🖊️কলমেঃ অরূপম মাইতি
( পর্ব –১৩)
রবীন্দ্র গবেষকদের অনুসন্ধান থেকে স্বদেশী সমাজ গঠনের প্রথম উদ্যোগ থেকে শুরু করে বহু তথ্য জানা যায়। এসব তথ্যের উৎস দ্য় ক্যালকাটা মিউনিসিপাল গেজেটে। ছাপা হয়েছিল ১৯৪১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। সেখানে স্বদেশী সমাজের একটি খসড়া সংবিধান দেওয়া হয়েছিল। লেখা ছিল — আমরা স্থির করিয়াছি আমরা কয়েকজন মিলিয়া একটি সমাজ স্থাপন করিব।
আমাদের নিজের সম্মিলিত চেষ্টায় যথাসাধ্য অভাব মোচন ও কর্তব্য-সাধন আমরা নিজে করিব, আমাদের শাসনভার নিজে গ্রহণ করিব, যে-সকল কর্ম আমাদের স্বদেশীয়ের দ্বারা সাধ্য তাহার জন্য অন্যের সাহায্য লইব না। এই অভিপ্রায়ে আমাদের সমাজের বিধি আমাদের প্রত্যককে একান্ত বাধ্যভাবে পালন করিতে হইবে। অন্যথা করিলে সমাজবিহিত দণ্ড স্বীকার করিব।
সমাজের অধিনায়ক ও তাহার সহায়কারী সচিবগণকে তাঁহাদের সমাজনির্দিষ্ট অধিকার অনুসারের নির্বিচারে যথাযোগ্য সম্মান করিব।
বাঙালী মাত্রেই এ সমাজে যোগ দিতে পারিবেন।
সাধারণত ২১ বৎসরের নীচে কাহাকেও গ্রহণ করা হইবে না।
এ সভার সভ্যগণের নিম্নলিখিত বিষয়ে সম্মতি থাকা আবশ্যক:
১) আমাদের সমাজের ও সাধারণ ভারতবর্ষীয় সমাজের কোনো প্রকার সামাজিক বিধিব্যবস্থার জন্য আমরা গবর্নমেন্টের শরণাপন্ন হইব না।
২) ইচ্ছাপূর্বক আমরা বিলাতি পরিচ্ছদ ও বিলাতি দ্রব্যাদি ব্যবহার করিব না।
৩)কর্মের অনুরোধ ব্যতীত বাঙালীকে ইংরেজিতে পত্র লিখিব না।
৪) ক্রিয়াকর্মে ইংরেজী খানা, ইংরেজি সাজ, ইংরেজি বাদ্য, মদ্যসেবন এবং আড়ম্বরের উদ্দেশ্য ইংরেজ-নিমন্ত্রণ বন্ধ করিব। যদি বন্ধুত্ব বা অন্য বিশেষ কারণে ইংরেজ-নিমন্ত্রণ করি, তবে তাহাকে বাংলা রীতিতে খাওয়াইব।
৫) যতদিন না আমরা নিজেরা স্বদেশী বিদ্যালয় স্থাপন করি ততদিন যথাসাধ্য স্বদেশীচালিত বিদ্যালয়ে সন্তানদিগকে পড়াইব।
৬) সমাজস্থ ব্যক্তিগণের মধ্যে যদি কোনো প্রকার বিরোধ উপস্থিত হয় তবে আদালতে না গিয়া সর্বাগ্রে সমাজনির্দিষ্ট বিচারব্যবস্থা গ্রহণ করিবার চেষ্টা করিব।
৭)স্বদেশী দোকান হইতে আমাদের ব্যবহার্য ক্রয় করিব।
৮) পরস্পরের মধ্যে মতান্তর ঘটিলেও বাহিরের লোকের নিকট সমাজের বা সামাজিকের নিন্দাজনক কোনো কথা বলিব না।
দীর্ঘ সংবিধানে সমাজের কার্যপ্রণালীর খুঁটিনাটি, এমন-কি কর প্রদানের ব্যবস্থাদিও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
রবীন্দ্রনাথের এই স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধটির তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সে সময়। একে আকাশকুসুম রচনা বলেছিলেন কেউ কেউ। ১১ আগস্ট সঞ্জীবনীতে একটি দীর্ঘ সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লিখেছিলেন কৃষ্ণকুমার মিত্র। তিনি লিখেছিলেন, রবীন্দ্রবাবুর ন্যায় একজন শিক্ষিত লোকও রাজশক্তি, সমাজশক্তি