শশাঙ্ক প্রধান: করোনা জীবন ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে গরিব মানুষের জীবন। লকডাউন, আংশিক লকডাউনে বিপর্যস্ত আমজনতার অর্থনীতি। রোজগার হীন সংসারে কোথাও সপরিবারে আত্মহত্যা ও কোথাও নিজের জীবন নিজেই শেষ করে দিচ্ছেন পরিবারের কর্তা। তারই মধ্যে এক মর্মস্পর্শী আত্মহত্যার ঘটনা উঠে আসল পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং থানা এলাকা থেকে। রবিবার সকালে এখানেই নিজের হাতে হাঁসুয়া নিয়ে নিজেরই গলা কেটে আত্মহত্যা করেছেন এক দিনমজুর। আর সেই ঘটনার অভিঘাতে কার্যত বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে গোটা পরিবার। হতবাক প্রতিবেশীরা। খবর পেয়ে এলাকায় ছুটে গিয়েছে সবং থানার পুলিশ।
পুলিশ জানিয়েছে ঘটনাস্থল সবং থানা থেকে ঘটনাস্থল প্রায় ১০ কিলোমিটার। এলাকাটি সবং পঞ্চায়েত সমিতির অন্তর্গত ৯ নম্বর বলপাই গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত পানপাড়া গ্রাম । এই এলাকার গ্রামবাসী এবং স্থানীয় সিভিক ভলেন্টিয়ার মারফৎই থানায় খবরটি এসে পৌঁছায় যে ৪৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তি হাঁসুয়া দিয়ে নিজের গলা কেটে ফেলেছে। পুলিশ জানিয়েছে প্রাথমিক ভাবে তাঁরা খবর পেয়েছেন যে ওই ব্যক্তির নাম ভীমসেন চাতার। পেশায় দিনমজুর ওই ইদানিং মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। গত ৫দিন সেই অবসাদ কিছুটা বেড়েছিল। বাড়ি থেকে মাঝে মধ্যে বেরিয়ে পড়তেন তিনি। আজ নিজের ছেলে যেখানে পেশায় নিযুক্ত ছিল সেখানে গিয়েই ঘটনাটি ঘটান ওই ব্যক্তি। তবে প্রকৃত ঘটনা কী তা তদন্ত করছে পুলিশ। ছেলে সহ প্রত্যক্ষদর্শীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
মৃতের ছেলে শম্ভু চাতর জানিয়েছেন, ‘ “আমার ছোট বেলায় মা আগুনে পুড়ে গেছিলেন। সুস্থ হয়ে উঠলেও তিনি প্রায় বধির হয়ে যান। সংসারে দ্বিতীয় আঘাত আসে আমার বিবাহিতা বোন আগুনে পুড়ে আত্মহত্যা করার পর। সংসারে অভাব অনটন ছিলই তারপর এই একের পর এক ঘটনা বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল বাবাকে। আমি বিয়ে করি। মায়ের সঙ্গে বউয়ের মাঝে মধ্যে ঝগড়া হত বলে বাবা আমাদের আলাদা করে দেন। সেভাবেই চলছিল। আমি গাছ কেটে সংসার চালাই। বাবা মাঝে মধ্যে কাজ পেলে করতেন কিন্তু কয়েকদিন কাজ কর্ম করছিলেন না।”
রবিবার সকালে কোনও কিছু বিষয় নিয়ে পারিবারিক অশান্তি বা ঝগড়া হয়েছিল কিনা শম্ভু বলতে পারেননি। তিনি বলেন, ” বাড়ি থেকে আধ কিলোমিটার দূরে আমরা কয়েকজন মিলে গাছ কাটছিলাম। ওই সময় দেখি বাবা গুটিগুটি পায়ে আমাদের রাখা কুড়াল, হাঁসুয়ার কাছে বসলেন। ওখানে আরও কয়েকজন বসে আমাদের গাছ কাটা দেখছিলেন। বাবা তাঁদের সঙ্গে কথাও বলেন। আমি যান্ত্রিক করাত দিয়ে গাছের ডাল কাটছিলাম। যেহেতু ওপরে বিদ্যুতের তার রয়েছে তাই সাবধানে কাজ করতে হচ্ছিল। নজর ছিল সেদিকেই। হঠাৎই হৈচৈ শব্দ শুনে পেছন ঘুরে দেখি বাবা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রয়েছেন। দৌড়ে গিয়ে দেখি রক্ত ভেসে যাচ্ছে চারদিক। হাত থেকে আলগা হয়ে পড়ে রয়েছে হাঁসুয়া। যারা বসেছিল তারা বলল চোখের নিমেষেই ঘটে গেছে ঘটনাটা। আমরা গলায় গামছা চেপে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করি কিন্তু রক্ত যেন নদীর স্রোতের মত উপচে আসছিল।’
সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ ঘটনাটি ঘটে। তারপরই তাঁকে সবং গ্রামীন হাসপাতালে আনা হয় কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। শ্বাসনালী হাঁ হয়ে গেছে। সবং হাসপাতাল থেকে দেহ সংগ্ৰহ করে পুলিশ ময়নাতদন্তের উদ্দেশ্যে পাঠাচ্ছে। রবিবার রাজ্য জুড়ে শুরু হয়েছে ১৫দিনের লকডাউন। করোনা ঠেকানোর এটাই নাকি মোক্ষম দাওয়াই কিন্তু পেটের ক্ষিদে ঠেকানোর দাওয়াই কোথায়? লকডাউন ঘোষণার দিনই শনিবার সকালেই প্রথম মর্মান্তিক ঘটনার খবর আসে উত্তর দিনাজপুরের হেমতাবাদ থেকে। ৪,৭ ও ১২ বছরের সন্তানসহ স্ত্রী এবং নিজের গায়ে আগুন দিয়ে সপরিবারে পুড়ে মরে গিয়ে মুক্তি খুঁজেছেন এক ভ্যানচালক। সেই ঘটনার ২৪ঘন্টার মধ্যেই এই মর্মান্তিক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটল সবংয়ে।