‘ছোটা’ ছুটিতে ম্যাসানজোর পার্থ দেনদীর নাম ময়ূরাক্ষী। মানে, ময়ূরের চোখ (অক্ষি)। নামকরণে কী দুর্দান্ত কারুকাজ ! ঝাড়খণ্ডের ত্রিকুট পাহাড়। সেখানে জন্মেই পূবমুখো হয়ে দৌড় এই নদীর। চঞ্চলা কিশোরী যেন। দৌড় দৌড়। আড়াই শো কিমি পার হয়ে, দৌড় শেষ হয়েছে নদীর। ভাগীরথী বা গঙ্গার বুকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। চলার পথে চার চারটি জেলা পার হয়েছে নদীটি– ঝাড়খণ্ডে দেওঘর আর দুমকা। বাংলায় বীরভূম আর মুর্শিদাবাদ। সেই পথে বড় আকারের গঞ্জ-শহরও আছে চারটি– পড়শী রাজ্যে দেওঘর আর দুমকা। আমাদের রাজ্যে সিউড়ি আর সাঁইথিয়া।
আমাদের আজকের যাত্রা সেই সিউড়ি পার হয়ে দুমকার দিকে। বীরভূম জেলার সদর শহর সিউড়ি। সেখান থেকে দুমকা। যাত্রাপথটি ভারী মনোরম। সুন্দর পটে আঁকা ছবি যেন। রাস্তার পাশে ছোট ছোট গ্রাম, মাটির বাড়ি, চায়ের দোকান, সবুজ ধানক্ষেত। সব পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে। তিলপাড়া ব্যারেজ ছেড়ে বেশ খানিকটা যেতেই, বাংলার সীমানা শেষ। দোকানের সাইনবোর্ডে হিন্দীতে লেখা। তা দেখে বোঝা যাবে, ঝাড়খন্ডে ঢুকে পড়া গেছে।
গ্রীষ্মে এপথ রুক্ষ। কিন্তু বর্ষায় চিরসবুজ। দূরে ছোট বড় পাহাড় টিলা। মাথায় জঙ্গলের সবুজ ছাউনি দেওয়া। যত পাহাড়ের কাছাকাছি হওয়া যায়, শরীর মন তরতাজা হয়ে ওঠে ততই। পথ গিয়েছে পাহাড়ের পাকদন্ডী বেয়ে। ম্যাসানজোর ব্যারেজ পেরিয়ে দুমকার দিকে গতি সেই পথের। ম্যাসানজোর ব্যারেজের পাড়ে টিলা। তার মাথায় পাহাড়-জঙ্গলের ফাঁক-ফোকর দিয়ে চোখে পড়বে “ময়ূরাক্ষী ভবন। এটাই এবারের গন্তব্য।
আড়াই শো কিমি চলার পথে ছোট-বড় কয়েকটি উপ-নদী পেয়েছে ময়ূরাক্ষী। প্রধানগুলি হল– বামদিকে ব্রাহ্মণী, ডাইনে বক্রেশ্বর, কোপাই আর দ্বারকা। মিষ্টি নামের এই নদী বর্ষায় যেন চামুন্ডা। কী তার ভয়াল ভয়ঙ্কর রূপ ! গেরুয়া রঙের খলবলে জল গ্রামের পর গ্রাম ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ফি বছর ভয়ঙ্কর বন্যায় দুর্দশার অন্ত থাকে না মানুষের। তাই তো পায়ে দু-দুটো বেড়ি পরিয়ে বাঁধতে হয়েছে নদীকে। গড়ে উঠেছে অগাধ জলের ভান্ডার– এ রাজ্যে তিলপাড়া আর ও পারে ম্যাসানজোর ড্যাম। ম্যাসানজোরের টানেই এখানে আসা।
১৯৫৫ সাল। তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। তিনি উদ্যোগী হয়ে কানাডার সরকারকে ডেকে এনেছিলেন, সহযোগী হিসাবে। গড়ে উঠেছিল ম্যাসানজোর বাঁধ। তাই এটিকে কানাডা ড্যামও বলা হয়। ডিভিসি পরিকল্পনার অঙ্গ হিসাবে গড়া এই বাঁধ। কিন্তু গড়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের উদ্যোগে। সেই সময় থেকে এর যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বর্তায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ওপর। তাই ভৌগলিক ভাবে ঝাড়খণ্ডে অবস্থিত হলেও, এর নিয়ন্ত্রণ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হাতে। ১৫৫ ফুট উঁচু ও ২১৭০ ফুট লম্বা বাঁধে লকগেট আছে ২১টি। জলাধারের আয়তন প্রায় ৬৭ বর্গকিমি। নিয়মিত সংস্কারের পাশাপাশি বাঁধ এলাকা সৌন্দর্যায়নের উদ্যোগও পঃবঃ সরকারের।
