দ্যা সিটি অফ ওয়াটার ফলস্ পার্থ দে
চারিদিকে পাহাড়, ঝর্ণা আর লেক পরিবেষ্টিত রাঁচি শহরের প্রাকৃতিক দৃশ্য অসাধারণ, জলবায়ুও বেশ ভাল, স্বাস্থ্যকর। এখানকার মনোরম জলবায়ুর জন্য ব্রিটিশরা এই শহরকে বিহারের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী রূপে ব্যবহার করত। উচ্চতা 2140 ফুট। শহরের একশ কিমি পরিধির মধ্যে ছড়িয়ে আছে অনেক সুন্দর সুন্দর ফলস্ বা জলপ্রপাত, যার থেকেই এই শহরের অন্য নাম “দ্যা সিটি অফ ওয়াটার ফলস্”। আমি গিয়েছিলাম শীতকালে। তবে জলপ্রপাতের ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ দেখতে হলে বর্ষাকালে যেতে হবে। তখন দেখবেন, কেমন ভাবে লালচে ঘোলাটে জল প্রবল আক্রোশে পাথরের বুকে আছড়ে পড়ছে।
এই শহর মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মনীষীদের পদধূলিধন্য।
কথিত আছে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘গীতাঞ্জলি’রচনার কাজ শুরু করেছিলেন রাঁচির মোরাবাদি হিলে বসে, যা পরে টেগোর হিল নামে পরিচিত।
রাতের ট্রেন সফর সবসময় রোমাঞ্চকর। দিনের সব কাজ সেরে, রাতের খাবার প্যাক করে ট্রেনে চড়ে বসলাম। সঙ্গে আমার মতো আরো কয়েকজন ঘুরনচন্ডী বন্ধু। একসাথে খাওয়া-আড্ডা ও শেষ রাতে একটু ঘুমের পর ভোরবেলায় মুরি স্টেশন পৌঁছলাম। ট্রেন বেশ কিছুক্ষন দাঁড়াবে। তাই প্ল্যাটফর্মে নেমে একটু পায়চারি করলাম। বাকিরা তখন গভীর ঘুমে। আমি এক কাপ গরম কফিতে চুমুক দিলাম।কিছুক্ষন পর ট্রেন ছেড়ে দিল। শহর পেরিয়ে একটা পাহাড়ী উপত্যকার মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে ট্রেন চলেছে। পাহাড়ের ঢালে ধাপ কেটে ধান চাষ হয়েছে। সূর্যের প্রথম কিরণ সবুজ উপত্যকার ওপর এসে পড়েছে। সে এক অসাধারন সুন্দর দৃ্শ্য ট্রেনের জানালা থেকে প্রত্যক্ষ করলাম। ইচ্ছে হচ্ছিল যেন এখানে ট্রেন থেমে গেলে নেমে ছুটে যাই। দেখতে দেখতে ঘন্টা দেড়েক পরে রাঁচী পৌঁছে গেলাম।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা হোটেলে চেক ইন করলাম। তারপর একটু ফ্রেশ হয়ে, ব্রেকফাস্ট করে নিলাম। একটা গাড়ি বুক করে বেরিয়ে পড়লাম নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। শহর পেরিয়ে কিছুটা এগোতেই রাস্তার দুধারে ঘন সবুজে ঢাকা টিলার সারি, ধানক্ষেত আর তার ফাঁকে ছোট ছোট গ্রাম। যতদুর চোখ যায় শুধু সবুজের বাহার। এপথে গেতালসুদ ড্যাম দেখে পৌঁছে গেলাম হুড্রু ফলস্ (রাঁচি থেকে দূরত্ব 45 কিমি)। প্রায় সাড়ে সাতশো সিঁড়ি অতিক্রম করে জলপ্রপাতের নীচে পৌঁছতে হয়। কংক্রিটের বাঁধানো