Homeএখন খবরসঙ্গে রুকস্যাক, ওড়িশা-৪, মীর হাকিমুল আলি

সঙ্গে রুকস্যাক, ওড়িশা-৪, মীর হাকিমুল আলি

ওড়িশা ভ্ৰমণ – ৪                                                                                        মীর হাকিমুল আলি
কোনার্ক সূর্য মন্দির
***********************
চন্দ্রভাগার পর আমাদের পরের গন্তব্য স্থল ছিল কোনার্কের সূর্য মন্দির l বই এ পড়েছি খুব বিখ্যাত এই মন্দিরের নাম কিন্তু জানতাম না কিছুই l যখন মন্দিরটি দেখলাম তখন বুঝলাম যে কেউ যদি পুরী বা ওড়িশার আরো কিছু জায়গা ঘুরলো কিন্তু কোনার্কের এই সূর্য মন্দির দেখলোনা তার ওড়িশা ভ্ৰমণ অসম্পূর্ন থেকে গেল l কেননা খুবই বিস্ময়ক এই মন্দির l দেবতাহীন এই মন্দির সমাজ, রাজনীতি, প্রাকৃতিক দৃশ্য, জ্যামিতি, গণিত, কাম, চিত্রকলা, রীতিনীতির অপূর্ব মিশ্রণ l
বাস এসে থামলো মন্দির থেকে কিছুটা দূরে, হেঁটে গেলাম মন্দিরের গেট এর দিকে l দূর থেকে মন্দিরে বহর দেখেই অবাক !!!!এতো বড় আর এতো উঁচু !!!!!!যাইহোক গাইডের কথা মতো সবাই টিকিট কেটে ঢোকার জন্য লাইন দিলাম l কোথা থেকে গাইডের দল এসে টানাটানি শুরু করল, আমরা বললাম আমাদের গাইড আছে l একই কথা আর কতজনকে বলি l মন্দির চত্ত্বরে ঢুকলাম, আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই l টুরিস্ট বাসে এলে যা হয় আরকি l অল্প সময়ের মধ্যে মন্দির ঘুরে ঘুরে দেখা, ছবি তোলা, নিজেদের ছবি তোলা আর নিজস্বী তোলা তো আছেই l তাই কোনো জায়গায় বেশি ক্ষণ না দাঁড়িয়ে পা চালালাম চালালাম l সামনেই একটা খুব উঁচু করে মঞ্চের মত করা আছে, এটাকে বলে নাটমণ্ডপ l এখানে নৃত্যশিল্পীরা নৃত্যকলা পরিবেশন করতেন l সিঁড়িতে ওঠার মুখেই দুদিকে দুটি বিরাট বিরাট সিংহ আর হাতির যুদ্ধরত মূর্তি তার নিচে মানুষ পড়ে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে আছে l সিংহ শক্তি বা ক্ষমতার প্রতীক, হাতি সম্পদের প্রতীক আর এদের নিচে পড়ে পিসা হয়ে মরছে মানুষ l
নাটমণ্ডপে উঠে দেখলাম আবার সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে হয় আর তার পরেই মন্দিরের মূল অংশ যেটা দূর থেকে দেখা যাচ্ছে l থামে থামে শক্ত পাথরে খোদাই করা নানা রকম চিত্র l আর বেশির ভাগ ই কামের l মন্দিরের দেওয়ালে, থামে, বিভিন্ন জায়গায় যে চিত্র কলা কারুকার্য দেখলাম তাতে চোখ কপালে ওঠার জোগাড় l পাথর কেটে কেটে এতো সূক্ষ্ম নকশা কি করে করেছিল তখনকার মানুষ !!!!বিভিন্ন আসনে মিলন রত নারী পুরুষ, সমকামের ছবি, গ্ৰুপ সেক্সের ছবি দেখে আমার বন্ধুরা তো আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো, আমিও কিছুটা সাই দিলাম l গাইড বলেন কলিঙ্গ যুদ্ধের পর মানুষ কাম থেকে মন সরিয়ে নিয়েছিল, বিয়ে, সংসারের দিকে মন ছিল না, তাই মানুষকে কামুক করে তুলতে এরকম শিল্পকলা l
নাটমণ্ডপ থেকে সোজা যে মন্দির টি দেখতে পাচ্ছি ওটা আসলে নাটমন্দির, ঠিক ওর পেছনে ছিল আরো অনেক উঁচু প্রধান মন্দির যার ভেতরে ছিলেন সূর্যদেব l মন্দিরটি পূর্বমুখী, সকালে সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়ে মন্দিরের ভেতরে l 10 হাজার মানুষের 12 বছর লেগেছিলো মন্দিরটি তৈরী করতে, এই কথাই প্রচলিত l বিরাট বিরাট পাথরের চাঁই সাজিয়ে সাজিয়ে তৈরী করা হয়েছে এই মন্দির কোনো সিমেন্টের ব্যবহার হয়নি l 1255 খ্রিস্টাব্দে পূর্ব গঙ্গ রাজবংশের রাজা নরসিংহদেব এটি তৈরী করেন l তবে কথিত আছে কৃষ্ণের পুত্র সাম্বা কৃষ্ণের অভিশাপে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়, আর সেই শাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য চন্দ্রভাগা নদীতে স্নান করেন ও সূর্যদেবকে তপস্যা করে তুষ্ট করলে সূর্য দেবতা তাকে আবার স্বাভাবিক শরীর দান করেন l তারপর তিনি চন্দ্রভাগা থেকে তিন কিমি দূরে এই মন্দিরটি স্থাপন করেন l