ও আমাদের সামাজিক অবস্থা সম্বন্ধে অজ্ঞতা প্রকাশ করিতে পারেন, এবং আকাশকুসুম রচনা করিয়া তাহারই পশ্চাতে ধাবিত হইবার জন্য আহ্বান করিতে পারেন, ইহা আশ্চর্যের বিষয়। বিশিষ্ট কংগ্রস নেতা পৃথ্বীশচন্দ্র রায় শ্রাবণ-সংখ্যা ভারতী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ও সমাজনৈতিক মতামতকে ‘দেশের পক্ষে বিশেষ অনিষ্টকর ও নানা দোষে দুষ্ট’ বলে সমালোচনা করেন। যতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এই প্রবন্ধকে একটি সামাজিক কবিতা বলে উপহাস করেন। এই স্বদেশী সমাজ গঠন কার্যক্রম আর এগোতে পারে নি। গোঁড়া হিন্দুসমাজী ও রাজনীতিকদের বিরোধিতার জন্যই সম্ভবত স্বদেশী সমাজ পরিকল্পনার অপমৃত্যু ঘটে।]
স্বদেশী সমাজের সঙ্গে বিপ্লবীদেরও সম্পর্ক হয়েছিল। এ বিষয়ে বিপ্লবী ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন—
অনুমান হয় ১৯০৫ খৃষ্টাব্দে বারীন্দ্র প্রভৃতি কর্ম্মীদের দ্বারা অনুরুদ্ধ হইয়া আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়কে একটি পত্র লিখি যে, আমরা ভারতীয় সভার (কংগ্রস) সহযোগে কর্ম্ম করিতে প্রস্তুত নই। তাঁহার সহিত সংযুক্তভাবে কর্ম্ম করিতে চাই। ইহাতে তিনি তাঁহার দ্বারকানাথ ঠাকুর ষ্ট্রীটস্থ বাসায় আমাকে আহ্বান করেন এবং বলেন, ‘’আমার ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহিত এই বিষয়ে কথা কও’’…।
ইহাতে সখারাম বাবু, দেবব্রত বাবু এবং আমি সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বালিগঞ্জের বাড়ীতে যাই। তিনি বলিলেন, রবি বাবু আমায় জিজ্ঞাসা করেন, ‘ইঁহারা কাহারা?’’ আমি সব কথা বলি। তিনি বলেন, তিনি বক্তৃতা এবং সাহিত্য দ্বারা কার্য্য করিবেন। ইহাতে সখারাম বাবু ব্যঙ্গ করেন—‘কবিতা লিখিয়া ভারতোদ্ধার হইবে না।‘’ পরে এই সহযোগিতার তাগাদার জন্য ব্যোমকেশ মুস্তফীর সহিত সাহিত্য-পরিষদ অফিসে…আমি সাক্ষাৎ করি।
তিনি ‘স্বদেশী সমাজ’ পরিকল্পনা লইয়া ব্যস্ত ছিলেন। তিনি বলিলেন এই কর্ম্মপদ্ধতি এখনও সম্পূর্ণভাবে লিখিত হয় নাই। লিখিত কর্ম্মপদ্ধতির পাণ্ডুলিপির মুদ্রিত প্রুফ তিনি তৎকালে দেখিতেছিলেন এবং বলিলেন, পরিকল্পনা পূর্ণভাবে তৈয়ারী হইলে পরীক্ষার জন্য একস্থলে তাহা বাস্তবিক কর্ম্মে পরিণত করার চেষ্টা হইবে।..পরে এই দলের কোন এক মিটিং-এ রবি বাবু আমাদের ডাকিয়াছিলেন। আমি তখন ‘ভবানী মন্দির’ পরিকল্পনার উদ্দেশ্যে বিহারে প্রেরিত হইয়াছিলাম। প্রত্যাবর্তন করিয়া অন্নদা কবিরাজের কাছ হইতে ইহা শুনিলাম’ তিনি এই আহ্বানে এই সভায় গমন করিয়াছিলেন। সভায় নানাদল নানাকথা বলে, রবি বাবু তাঁহার দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘আপনার কি মত’! কবিরাজ জবাব দেন, ‘আমরা তর্ক করিতে অক্ষম, কার্য্য দিন, করিতে প্রস্তুত।‘ রবি বাবু বলিলেন, ‘তাহা আমি জানি।‘
(ক্রমশঃ)