শীতের ছুটিতে মাইথন পার্থ দে
ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজ। মখমলের মতো রোদ্দুর গায়ে মাখামাখি। নীল আকাশের কোল থেকে মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসা পেঁজা তুলোর মতো মেঘের ভেসে বেড়ানো। এমন যখন প্রকৃতি, তখন তো মন চাইতেই পারে ঘর ছেড়ে একটু বেরিয়ে পড়তে। কিন্তু করোনার চোখ রাঙানী, তার ওপর আবার ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক নয়। তা সত্ত্বেও যদি যেতে চান এমন এক জায়গায়, যেখানে স্বচ্ছ নীলাকাশ আর উজ্জ্বল রোদ্রের ছটায় চিকচিক করবে জল, পাখিদের কলকাকলীতে ভরে উঠবে সবুজ প্রকৃতি, সকালে থাকবে হালকা কুয়াশার ঘেরাটোপ, তা হলে গাড়ি বা বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারেন মাইথন ড্যামের পথে। কলকাতা থেকে দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়।
ছোট ছোট পাহাড় টিলা ও চারপাশে সবুজ অরণ্যের মাঝে সুবিশাল মাইথন ড্যাম। এটি বর্তমান পশ্চিম বর্ধমান জেলার প্রান্তবর্তী ঝাড়খন্ড রাজ্যে অবস্থিত। মজার ব্যাপার হল, বাঁধটি চলে গেছে ঝাড়খন্ডে কিন্ত জল ভান্ডারটি রয়েছে বাংলার মধ্যে। বাঁধের ওপর দিয়ে গাড়ি চলাচলের রাস্তা। বাঁধের একদিকে বিশাল জলরাশি দিগন্ত ছুঁয়েছে। আর অন্যদিকে বরাকর নদী প্রবাহিত হয়ে কিছু দূরে দামোদরে মিশেছে। ড্যামের জলরাশির মাঝে ছোট ছোট দ্বীপ, নামগুলিও খুব সুন্দর – সবুজ দ্বীপ, চামচ দ্বীপ, আনন্দ দ্বীপ আরো কত কি। তারা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে কাছে যাবার জন্য। নৌকায় চড়ে দ্বীপগুলোতে ঘুরে আসা সত্যিই রোমাঞ্চকর। পূর্ণিমার রাতে জলের ধারে বসলে কানে আসবে জলতরঙ্গের ছলাৎ ছলাৎ ধ্বনি। পড়ন্ত বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে অসাধারন এক সূর্যাস্ত দেখা সে এক বিরল অভিজ্ঞতা। তবে বর্ষাকালে সূর্যাস্ত না দেখা গেলেও, দেখতে পাবেন ব্যারেজ থেকে জল ছাড়ার ভয়ঙ্কর সুন্দর দৃশ্য। বাঁধের আশেপাশে হোদল, বাথানবাড়ি, সীতাবাড়ি, বাঁশকাটিয়া ইত্যাদি সব গ্রাম। কুমারী প্রকৃতি, উঁচু নিচু পাথুরে পথ আর শিমুল-পলাশ-মহুয়া-কেন্দু-আমলকি-হরিতকি-বয়ড়া ইত্যাদির জঙ্গল। জঙ্গলে নানা ধরনের পাখি আর তাদের কলতান। শীতকালে ড্যামের স্বচ্ছ নীল জল আর নীল আকাশের মেলবন্ধনে খেয়ালি প্রকৃতির ক্যানভাসে মাইথন যেন শিল্পীর আঁকা এক ছবি। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে মাপা অচলায়তনের বাইরে মুক্ত ও বিশুদ্ধ আলো-হাওয়ায় কিছুসময় নিশ্চিন্তে কেটে যাবে। প্রকৃতির সম্মোহনী যাদুতে মুছে যাবে কর্মব্যস্ত দিনযাপনের গ্লানি ও অবসাদ।
1957 সালের 27শে সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এই ড্যামের সূচনা করেছিলেন। দামোদরের উপনদী বরাকরের উপর 15,712 ফুট দীর্ঘ এবং 165 ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট কংক্রিটের এই বাঁধে 12টি লকগেট রয়েছে। মাইথন জলাধারের আয়তন 65 বর্গকিমি ও গভীরতা 120 ফুট। DVC-র জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি 60 মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন।
কাছাকাছি স্পট :-