সিঁড়ি, মাঝেমাঝেই বসার ব্যবস্থা করা আছে, তাই সহজেই বিশ্রাম নিয়ে চলা যায়। চারপাশে যতদুর চোখ যায় সবুজে ঢাকা টিলার সারি, কোথাও বা চোখে পরে বুনো ফুলের ঝাড়। গর্জন প্রায় প্রথম থেকেই শুনছিলাম, বেশ কিছুটা নিচে নামার পর তার এক ঝলক চোখে পড়ল। যখন গিয়ে পৌঁছলাম তার কাছে, দেখলাম সগর্জনে দুধসাদা সুবর্ণরেখার জলরাশি 320 ফুট উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে পাথরের খাদে। আর সেই গর্জনে চারিদিকের প্রকৃতি মুখরিত। সিঁড়ি ভাঙার ক্লান্তি নিমেষে উধাও, প্রানভরে শ্বাস নিয়ে মন প্রাণ তরতাজা হয়ে উঠেছে।
এবার চললাম হুড্রু থেকে 20 কিমি (রাঁচি থেকে 40 কিমি) দূরের জোনা ফলসে। টোলগেট পেরিয়ে বাঁদিকে পাকদন্ডী পেরিয়ে কিছুটা উপরে উঠে গাড়ির পার্কিং। বাঁদিকে গৌতম বুদ্ধের একটি মন্দির, শান্ত নিঃস্তব্ধ পরিবেশ। এর আরেক নাম গৌতমধারা ফলস। ডান দিকের রাস্তা এগিয়ে গেছে ফলসের দিকে। প্রায় 670 টি সিঁড়ি নেমে গেছে জোনা ফলস এর নীচে। চারপাশে বেশ ঘন জঙ্গল, তার ফাঁক-ফোকর দিয়ে চোখে পড়ছে জলপ্রপাতের রূপ। অনেক দূর থেকেই সগর্জনে সে নিজের অস্তিত্ব জাহির করে চলেছে। বেশ খানিকটা নামার পর চোখের সামনে ধরা দিল জোনা ফলস, 141 ফুট উঁচু থেকে সফেদ জলরাশি পাথরে সশব্দে আছড়ে পড়ছে, সেখান থেকে তৈরি জলবিন্দুগুলো শেষ বিকেলের সূর্যের সোনালী আলোয় সোনার মত চিকচিক করছে। জোনা ফলসের এই রূপ খুবই উপভোগ্য তাতে কোন সন্দেহ নেই। গুঙ্গা (গঙ্গা নয়) নদী এবং রারু নদীর স্রোতে এই জলপ্রপাত সৃষ্ট। নিচে জলের অনেকটা কাছে যাওয়া যায়। তবে এখানে বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময়ে স্নান করা যায়, তবে খুব সাবধানে।জোনা থেকে সামান্য দূরেই সীতা ফলস। প্রায় 300টা সিঁড়ি। সুবর্ণরেখার শাখানদী কাঞ্চি নদীতে সৃষ্ট এই জলপ্রপাত।
হুড্রু, জোনা ও সীতা ফলস দেখে হোটেলে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। পরের দিনের গন্তব্য দশম ফলস, সূর্য মন্দির ও শহরের কিছু দর্শনীয় স্থান। রাঁচি থেকে টাটা যাওয়ার রাস্তায়, রাঁচি থেকে 35 কিমি দুরে দশম ফলস্। এপথেই 7 কিমি এগোলেই ছোট ছোট পাহাড় আর সবুজের সাম্রাজ্য, নাম তার নামকূম। সৌন্দর্য-পিপাসু মন সহজেই ভরে যায়। দশম ফলস্ 144 ফুট উঁচু থেকে কাঞ্চি নদীর জলধারায় দশম ফলস্ –এর সৃষ্টি। এখানে সিঁড়ি সংখ্যা খুব বেশি নয়। শীতকালে আশেপাশের অঞ্চল, এমনকি ঝাড়খন্ড ঘেঁষা পশ্চিমবঙ্গ থেকেও প্রচুর মানুষ এখানে পিকনিক করতে আসে। এপথেই সূর্য মন্দির পড়বে। বিকেলে হোটেলে ফিরে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিয়ে, ঐরাতের ট্রেনে কোলকাতা রওনা দিলাম।
