Homeসাহিত্যরবিয়াণীস্বদেশ-সম্পাদনা-রবীন্দ্রনাথ

স্বদেশ-সম্পাদনা-রবীন্দ্রনাথ

✍️কলমে: অরূপম মাইতি

(পর্ব-৬)

কৈশোর থেকে রবীন্দ্রনাথ ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করতেন। পত্রিকাটি এক দিকে যেমন স্বজাতপ্রীতি ও জাতীয়তাবোধ জাগরণে সমর্থ হয়েছিল, আর এক দিকে তেমনই বিশুদ্ধ সাহিত্য রসের সঞ্চার করে বাংলার পাঠকদের নয়নের মণি হয়ে উঠেছিল। ১৮৭২ থেকে ১৮৭৬ খ্রিঃ প্রথম চার বছর বঙ্কিমচন্দ্র নিজে বঙ্গদর্শন সম্পাদনা করেছিলেন এবং তারপর সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন যথাক্রমে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং শ্রীশ চন্দ্র মজুমদারকে। শ্রীশ চন্দ্রের হাতে পত্রিকার চারটি সংখ্যা প্রকাশের পরে বঙ্কিমচন্দ্রের অসন্তোষে পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। চন্দ্রনাথ বসুর ‘পশুপতি সমাজ’ নামে একটি লেখায় একই সঙ্গে সমকালীন লেখকদের ব্যঙ্গ ও বঙ্কিমচন্দ্রের লেখনশৈলীর অনুকরণ করা হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র তাতে রুষ্ট হয়ে লিখেছিলেন

“শ্রীচরণেষু, অঘোর পাঠককে একটি পত্র লিখিবেন যে মাঘ মাসে বঙ্গদর্শন বাহির করিবার পক্ষে আপত্তি নাই, ভবিষ্যৎ সংখ্যার প্রতি আপত্তি আছে। অর্থাৎ মাঘ সংখ্যা ভিন্ন আর বাহির করিতে দিবেন না। ইহা লিখিবেন। পত্রপাঠ ইহা লিখিবেন। চন্দ্র অপ্রতিভ হইয়া অনেক কাকুতি মিনতি করিতেছে। কিন্তু এটুকু হইলেও বিপদ মিটিবে না।”
১২৯০ বঙ্গাব্দ ফাল্গুন সংখ্যা থেকে বঙ্গদর্শন পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে যে পত্রিকার শুভ সূচনা, শ্রীশ চন্দ্রের হাতে তা বন্ধ হয়। তাই নিয়ে শ্রীশ চন্দ্রের আক্ষেপ কম ছিল না। রবীন্দ্রনাথ নতুন ভাবে বঙ্গদর্শন পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব নিতে, সেই আক্ষেপের অবসান হয়। ‘নবপর্যায়ে বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার নতুন কার্যালয় স্থির হয় শৈলেশচন্দ্র মজুমদারের লাইব্রেরিতে। ১৩০৮ বঙ্গাব্দ বৈশাখে ‘নবপর্যায়ে বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার নিবেদনে শ্রীশ চন্দ্র মজুমদার লিখলেন–
“১২৯০ সালের কার্তিক মাসে বঙ্কিমবাবুর যত্নে সঞ্জীববাবুর হস্ত হইতে বঙ্গদর্শন আমি যখন গ্রহণ করি, শ্রীযুক্ত চন্দ্রনাথ বসু মহাশয় তখন ইহার সম্পাদন কার্যে প্রধান সহায় ছিলেন। …দুর্ভাগ্যবশতঃ অকালে আমি বঙ্গদর্শন বন্ধ করিতে বাধ্য হওয়ায় তাহা কার্যে পরিণত হয় নাই।”
শ্রীশ চন্দ্র এও বলেছিলেন, “বঙ্গদর্শন পুনরুজ্জীবিত হওয়ায় আমার চিরন্তন ক্ষোভ দূর হইল। বঙ্গের প্রধান সাময়িক পত্র যে আমার হস্তে লোপ পাইয়াছিল, ইহাতে আমি বড় লজ্জিত ছিলাম। ইহার পুনঃ প্রতিষ্ঠায় এত দিনে আমি সাহিত্য সংসারে একটি ঋণমুক্ত হইলাম। সুহৃত্তম শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় বঙ্গদর্শনের সম্পাদনা ভার গ্রহণ করাতে স্বীকৃত হওয়ায় আমি নিশ্চিন্ত হইয়াছি।”
যদিও প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গদর্শন সম্পাদনায় মোটেও রাজি ছিলেন না। একটি পত্রে প্রিয়নাথ সেনকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন —

