শশাঙ্ক প্রধান: কেক কেটে হ্যাপি বার্থ ডে গান গেয়ে ফেসবুকে প্ৰগলভতা বা সমাজ মাধ্যমে মুখ দেখানোর পরিবর্তে সমাজ সচেতনতার বার্তা। সন্তানের জন্মদিনে রক্তদান শিবির করে সেই রক্তঋণ শোধের অঙ্গীকার করলেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সবং থানা এলাকার এক দম্পত্তি। সবংয়ের মালপাড় বিবেকানন্দ শিক্ষানিকেতন হাইস্কুল প্রাঙ্গনে এই অন্যরকম জন্মদিনের স্বাক্ষী রইলেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রমাপ্রসাদ ভট্টচার্য্য,মেদিনীপর ছাত্র সমাজের কর্নধার কৃষ্ণ গোপাল চক্রবর্তী,মশগ্রাম শিবানন্দ বিদ্যাপিঠ এর ভারপাপ্ত শিক্ষক শান্তনু অধিকারী,সহকারী প্রধান শিক্ষক দেবাশীষ জানা,অজিত বেরা, সংস্থার সভাপতি বাদল চক্রবর্তী,সম্পাদক গোপাল সামুই প্রমুখরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে ওই দম্পত্তি রামানন্দ দাস অধিকারী ও কৃষ্ণা দাস অধিকারী তাঁদের একমাত্র সন্তান মোহনের জন্মদিনে অন্য আড়ম্বর বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত নেন রক্তদান শিবির সংগঠিত করার। রামানন্দ বলেন, ‘ এই দিনটা আমার কাছে একদিকে যন্ত্রনার ও আনন্দের। আমার বাবার মৃত্যুর কিছুক্ষন পরেই জন্ম হয়েছিল আমার সন্তানের। তখনই আমি ঠিক করেছিলাম দিনটাকে অন্যভাবে পালন করব। জন্মদিনে প্রত্যেক বাবা-মা সন্তানের জন্য দেবতার কাছে মঙ্গল কামনা করেন। আমরা সেটা করার পাশাপাশি গনদেবতার কাছেও আমার সন্তানের জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করছি। ”
তিনি আরও বলেন “এখন করোনা কাল। প্রচুর মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন মহামারিতে যার মধ্যে রয়েছেন নিয়মিত রক্তদাতারাও। ফলে একটা রক্তের সঙ্কট তৈরি হয়েছে। গুরুতর অসুখ, দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তি এমন কি বহু থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুও ভুগছে রক্তসঙ্কটে। এমন অবস্থায় প্রচুর রক্তের প্রয়োজন। সেই জায়গা থেকেই আমি এবং আমার স্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম ছেলের জন্মদিন অন্যভাবে পালন করতে। সেখান থেকেই এই ভাবনা। আজ যে সমস্ত মানুষ আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে রক্তদান করলেন আমরা কৃতজ্ঞ রইলাম তাঁদের প্রতি। আমি এবং আমার স্ত্রী অঙ্গীকার করলাম এই রক্তঋণ আমরা বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ মারফৎ শোধ করে যাব।”
শিক্ষক ও প্রকৃতি বন্ধু শান্তনু অধিকারী বলেন, “এও এক অন্য ধরনের বিপ্লব। ভোগবাদী সমাজে যখন আমিত্ব বোধ আর স্বার্থপরতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে তখন তার বাইরে গিয়ে এধরনের উদ্যোগ অনুপ্রাণিত করবে আরও মানুষকে। হয়ত এ ধরনের সামাজিক কর্মকান্ডই আমাদের ‘আমিত্ব’ থেকে মুক্তি দিয়ে ফের ‘আমাদের’ পথে নিয়ে যাবে। আমি ধন্যবাদ জানাই রামানন্দ দাস অধিকারী ও কৃষ্ণা দাস অধিকারীকে তাঁদের এই মহৎ উদ্যোগের জন্য। মোহনের জন্য আমার অন্তঃকরনের অপার শুভেচ্ছা। ”
পশ্চিম মেদিনীপুরে এই ধরনের ভাবনার অন্যতম অংশীদার অবশ্যই মেদিনীপুর ছাত্র সমাজ। সমাজের সমর্থ্যবান মানুষদের ব্যক্তিগত উৎসব অনুষ্ঠানকে এই ধরনের সামাজিক বীক্ষার দর্শনকে ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁরাই। সন্তানের জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী মায় বিয়ের প্রীতিভোজ পর্যন্ত তারা রূপান্তরিত করেছেন এই ধরনের সমাজ চেতনায়। সেই সংগঠনের অন্যতম কর্ণধার কৃষ্ণ গোপাল চক্রবর্তীকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এই অনুষ্ঠানে। চক্রবর্তী বলেন, ” আমরা কয়েকবছর আগে যখন এই ভাবনা শুরু করেছিলাম তখন পরিসর সামান্য ছিল, মানুষকে এটা বোঝাতে সমস্যা হত যে এই উৎসব অনুষ্ঠানের আসল স্বার্থকতা আমাদের আকাঙ্খার সামাজিক বিনিয়োগে। সেখানেই আমাদের চাওয়ার চূড়ান্ত প্রাপ্তি পাশাপাশি সমাজের কল্যাণ। আজ আমার ভালো লাগছে যে আমাদের ভাবনার অনেক মানুষ এবং সংগঠন রয়েছেন যাঁরা এরকম উদ্যোগ নিয়ে থাকেন।”
রামানন্দবাবু নিজেও একজন সমাজসেবী। তাঁদের প্রতিষ্ঠান ‘ সাধারণ জ্ঞান অন্বেষণ অভীক্ষা এন্ড কালচারাল সোসাইটি’ সবং সহ সন্নিহিত এলাকার পড়ুয়াদের মেধার উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, পরীক্ষা গ্রহণ ইত্যাদি করে থাকে। পাশাপাশি এই করোনা কালে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নানাবিধ কর্মকান্ড করে চলেছে। তারই অন্যতম উদ্যোগ এই রক্তদান শিবির যা পরিচালনা করে এই সোসাইটি। ৫জন মহিলা সমেত মোট ৬০ জন রক্তদান করেছেন রবিবার। রক্ত সংগ্ৰহ করেছেন ডেবরা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কের সংগ্রাহকরা। রক্তদাতাদের তুলে দেওয়া হয়েছে একটি করে গাছের চারা। এই উদ্যোগে রীতিমত সাড়া পড়েছে সংলগ্ন এলাকায়।