◆ আর কি কি দেখবেন :– ( একটা দিন শহর পরিক্রমা করুন। দেখবেন – রাঁচী লেক ও পাহাড়ের শিব মন্দির, রক গার্ডেন, কাঁকে ড্যাম, টেগোর হিল, জগন্নাথ মন্দির, পঞ্চমুখী হনুমান মন্দির, গণেশ মন্দির, মছলি ঘর, ডিয়ার পার্ক, নক্ষত্র বন, ওয়ার মেমোরিয়াল, হাতিয়া ড্যাম, ট্রাইবাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, রামকৃষ্ণ আশ্রম, সুবর্ণরেখা ধাম, দেউড়ি মন্দির ইত্যাদি।
( রাঁচি-পাটনা রোডের উপর রাঁচি থেকে 20 কিমি দুরত্বে গড়ে উঠেছে বিরসা বায়োলজিক্যাল পার্ক। আকারে খুব বড় না হলেও সংগ্রহে বৈচিত্র্য আছে। নানা রকমের দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান উদ্ভিদ, বেশ কয়েকটা পাইথন, বিষাক্ত সাপ, বাঘ, সিংহ, হায়না, চিতা, ভাল্লুক সবই আছে। জুএর মধ্যে একটা লেক আছে, সেখানে বোটিং করা যায়। সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল নটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত খোলা থাকে।
( রাঁচি থেকে 42 কিমি দূরে পাত্রাতু ড্যাম। ঝাঁ চকচকে মসৃণ রাস্তা, রাস্তার পাশ দিয়ে লাল মাটি আর সবুজ গাছের সারি। ক্রমশ চড়াই উতরাই পথ, হেয়ারপিন বেন্ড যা দেখে উত্তরবঙ্গ মনে হতে পারে। ঐ রাস্তার ওপর থেকেই নজরে আসবে দূরে পাহাড় দিয়ে ঘেরা সুবিশাল পাত্রাতু ড্যাম।
( রাঁচি থেকে যাওয়া যেতে পারে 65 কিমি দূরে প্রকৃতিপ্রেমিকদের স্বর্গরাজ্য হিরণি ফলস-এ। চারিদিকে জঙ্গলে ঘেরা জলপ্রপাতটির সৌন্দর্যই আলাদা। এখান থেকে 6 কিমি দূরে গেলে পাহাড়-জঙ্গল বেষ্টিত পঞ্চগড়। তাছাড়া রাঁচি থেকে 50 কিমি দূরে পঞ্চঘাগ ফলস্।
( হাতে দু-চারদিন বেশি সময় থাকলে রাঁচি থেকে মহুয়াডাঁর হয়ে 195 কিমি দূরে ঝাড়খণ্ডের উচ্চতম জলপ্রপাত লোধ ফলস্। 468 ফুট (263 টি সিঁড়ি)উঁচু থেকে নামছে লোধ ফলস্। এক রাত মহুয়াডাঁরে কাটিয়ে দেখে নেওয়া যায় সবুজ লাবণ্যময় পাহাড়ে লোধ ফলস্, সিধনি ফলস্ ও সুগা বাঁধ। মহুয়াডাঁরে আদিবাসীদের শিকার উৎসব উপলক্ষ্যে মে মাসের শেষ থেকে জুন মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বেশ জমজমাট মেলা বসে। এখান থেকে বেতলা ফরেস্ট (বর্ষাকালে নয়) ও নেতারহাটও যাওয়া যায়।
