্ময় দাশ প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন। পরে হলদিয়ার তিতির্ষু – র সম্পাদক চন্দন দাস দায়িত্ব নিয়ে কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। এবং সম্প্রতি কবির বাসভবনের উঠোনে মহাপৃথিবীর ৫০ পূর্তি হয়ে গেছে কয়েকজন কবির আয়োজনে। ৫০ বছর ধরে ‘মহাপৃথিবী’র দাম ছিলো ১০ টাকা থেকে বেড়ে ২০ টাকা। কবিদের বই,পত্রিকার সামান্য বিজ্ঞাপন ছাড়া আর কোনো বিজ্ঞাপন থাকতো না। সাইজ একই। ওয়ান এইট ডিমাই। প্রচ্ছদ সাদা কালোয় ছাপা। কতো বিখ্যাত শিল্পী তার প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন বিনে পয়সায়। কখনো রবীন মন্ডল,কখনো হিরণ মিত্র, কখনো শ্যামল জানা,কখনো সুকুমার মিস্ত্রি। প্রিয় কবি- সম্পাদক বন্ধুদের দেখলেই শম্ভুদা ব্যাগ থেকে একটি মহাপৃথিবী বের করে হাতে দিতেন। টাকা চাইতেন না। শম্ভুদার আর্থিক বিপন্নতা জেনে প্রায় সবাই টাকা দিয়ে দিতেন। কোনো কোনো বন্ধু একটু বেশি টাকা দিতেন। তা তিনি গ্রহণ করতেন। কিন্তু কখনো হাজার কষ্টেও কাউকে টাকা চাইতেন না!
তাঁর এই বিপন্নতা জেনে কলকাতায় একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের প্রদর্শনীতে প্রায় ৪০ জন চিত্রশিল্পী ছবি এঁকে ছিলেন। সেই সব ছবি বিক্রির টাকা শম্ভুদার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে রাখার ব্যবস্থা হয়। তার মাসিক সুদের টাকায় কবির জীবনে কিছুটা স্বচ্ছলতা ফেরে। এই ঘটনা আমাদের দেশে কোনো কবিকে নিয়ে এর আগে ঘটেনি। এ রাজ্যেও নয়। তার অন্যতম উদ্যোগতা ছিলেন চিত্রশিল্পী রবীন মন্ডল ও কবি কালি কৃষ্ণ গুহ। সঙ্গে আরও অনেকেই ছিলেন। এমনকি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও ছবি কিনেছিলেন। যে বইকে কেন্দ্র করে এমন একটি উদ্যোগ, সেই বইয়ের নাম ‘ প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না ‘। বাংলা সাহিত্যে এক অসামান্য কাব্যগ্রন্থ।
অনেকেই বলেন, জীবনানন্দ, বিনয় মজুমদারের মতোই কবি শম্ভু রক্ষিতের কাব্যভাষাও স্বতন্ত্র। যে বাংলা ভাষায় কবি শম্ভু রক্ষিত তাঁর অজস্র কবিতা লিখে গেছেন, সেই ভাষায়, সেই রকম কবিতার আঙ্গিক,সেই রকম নির্মাণ আর কোনো কবিই লেখেননি। কবিতা কী ও কেন,কীভাবে তাকে লিখতে হয়,কবির কাজ কী, এই সব নিয়ে কবি শম্ভুর ভাবনাও ছিলো একেবারেই ভিন্ন। যে কবিতাকে অনেকেই দুর্বোধ্য বলেছেন। বুঝতে পারেননি। কিন্তু তাঁর কবিতা বোঝবার নয়,তা যে কানে বাজবার। তাই সেই সব কবিতার চরণ ও শব্দ কানে বাজছে আজও। তাঁর শব্দের জন্য অভিধান দেখেও লাভ নেই। কারণ সেই সব শব্দ অভিধানে নেই। যেমন, বুজুকুশাস,মদোক্যালানে ইত্যাদি। তাঁর কবিতায় কখনো রিয়ালিটি, কখনো সাররিয়ালিজম,কখনো ম্যাজিক,মিথ ইত্যাদির প্রবল প্রয়োগ। তার মধ্যে সময় ও ইতিহাস চেতনা ও বিজ্ঞান। সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন মহাপৃথিবীর কবি। তাই প্রকৃতি ও পৃথিবীর সবকিছু তাঁর কবিতায় নির্মিত হয়েছে। কবির কথায় — কবিতা হলো মানুষের বিপজ্জনক সম্পত্তি। আর কবির কাজও আলু পটলের ব্যবসা নয়। কবি হলো এক সত্য দ্রষ্টা।