◆ মজুমদার নিবাসের সামনে থেকে বা ঝাড়খণ্ডের প্রান্ত থেকে দাঁড়টানা নৌকো বা স্পিড বোটে চড়ে বিভিন্ন দ্বীপে ঘোরার ব্যবস্থা আছে।
◆ মাইথন ড্যামের পাশেই রয়েছে ডিয়ার পার্ক। এছাড়াও রয়েছে মিলেনিয়াম পার্ক। শীতকালে এই জায়গায় পুষ্পমেলার আয়োজন করে ডিভিসি।
◆ 2 কিমি দূরে কল্যাণেশ্বরী যাওয়ার পথে ভান্ডারা পাহাড় চূড়ায় অমরনাথ শিবমন্দির। পাহাড়ের উপর থেকে মাইথন ড্যামের সুন্দর একটা ভিউ পাওয়া যায়।
◆ আরো 2 কিমি দূরে প্রাচীণ কল্যাণেশ্বরী মন্দির। মন্দিরের পেছনে সুন্দর একটি ঝর্ণা যা বর্ষাকালে আরো চঞ্লা হয়ে ওঠে।
◆ মাইথন থেকে যেতে পারেন পাঞ্চেত ড্যাম (13 কিমি), এপথেই বরাকরের বেগুনিয়াতে দেউল রীতির চারটি প্রাচীণ সিদ্ধেশ্বর মন্দির, পাঞ্চেত ড্যামের পাশেই মোবারকের স্নেক পার্ক, আরো এগিয়ে গড়পঞ্চকোট পাহাড় ইত্যাদি। কবি নজরুলের জন্মস্থান চুরুলিয়া (38 কিমি), ঘাগর বুড়ি মাতার মন্দির (25 কিমি) ইত্যাদি।
কিভাবে যাবেন :-
◆ নিকটবর্তী রেলস্টেশন কুমারডুবি থেকে অটোতে 7 কিমি দূরে মাইথন ড্যাম।
◆ অথবা ট্রেনে করে আসানসোল স্টেশনে নেমে টোটো বা রিক্সায় সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড। ওখান থেকে মিনি বাসে 1 ঘন্টায় মাইথন ড্যাম (25 কিমি)।
◆ কোলকাতা থেকে মাইথনের দুরত্ব 230 কি.মি। খুব সকাল সকাল বেরিয়ে নিজের গাড়ি নিয়েও যেতে পারেন।
◆ তাছাড়া কোলকাতা থেকে চিত্তরঞ্জনগামী SBSTC-র বাসে দিনদুয়ার মোড়ে নেমে মাইথন যাবার মিনিবাস পেয়ে যাবেন।
থাকা-খাওয়া :-
থাকা-খাওয়ার সেরা ঠিকানা ডিভিসি-র মজুমদার নিবাস গেস্ট হাউস (ফোন- 0654025246, 06540252488)। ড্যামের মধ্যে একটি ছোট্ট দ্বীপের উপরে এর অবস্থান। স্থলভাগ থেকে একটা লম্বা লোহার ব্রিজ পেরিয়ে মজুমদার নিবাসে পৌঁছতে হয়। ভেতরে সুন্দর করে সাজানো বাগান। ডাইনিং রুমের কাঁচের জানালা থেকে ড্যামের সীমাহীন জলরাশির অপরূপ দৃশ্য দেখতে গিয়ে খাবার খেতে ভুলে যাবেন। এক মাস আগে কোলকাতা উল্টোডাঙার ‘ডিভিসি টাওয়ার’অফিস থেকে বুকিং করতে হবে। ফোন – 033 66072329 । তবে এখানে থাকতে গেলে কিছু নিয়ম কানুণ কঠোরভাবে মেনে চলতে হয়।
এছাড়া টিলার উপরে ফরেস্ট বাংলো (9434009358), WBTDC-র মাইথন ট্যুরিস্ট লজ অনলাইন বুকিং হয় (033-23344062), মাইথন হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট (8228933852), হোটেল শান্তিনিবাস (9007486005), ড্যাম থেকে কিছুটা দূরে দিয়া গেস্ট হাউস (8653186848), হোটেল মাইথন (8641072212)। এছাড়া কল্যাণেশ্বরী মন্দিরের কাছেও অনেক হোটেল আছে।
সব হোটেলেই নিজস্ব খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তাছাড়া মজুমদার নিবাসের সামনে এবং বাঁধের ঝাড়খন্ড প্রান্তে অনেক ছোট ছোট দোকান নানান মুখরোচক খাবারের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। সন্ধ্যার সময় যায়গাটা মেলার মতো সেজে ওঠে।
মনে রাখবেন :- মাস্ক পরা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি সমস্ত রকম স্বাস্থ্যবিধি ও নিয়মকানুন মেনে ঘুরে আসতে মাইথন থেকে। দীর্ঘ বন্দিদশা থেকে একটু মুক্তি পেলে মনটাও ভালো থাকবে। আর রাজ্যের পর্যটনভিত্তিক অর্থনীতিকে জোরদার করতে সাহায্য করাও হবে। আর হ্যাঁ, ড্যামের জলে কোনরকম আবর্জনা ফেলবেন না।