বাংলোর কেয়ারী করা বাগান, রকমারি ফুলের মেলায় সাজানো। সবুজ ঘাসের গালিচায় বসে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করে কাটিয়ে দেওয়া যায়। বিশাল টানা বারান্দা বাংলোর। সূর্যদেব পশ্চিমে ঢললে, চেয়ার টেনে বসে পড়া। অসাধারণ এক সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায়। বাঁধের জলে তখন কে যেন সোনা গুলে দিয়ে যায়। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা তাদের বাসায় ফিরে যায়। বেরিয়েও পড়া যায় বিকেলে। ব্যারেজের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নদীর ওপার ওপার থেকে ঘুরে আসা যায়। শান্ত স্নিগ্ধ প্রকৃতি। শাল-পলাশ-মহুয়ার জঙ্গল। শরতে পেঁজা তুলোর মত কাশ ফুল। আর বসন্তে পলাশ রঙে সেজে ওঠে প্রকৃতি।
ময়ূরাক্ষী ভবন বাংলোটি সেচ ও জলসম্পদ দপ্তরের। এককথায় অসাধারণ এই বাংলো। ভরা বর্ষায় বা চাঁদনী রাতে ময়ূরাক্ষী ভবনে নিশিযাপন যেন স্বপ্নপূরীতে বাস করা। রিমঝিম বৃষ্টিতে বাংলোর ব্যালকনি থেকে জলাধারের নয়নাভিরাম রূপ মুগ্ধ করবে। পাহাড় যেন আরো সবুজ। চারদিক দিয়ে জলাধারকে ঘিরে রেখেছে। বর্ষায় এলে, জলাধার থেকে জল ছাড়ার দৃশ্য উপরি পাওনা হতে পারে।
পাহাড়ের গায়ে এসে গা এলিয়ে দেওয়া মেঘ। ড্যামের জলের মাঝে কুয়াশায় মোড়া ছোট ছোট দ্বীপ। রঙীণ নৌকা ভাসে জলে। জলছবির মত এইসব দৃশ্য চোখ জুড়িয়ে দেবে। শীতে স্বচ্ছ নীল জল। পাহাড়ের ছবি ভাসে তাতে। অনন্য দৃশ্য। পরিযায়ী পাখিরা ভীড় করে আসে সেসময়। টিয়া আর মুনিয়া পাখিরা এখানে স্থায়ী বাসিন্দা। ব্যারেজের ফাঁক ফোকরে তাদের ঘরবাড়ি। সারাদিন লুকোচুরি খেলে বেড়ায়।
জলাধারের নীল জলে নৌকায় ভেসেপড়া যায়। দারুণ রোমাঞ্চকর অনুভুতি।
কিভাবে যাবেন :- ◆ হাওড়া থেকে সকালের হুল এক্সপ্রেসে সিউড়ি স্টেশন। তারপর টোটো বা রিক্সায় সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে, দুমকাগামী বাসে ম্যাসানজোর ড্যাম (৪০ কিমি)। ◆ কোলকাতার বাবুঘাট থেকে দুমকাগামী বাসে প্রায় ৭ ঘন্টায় সরাসরি ম্যাসানজোর যাওয়া যায়।
কাছাকাছি স্পট :-ব্যারেজের ওপর দিয়ে হেঁটে ওপারে আরো কিছুটা এগিয়ে ছবির মতো সুন্দর এক আদিবাসী গ্রাম লাম্বা। এখান থেকে হস্তশিল্প সামগ্রী সংগ্রহ করা যায়। কাছেই একটি মিশনারি স্কুলও আছে।। একটু দূরে :– ◆ দুমকার দিকে গেলে দেখবেন হিজা পাহাড় ও নদী, কুরা পাহাড়, তাতলোই প্রস্রবণ ও কুমরাবাদ নদী। ◆ ম্যাসানজোর থেকে সিউড়ির দিকে গেলে রাজুডিহি মোড়, ওখান থেকে নানহা পাহাড় ও চোরকাঁটা পাহাড় (আদিবাসী গ্রাম)। ◆ ঘুরে আসতে পারেন – বক্রেশ্বর ধাম (উষ্ণ প্রস্রবণের জন্য বিখ্যাত), নীল নির্জন ব্যারেজ, দুবরাজপুরে মামা ভাগনে পাহাড় (বক্রেশ্বর থেকে ১৩ কিমি), হেতমপুর রাজবাড়ি, জয়দেব কেন্দুলি (৩৫ কিমি)।
থাকার ব্যবস্থা :- ◆ “ময়ূরাক্ষী ভবন” – বুকিং এর জন্য যোগাযোগ Dy. Secretary, Irrigation Department, Water Resource & Development Building, Salt Lake, Kolkata, ফোন – 033 23212259/03462 255229 ◆ যুব কল্যাণ দপ্তরের “যুব আবাস” – অনলাইন বুকিং এর জন্য https://youthhostelbooking.wb.gov.in/
ফোন – 033 22480626 / 03462 255756 (ম্যাসানজোর)। ◆ ঝাড়খন্ড সার্কিট হাউস – যোগাযোগ Superintendent Engineer, Irrigation Department, Dumka,
ফোন – 06434 224569◆ ড্যামের ১ কিমি আগে সুরুচি ও মহামায়া নামে দুটি প্রাইভেট হোটেল আছে। তাছাড়া কয়েকটি খাবারের রেস্টুরেন্টও আছে।
কিছু কথা :-◆ দুর্গা পূজোর দশমীর পরেরদিন ম্যাসানজোরে একটি আদিবাসী মেলা হয়।
◆ বর্ষা, শরৎ ও বসন্তকাল এখানে ঘোরার জন্য আদর্শ সময়।
◆ সিউড়ীর বিখ্যাত মোরব্বা খেয়ে দেখবেন।
◆ বেড়াতে গিয়ে কোনরকম আববর্জনা ফেলে আসবেন না।