✍️কলমে: দীপ মুখোপাধ্যায়
(পর্ব–১২)
কলকাতার মাটিতেই আমার নাড়ি পোঁতা। অবশ্য গ্রাম ছেনেঘেঁটে কৈশোর টপকে এই যৌবনপ্রাপ্তি।পরবর্তীকালে নাগরিক অ্যামিবার এক অখন্ড কোষবিশেষে পরিণতি পেয়েছিলাম। যে নির্দিষ্ট সত্তায় অস্তিত্ববান ছিলাম সেটা পরিবর্তিত মূল্যবোধের শারীর ও মানসে অভিন্ন থেকে গিয়েছিল। সেই যৌবনকালের স্বকীয় নিরুক্তির বিন্যাস আজ অনু-পরমানু উন্মুখ হয়ে অপেক্ষমাণ। আমার চারণভূমির বিস্তৃতি বিশাল।কতদূর ব্যপ্তিতে বিচরণ করেছি বা কোথায় ছেদ ঘটেছে নিবিড় রসসম্ভোগের,সেই বিষয় থেকে বিষয়ান্তরেই আমার যৌবনভ্রমণ। নাগরিক অতিভোগের পরনকথা ফের এক অম্লমেদুর অতীতের দিকে টেনে নিয়ে যায়। আবহমান কৃতকর্মে সনাতনি নিষ্ঠা না থাকলেও যৌবনপ্রদাহে উদ্দন্ড ভোগ করে গিয়েছি কুটিল উৎকেন্দ্রিকতায় নিমজ্জিত হয়ে।অফিসের কাজকর্ম একটা এমন সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে এসেছি যে সই ছাড়া আর কিছুই করতে হয় না। তীব্র বিষণ্নতায় আমার হৃদয়বৃত্তি সামাল দিত মদ্যপান।কন্ঠনালী বেয়ে মদের অন্তর্গমন তথা তজ্জনিত শারীর-মানস কম্পন অনুভূতিতে আমি উথাল- পাথাল। তবু নিজেকে ধ্বস্ত ও ক্লান্ত লাগে।
সেই নিস্তরঙ্গ যৌবনকাল আমার নিরবচ্ছিন্ন স্থৈর্য বিঘ্নিত করলেও শেষতক অন্তহীন অশান্তির দিকে ঠেলে দেয়নি। সদাপ্রসন্ন ও স্নেহপ্রবণ চেয়ারম্যান সাহেব আমার প্রতি অবিশ্বাস্য করুণাবশত হয়ে সাময়িক-বদলি করে দিলেন হলদিয়ায়। কোনও কাজ করতে হবে না। পদাধিকার বলে গাড়ি ও গেষ্টহাউসবাস বহাল থাকল। শাস্তিমূলক এই বিশ্রাম-ব্যবস্থার মূল কারণ আমার পানাসক্তি দূরীকরণ। সেই সময় আমাদের সংস্থা হলদিয়া থেকে তিরিশ কিলোমিটার ডাউনস্ট্রিমে হুগলী নদী সংলগ্ন গাংরাচরে ফেব্রিকেশন ইয়ার্ড বানাচ্ছে। একটি আমেরিকান কোম্পানির সঙ্গে কোলাবোরেশনে অফশোর প্লাটফর্ম নির্মাণ হবে ওএনজিসির বম্বে-হাই ইনস্টলেশনের জন্য। স্থানটা ছিল নন্দীগ্রামের সোনাচূড়া থানার অন্তর্গত। আমি নিজের উদ্যোগে পোর্টট্রাস্টের মহাফেজখানা ঘেঁটে নাম পেলাম মার্কুইস অফ জেলিংহ্যাম নামে এক সাহেবের। যিনি এই ডুবোচরটিকে ড্রেজড স্পয়েল দিয়ে ভরাট করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। আঞ্চলিক ঐতিহাসিক মহেন্দ্র করণ মশাই অবধি এই তথ্য অবহিত ছিলেন না। আমি চেয়ারম্যান সাহেবকে অযাচিত নোট পাঠালাম,আমাদের তিরিশ একর মার্সি সাবমার্জড লিজহোল্ড জমির নাম জেলিংহ্যাম রাখা হোক।ব্যাপারটা সাহেবের মনে ধরল এবং পোর্টট্রাস্টের অনুমতিক্রমে আমার নামাঙ্কন অনুমতিপ্রাপ্ত হলো।
আমিও আহ্লাদে ছন্ন হয়ে হলদি নদীর পাড়ে আয়েস করে সেদিন বসে পড়েছি। চারদিক ঘিরে আছে ম্লান জ্যোছনা। শুনছি নদীর জলের মনকাঁদানো মূর্ছনা।হাতড়ে বেড়াচ্ছি যৌবনের অনুভূতিগুলো।আলোছায়ার লুকোচুরিতে মিলন ও বিচ্ছেদ যেন শরীরের প্রতিটি লোমকূপে প্রবেশ করছে। গলায় ঢালা মদের প্রতিটি বিন্দু তারিয়ে তারিয়ে চাখছি। অবশ্য এই সুখ গোটা শরীর দিয়েই চাখতে হয়। যা জারিত হয়ে মনে,প্রাণে ও আত্মায় এক স্থায়ী অনুভবের সৃষ্টি করে। আর সেই অনুভবই তো আমার যৌবন অন্বেষা।তাই শারীর মানসপথ পাড়ি দিতে দিতে বহতা জীবনের এক নীলকুয়াশার প্রান্তরে এসে পড়ি। যারা কখনও উদাসী হননি তাদের এটা বোঝানো শক্ত যে একাকিত্ব কীরকম নিঃসঙ্গ করে। স্থান-মাহাত্ম অবধি নির্বিকারত্বের কারণ হয়ে ওঠে। চলমান চিন্তার গতি স্তব্ধ হয়। তবে এই আলাপ-বিলাপের বাগবিস্তার অচিরেই যতিচিহ্নপ্রাপ্ত হয় কারণ কর্তৃপক্ষের নির্দেশানুসারে পদোন্নতি সহ প্রত্যাগমন করতে হলো কলকাতার কর্পোরেট অফিসে।
(চলবে)