তাছাড়া রাঁচি থেকে জামশেদপুর, ধানবাদ, তিলাইয়া, পরেশনাথ, হাজারিবাগ, ম্যাকলাস্কিগঞ্জ, রাজরাপ্পা প্রভৃতি জায়গায় ঘোরা যেতে পারে। ◆ কিভাবে যাবেন :- হাওড়া থেকে ক্রিয়াযোগা এক্সপ্রেস রাতে ছেড়ে পরের দিন সকালে রাঁচি পৌঁছায়। এটাই সবথেকে ভালো উপায়। খড়গপুর থেকে ভোরবেলায় একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন সরাসরি রাঁচি পৌঁছায়। তাছাড়া বাবুঘাট ডিপো থেকেও রাঁচির নাইট সার্ভিস বাস ছাড়ে। ◆ কোথায় থাকবেন :- ঝাড়খণ্ড ট্যুরিজমের বিরসা বিহার (06512331828), মেন রোডে হোটেল রিভার ভিউ (8252006001), স্টেশন রোডে এম্বাসি হোটেল (06512460813), বীণা ইন্ (7631700076), এ ভি এন প্লাজা (06512462231) ইত্যাদি বিগ বাজেট হোটেল।
রাঁচিতে মিডিয়াম বাজেট এর মধ্যে হোটেল অশোক (9507576970), হোটেল মীরা (7632903273),
হোটেল ময়ূরী (06512332144), জণতা হোটেল (06512461166), হোটেল অমৃত (06512461952), হোটল ব্লিস (06512460473), হোটেল রেডিয়ান্ট (06512460527) ইত্যাদি। ◆ খাওয়া দাওয়া :– রাঁচিতে খাবার নিয়ে কোন চিন্তা নেই। স্টেশনের কাছে ধাবা থেকে এসি রেস্তোরাঁয় নানাধরণের খাবার পাওয়া যায়। তবে বাঙালী খাবারের জন্য একমাত্র ইন্ডিয়া হোটেলে যেতে পারেন। আর হ্যাঁ এখানকার মিষ্টির দোকান থেকে লাড্ডু নিতে ভুলবেন না যেন।
হুড্রুর প্রবেশপথের কাছে সুন্দর একটি রেস্তোরাঁ আছে, যার খাবার টেবিলে বসে জানালা দিয়ে পাহাড়ের সুন্দর একটা ভিউ পাওয়া যায়। তাই খাবারের দামটাও বেশ চড়া। তাছাড়া পার্কিং লটের কাছে বেশ কিছু খাবারের দোকান আছে, যেখানে চা-বিস্কুট, ডিম-টোস্ট, পরোটা বা ভাত সবই পাওয়া যায়। পৌঁছেই খাবারের অর্ডার দিয়ে দিন, জলপ্রপাত দেখে ফিরে এসে গরমাগরম খাবার পাবেন। জলপ্রপাতের সিঁড়িপথে নামবার বা উঠবার সময় জলের বোতল অবশ্যই সঙ্গে রাখবেন। এপথে কিছু লেবুজল, কোল্ড ড্রিঙ্কস্, বিস্কুট, চিপস্ ইত্যাদির ছোট ছোট দোকান আছে।
◆ মনে রাখবেন :- ( রাঁচি ভালোভাবে ঘুরতে গেলে যাতায়াত বাদে কমপক্ষে চারদিনের সময় চাই, তবে কিছু স্পট বাদ দিয়ে তিনদিনেও ঘোরা যায়। সিনিয়র সিটিজেন বা যাদের পায়ের সমস্যা আছে তাদের পক্ষে এই ট্যুর না করাই ভালো। তবে জোনা ফলসে ডুলির ব্যবস্থা আছে। আগস্টের শেষ থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত যাওয়ার আদর্শ সময়।। ( জলপ্রপাতের বিপজ্জণক স্থানে নামবেন না বা অন্যমনস্কভাবে সেলফি তুলবেন না। হাঁটাচলায় সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরী। জলপ্রপাত গুলোয় বিকেল সাড়ে চারটের পর প্রবেশ নিষেধ, তাই ঠিকমত প্ল্যানিং করা জরুরি। প্রথমদিন শহর দর্শন। দ্বিতীয়দিন পাত্রাতু-হুড্রু-জোনা-সীতা। তৃতীয়দিন দশম – সূর্য মন্দির-হিরণী-পঞ্চঘাগ ফলস্।) ( ডাস্টবিন ছাড়া যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলে আসবেন না।)