“শৈলেশরা বঙ্গদর্শনের নিদ্রিত কুম্ভকর্ণকে জাগাইবার আয়োজন করিতেছেন – যে জন্যে আমাকেও যথেষ্ট ঠেলাঠেলি লাগাইয়াছেন। এখন দিবাবসানে আমার বিশ্রামের সময় আসিয়াছে – এখন কি সাহিত্যের হাটের মাঝখানে আর বেসাতি লইয়া যাইতে ইচ্ছা করে? এখন ঘরের দিকে মন টানিতেছে। এখন সকল রকমেরই দোকানপাট বন্ধ করিয়া বাড়ি পৌঁছিতে পারলে বাঁচি।”
রবীন্দ্রনাথ যে বঙ্গদর্শন সম্পাদনায় প্রবল অনাগ্রহী ছিলেন আর একটি চিঠি থেকে তা জানা যায় যেখানে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বঙ্গদর্শন ভারতী আবার আমাকে টানাটানি আরম্ভ করেছে – এ সময়ে আমার কিছুতেই বেরোতে ইচ্ছা করচে না। কি করা যায় বল ত? কোথায় পালাই?”
উল্টো দিকে বঙ্গদর্শনের প্রতি তাঁর যে একটা আকর্ষণ ছিল তারও পরিচয় পাওয়া যায় যখন প্রিয়নাথকে তিনি বলছেন, “বঙ্গদর্শন যদি বের হয় তোমাকে ত আসরে নামতেই হবে – হাল বঙ্গদর্শন বৈঠকে তোমার একটা গদিও পড়বেই।”
এইভাবে বহু পীড়াপীড়ির পরে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গদর্শন সম্পাদনার ভার নিয়েছিলেন। সেকথা জানিয়ে জগদীশচন্দ্র বসুকে লিখেছিলেন “বঙ্গদর্শন কাগজখানি পুনরুজ্জীবিত হইতেছে। আমাকে তাহার সম্পাদক করিয়াছে।”
‘নবপর্যায়ে বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার সম্পাদক রূপে, রবীন্দ্রনাথ জোর দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের আদি ‘বঙ্গদর্শন’-এর ভাবনাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে। যদিও এর মধ্যে সমকালীন পটভূমিতে পরিবর্তন এসেছিল তবুও বঙ্কিমের আদর্শকে সময়োচিত করে পত্রিকায় আধুনিকতার উত্তরণ ঘটিয়েছিলেন। চেষ্টা করেছিলেন দুই বঙ্গদর্শনের মধ্যে আত্মিক বন্ধনকে বজায় রাখতে। ‘নবপর্যায়ে বঙ্গদর্শন’-এর সূচনায় লিখেছিলেন
“লোকমনোমোহিনী বহুমুখী প্রতিভার বলে বঙ্গদর্শন প্রতিষথিত; মঙ্গলময়ের মঙ্গলা্র্শীর্বাদে সে প্রতিষ্ঠা রক্ষিত হউক।”
১৩০৮ থেকে ১৩১২ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত পাঁচ বছর রবীন্দ্রনাথ ‘নবপর্যায়ে বঙ্গদর্শন’ সম্পাদনা করেছিলেন। পত্রিকা প্রকাশের পরে পাড়ায় পাড়ায় দুপুরবেলা কারও চোখে ঘুম থাকত না। প্রায় সব বাড়িতে পত্রিকাটি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলায় ব্যস্ত থাকত। এমন অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তার কারণে সে সময় জনমত তৈরিতে পত্রিকাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
নবপর্যায়ে বঙ্গদর্শনে প্রবন্ধ এবং কবিতা লেখার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ নতুন যুগের উপন্যাস লেখা শুরু করেছিলেন। ‘চোখের বালি’ প্রকাশের পরে রক্ষণপন্থীরা অনবরত তাঁর দিকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ছুঁড়তে শুরু করে। ‘সাহিত্য’ পত্রিকা লিখেছিল ‘রবিবাবু এতবড় লম্বা ও এমনতর কুৎসিত উপন্যাসে হাত দিয়ে একেবারেই ভাল করেন নাই।…রবিবাবুর এই বই অতঃপর ‘বঙ্গদর্শনে’ বাহির হওয়া বন্ধ হইলেই বোধহয় ভাল হয়। কারণ তাঁহার এই ‘চোখের বালি’ বঙ্গদর্শনের মুখে চুনকালি মাখাইয়া দিতেছে।’
রবীন্দ্রনাথের ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসটিও বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হয়েছিল। সে উপন্যাস নিয়েও ১৩১১ বঙ্গাব্দ কার্তিক সংখ্যায় ‘সাহিত্য’ পত্রিকা লিখেছিল ‘সম্পাদকের নৌকাডুবি এখনও চলিতেছে। ভক্ত পাঠকগণ নিশ্বাস রুদ্ধ করিয়া ভরাডুবির প্রতীক্ষা করিতেছেন।’
তবে ‘সাহিত্য’ পত্রিকা যাই মন্তব্য করুক না কেন, ‘নবপর্যায়ে বঙ্গদর্শন’ রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় নতুন জীবন পেয়েছিল। এক দিকে যেমন জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরত অন্য দিকে তেমনই ইংরেজ শাসনের তীব্র সমালোচনায় মুখর হত। ‘সাধনা’ ও ‘ভারতী’ সম্পাদনার কাজে রবীন্দ্রনাথকে অধিকাংশ লেখা নিজেকে লিখতে হত, এখানে অবশ্য তা হয়নি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, অক্ষয়কুমার মৈত্র, দীনেশচন্দ্র সেন, জগদানন্দ রায়, সখারাম গণেশ দেউস্কর প্রমুখদের এখানে তিনি সহযোগী লেখক রূপে পেয়েছিলেন।

(ক্রমশঃ)

RELATED ARTICLES

Most Popular