✍️কলমে: দীপ মুখোপাধ্যয়
(পর–৬)
আমার মধ্যেকার বাউলটি তখন ছটফটিয়ে ওঠে।কবিতা,মনকে শক্তিশালী করলেও গান জাগাতো হদয়ের স্পন্দন। শহরের ইট-কাঠ ভেদ করে বাউল আকাশের নীচে এসে দাঁড়ালাম। মনে যেন একটা সমূহ বিস্তার শুরু। এক অজানা স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যেত বাউলমেলা-মোচ্ছবে। নেশাটা ধরিয়ে দিয়েছিল কেঁদুলির জয়দেব মেলা। তারপর কোটাসুর,দধিবৈরাগীতলা,অগ্রদ্বীপ,সোনামুখী,রামকেলি কিংবা ঘোষপাড়ার মতো বহমান পথে-প্রান্তরে।নেশাজর্জর মস্তিষ্ক কিন্তু সুরের মধ্যে আত্মহারা।বাউলের ঘুরন্ত ভঙ্গি কিছুক্ষণ স্থির হয়ে মনের গভীরে তিরতির করে কাঁপে। ঘুঙুর নেচেই চলে। একতারা বঙবঙায়। সেই ভাষা ছড়ায় সমস্ত শরীরে। আমার লাস্য আসে। প্রেম জেগে ওঠে। মানব জ্ঞানভাণ্ডারের ভেতর খুঁজতে থাকি চেতনার মুক্তভাব। গীতগোবিন্দের কবি জয়দেব ততদিনে আমাকে জড়িয়ে ফেলেছে আষ্টেপৃষ্টে। এক বৈষ্ণবী আমাকে দেখে বলেছিল,আমাকে নেবে বাবা? এসো না, মালা-চন্দন করি।
সাধন-সঙ্গিনী প্রতিপালন করার সামর্থ আমার ছিল না। সেটা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিতেই সে বলেছিল,আমি তোমার প্রকৃতি হতে চাই। শিখবে প্রেমতত্ত্ব? বুঝলে গোঁসাই,বাউল সাধনার মূল অর্থ হলো দেহত্তীর্ণ প্রেম।ষটচক্র জ্ঞান না হলে দেহতত্ত্ব বুঝবে কী করে গো?
না,আমি এমন অনুভূতি চর্চা করতে চাইনা। বৈষ্ঞবীর কথা মতো কামগায়ত্রী জপ করে মন স্থির
করাও আমার ধাতে নেই। সাধনাশ্রিত হয়ে বিন্দুকে ঊর্ধ্বমুখী করে সামলে রাখা আমার কর্ম নয়। এটা সাধুগুরু মহাজনরাই পারেন।
প্রেমের কাঙাল হলেও একটা নির্দিষ্ট স্বপ্নে পেছনে ঘুরছি তখনও।পরণে যদিও কমলা রঙের পোষাক।রেখেছি আঁচলা-ঝুলি অবধি। গলায় কৃস্টাল আর পদ্মদানার মালা। লম্বা দাড়ি এবং চুলও বাঁধা ঝুঁটি করে। বুঝতে পারি বাউল আমাকে গ্রাস করতে চাইছে। যেখানে শব্দ,আলো আর সুগন্ধ মিশে আছে পাগল করা গানে।এই অভিজ্ঞতা প্রভাবিত করে আমার মন ও মননকে।অন্তরে আসে একাত্মতা।থিওরিটিকালি দেহের গুরুত্ব আর অন্তরের প্রাচুর্য কিছুটা ঠাওর করলেও সত্যিকারের বাউল খুঁজে পেলাম না।
নুয়ে পড়া শরীর আর অবিন্যস্ত দাড়ি নিয়ে এক বৃদ্ধ বাউল এগিয়ে আসেন আমার দিকে। হাতে বাঁকা হয়ে থাকে একতারা। ভক্তিরসে বিভোর হয়ে সাপের মতো দুলতে থাকেন তিনি।তারপর এক বহমান রাস্তা ধরে কোথায় যেন মিলিয়ে যান নাগালের বাইরে। আমার যৌবনকাল এক সুতোয় গেঁথে নেয় একটা দেখা আর একটা যাওয়া। তখনই মনে হয় বাউলকে কখনও ধরা যায়না।ছোঁওয়া যায়না।সেই মনের মানুষ দূর থেকে শুধু অনুপ্রেরণা যোগায়। আমার ঠোঁট জেগে ওঠে।হাসি বেঁকে যায়। বুকের ওঠাপড়া ধরে রাখে উষ্ঞতা।মুখের স্থির ভাষা আরও নির্লিপ্ত হতে থাকে।
(চলবে)