কবির শরীর ও সাজপোশাক কেমন হবে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষ কি কিছু ভাবেন? জানি না। কবি শম্ভুর শরীর ও সাজপোশাক কেমন ছিলো? তাঁকে যারা কাছ থেকে দেখেননি, তারা বলতে পারবেন না। ময়লা,ধূসর জামা প্যান্ট,পায়ে ধুলো মাখা জুতো,কাঁধে একটি ঝোলা। ঝোলায় কেবল পান্ডুলিপি আর পত্রিকা। আর দাঁত মাজার গুড়াকু। তিনিই একমাত্র কবি, যিনি কলকাতার কফিহাউসে চেয়ারে দু পা তুলে বসে থাকতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। আড্ডা দিতেন। কেউ কিছু বলতেন না। জীবনের প্রায় ৪৫ বছর কেটেছে হাওড়ার ঠাকুর দাস দত্ত লেনে। জন্ম সেখানেই। মামার বাড়িতে। বছর ৩০ বসবাস হলদিয়ার বিরিঞ্চিবেড়িয়ায়। সেখানেই বিবাহিত জীবন। প্রায় সংসারে সন্ন্যাসী লোক ছিলেন। কলকাতায় প্রায় থাকতেন। গঙ্গায় স্নান করে পাইস হোটেল খেয়ে মহাপৃথিবীর কাজ করতেন। বন্ধুদের বই প্রকাশ করতেন। নিজেরও। কাব্যগ্রন্থ ‘রাজনীতি ‘ থেকে ‘ আমি অসুর না কেরর’, ‘ ঝাড়বেলুনে জোট’ ‘ শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘ ইত্যাদি তাঁর সৃষ্টি। দেশে এমারজেন্সির সময় জেল হয়। কিন্তু পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে আসেন। সে সময় কবি ও প্রাবন্ধিক জ্যোতির্ময় দত্তর সঙ্গে ‘ কলকাতা ‘ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। সরকার বিরোধী কথা ছাপা যাবে না। কিন্তু কলকাতা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এমনকিছু, যে কারণে জ্যোতির্ময় দত্তর জেল হয়। সেই সব দিনের কথা শম্ভুদা বলতেন আড্ডায়।
আড্ডা পেলে শম্ভুদা প্রাণ পেতেন। সব চেয়ে বেশিদিন তাঁকে আমরা কয়েকজন বন্ধু আপনজন পত্রিকা অফিসে পেয়েছি। কয়েক বছর আগে আপনজনের ১ মাস ধরে বিশেষ ট্যাবলয়েড প্রকাশ কালে কবি শম্ভু রক্ষিত কলাম লিখতেন। রাতে আমাদের কাছেই থাকতেন। আর অনেক লেখা সংগ্রহ করে আনতেন। উৎসব ও মেলা সংখ্যার তিন ভাগ লেখাই তিনি সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। আপনজন পুজো সংখ্যা প্রকাশের পর ও বিশ্ব বাংলা কবিতা উৎসবের পর আমি, নরেশ জানা,কমল বিষয়ী,শ্যামল সেন, শ্যামল জানা,দেবাশীষ প্রধানরা আডায় রাত কাটিয়ে দিয়েছি। আলোচনা হয়েছে ছবি ও কবিতার ইজম নিয়ে। আলোচনা হয়েছে জীবনের বৈধতা ও অবৈধতা নিয়ে। তিনি বলতেন, ভালোবেসে যা সৃষ্টি তাই বৈধ। আর জোর করে যা সৃষ্টি তাই অবৈধ।
আজ সেই মহাপৃথিবীর কবির অন্তিম শ্বাস চলে গেল। তিনিই বলতেন একটি কবিতার দাম ১ কোটি টাকা। কবির কোনো বয়স নেই। ৭৭ বছর ধরে কবি শম্ভু তার যে সব কবিতাকে অনুভব করেছেন, সেই সব কবিতা ও ধ্বনির চোখে আজ অশ্রুপ্রবাহ। কবি আজীবন তাই প্রিয় ধ্বনির জন্য কাঁদতেন। যে কান্না সব কবির ভেতরেই থাকে। আজ কবি শম্ভুর জন্য কেউ কি কাঁদছেন আড়ালে? হয়তো বা। কেউ কি পড়ছেন তাঁর কবিতার চরণ?
আমার মনে পড়ে যায় এসময় তাঁর ‘ পৃথিবীর অস্তিত্ব সম্পর্কিত’ কবিতাটি। তার কয়েকটি চরণ এমন— ” আমি সৌরজগতের অনেক নীহারিকার সঙ্গ নিয়েছি/ বয়স যাদের কয়েক লক্ষ বছরের বেশি নয়,
যাদের আবার / আমার মতো না- ব্রিটিশ, না- ভারতীয় নাম নেই। —শেষ কথাঃ পৃথিবীর অস্তিত্ব আছে / এটা প্রমাণ করা কখনো যাবে না। ”
নন্দায়ন ফাঁকা করে, ভাই কবি শ্যামল রক্ষিত ও তাদের পরিবারকে কাঁদিয়ে, অজস্র বাংলা ভাষার কবির কবিতাকে ‘মহাপৃথিবী’র বুকে ৫০ বছর ধরে ছেপে তিনি চলে গেলেন আর এক অস্তিত্ব বা অনস্তিত্বের দিকে। এই লকডাউন ও দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে তাই তাঁর নিথর শরীরের কাছে ইচ্ছে থাকলেও যাওয়ার উপায় নেই। কলকাতা থেকে রাতের শেষ হাওড়া- হলদিয়া লোকাল ট্রেনের ভেন্ডারে গুটিসুটি মেরে যেভাবে বিরিঞ্চিবেড়িয়ার কাছে স্টেশনে নেমে চুপিচুপি বাড়ি আসতেন,কেউ তেমন জানতেও পারতো না,তেমনি চুপিচুপি মহাপৃথিবীর ট্রেনে চেপে শম্ভুও চলে যাচ্ছেন অদৃশ্যে। যে ট্রেন কোথাও কখনো দাঁড়িয়ে যাবে না। চলতেই থাকবে। শম্ভুর কবিতা কোথাও দাঁড়ায় না। চলতেই থাকে নির্মাণের কৌশলে।