মন্দিরটি একটি পাথরের রথের আদলে নির্মিত,,পাথরের চাকা আছে দুদিকে বারোটি করে করে চব্বিশ টি l মন্দিরটি উচ্চতা প্রায় প্রায় 857 ফুট l তবে মন্দিরের বেশির ভাগটাই বালিতে দেবে গেছে l এখন 200 ফুট l ওড়িশা ও দ্রাবিড় শিল্পরীতির সংমিশ্রনে এই মন্দিরটি বিশাল বেলে পথের রথের আকারে গড়ে তোলা হয় l সাত টি ঘোড়া রথটি টানছে, সাতটি ঘোড়া সাত দিনের প্রতীক আর চব্বিশটি চাকা চব্বিশটি পক্ষ l চাকার সাতটি দাঁড়ে আছে সাত দিনের হিসাবl আর আটটি লাঠিতে অষ্টপ্রহর এর হিসাব l চাকা গুলো এক একটা সূর্য ঘড়ি l চাকার মধ্যে দাঁড়টির ছায়া কোথায় পড়ছে সে হিসেবে সময় গণনা করা যায় l
মন্দিরটিকে UNESCO হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করেছে l এটি ভারতের বড় বড় মন্দিরগুলির অন্যতম l পুরী থেকে 35কিমি আর ভুবনেশ্বর থেকে 65কিমি দূরে l
রথের চাকা বা সূর্য ঘড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার হিড়িক পড়ে গেছে সবার l আমরা লাইন পেলাম একটু পরে l ছবি তুলে মন্দির চক্কর দেবার উদ্দেশ্যে আমরা এক রকম ছুটতে লাগলাম l
গাইড বলেই চলেছেন….. কোনার্ক নামটি সংস্কৃত l কোনা মানে কোণ আর আর্ক্ মানে সূর্য l অর্থাৎ সূর্যের বিভিন্ন কোনের অবস্থান l এই মন্দিরটি সূর্যের বিভিন্ন অবস্থানে গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বহন করে l মন্দিরটির দুই কোনে ছায়াদেবীর মন্দির ও মায়া মন্দির আছে l
বঙ্গোপসাগর থেকে মদিরের মূল চূড়া দেখা যেত তাই নাবিকরা একে ব্ল্যাক প্যাগোডা বলতো l মন্দিরের ভেতরে ছিলেন সূর্যদেব l একটা বড় চুম্বক ও ছিল কিন্তু সেই চুম্বক নাবিকদের জাহাজ কে দিকভ্ৰষ্ট করতো বলে কামান দেগে এই চুম্বকটি ভেঙে দেয় l
এতো বড় ঐতিহ্যবাহী মন্দির ধ্বংস হলো কিভাবে??? আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে l কারা ভেঙেছিল মন্দিরের মূল অংশটি??? ইতিহাসে পাওয়া যায় বাংলার সুলতান সুলেমান খান কারানির সেনাপতি কালাপাহাড় মন্দিরটি 1508সালে আক্রমণ করে, ধ্বংস হয় কিছুটা অংশ l কেউ কেউ বলেন রাজা নরসিংহদেব মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন বলে তাকে বহিস্কার করা হলে রাগে তিনি মন্দিরটি ধ্বংস করেন l আবার অনেকের মতে 1626 সালে খুরদার তৎকালীন রাজা পুরুষোত্তম দেবের পুত্র নারাশিমা দেব সূর্য দেবের বিগ্রহটি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে নিয়ে যান l মারাঠা প্রশাসন নাট মণ্ডপটি ভেঙে ফেলে l পূজা আরতি বন্ধ হয়ে যায় l পর্তুগিজদের আক্রমণেও মন্দিরটি ভেঙে যায় বলে ধারণা করেন অনেকে l ধীরে ধীরে মন্দিরটি পরিত্যাক্ত হয়ে ওঠে l জলদস্যু আর ডাকাতের আস্তানা হয়ে ওঠে মন্দিরটি l বিংশ শতাব্দীতে প্রত্নতত্ববিদরা কোনার্ক মন্দিরটি পুনরুদ্ধার করেন l 300বছর ধরে বালির স্তুপে চাপা পড়ে থাকা মন্দিরটি 1904 সালে লর্ড কার্জন উদ্ধার করেন lকিন্তু মান্দিদের ভেতরে এখনো ঢোকা যায়না l
মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এখনও সযত্নে রাখা আছে কোনার্ক সূর্য মন্দির মিউজিয়াম এ l
এতো বড়ো মন্দির আর তার থেকে বড়ো এর মাহাত্ব আর ভাস্কর্য l দেখেও যেন শেষ করতে পারছিনা l মনে হচ্ছিলো সারাটা দিন থাকি l কিন্তু সে উপায় নেই l এতো কম সময়ে মন্দিরের পুরো চত্বর আর আনাচে কানাচে কি কি আছে দেখা সম্ভব নয় বুঝতে পারা তো দূরের কথা l অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে, অনেক শিল্পকলা মুছে গেছে, আবছা হয়ে গেছে কিন্তু তবুও যেটুকু আছে তা যে একজন প্রত্নবীদের কাছে সমুদ্র তা বলায় যায় l আজও এই ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মন্দিরটি দেশি বিদেশি পর্যটকদের বিস্ময়, মুগ্ধ ও তৃপ্ত করে চলেছে l
বাইরে বেরিয়ে আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে গেলাম কোনার্ক মিউজিয়ামে l
পরের পর্ব….. ক্রমশ l

RELATED ARTICLES

Most Popular