✒️কলমে: আশিস মিশ্র
————————————-
বৃষ্টিতে গোটা ট্রেনটা ভিজতে ভিজতে চলে যাচ্ছে। এখন ধীরে, খুব ধীরে। তার খোলা জানলায় কনুই-এ মুখ রেখে একটি অচেনা অপরূপা। যেন তার মুখশ্রীতে বৃষ্টিকণা আদর করবে বলেই সে জানলা বন্ধ করেনি ইচ্ছে করেই। ওপাশের জানলার পাশে বসা যুবকটির চোখ সেই দৃশ্যের দিকে তখন। এবার বিকেলের বৈশাখী বৃষ্টি একটু জোরেই এলো। কখন যে তার গন্তব্য এসে গেছে, সেই যুবক জানতেও পারেনি। কিন্তু নামতেই হলো।
তখনও সেই মুখ, তেমনি, দূরে একটু একটু করে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
আজ যে রবিবার। যুবকের যে গানের ক্লাস ছিলো। স্টেশন ছেড়ে যেতে তার পা টানছে না। ওই মায়ামুখের কথা সে ভাবছে। তার মধ্যে দু ভাঁড় চা খতম। একটা ফাঁকা চেয়ারে বসে সে তার মোবাইলে লিখে ফেললো কয়েকটি লাইন—সে যে মায়ামুখ/ বন-হৃদয়ের দিকে চলে যায় / কোথাও দাঁড়ায় না/ সে কি ফিরে আসে?/ সে কি ফিরে আসে না?/ একটি হলুদ রবিবারে এসে/ মনে হলো তার/ সে মুখ তার নয় অজানা, অচেনা..!
বছর ৩০ আগে আমাদের বাঙালি যুবকেরা, যখন লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে অবিশ্বাসে নিজেদের গা ভাসিয়ে দিয়েছে। কবি হওয়ার তীব্র মনোবাসনায় উন্মাদের মতো এদিক -সেদিক চলে যাচ্ছে, আর হঠাৎ হঠাৎ থমকে যাচ্ছে কবিতাকণার কাছে,লিখে ফেলছে এমনি সব হলুদ রবিবারের কবিতা। কেরিয়ার নিয়ে নো চিন্তা, টিউশানি করে,প্রেমে পড়ে,কবিতা লিখে, গাঁটের কড়ি খরচ করে পত্রিকা প্রকাশ করে জীবনকে একপ্রকার ভবঘুরে করে দেওয়া…যখন বুঝতে পারলো, কাব্যি করলে আর পেটে ভাত জুটবে না–তখন সময় অনেকটা গড়িয়ে গেছে। অমলকান্তি তখন রোদ্দুরের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে…
এখন সেই সব দিন নেই। কাজে যাও,ট্রেন থেকে নামো। কেটে পড়ো। বেশিক্ষণ ওই সব মোহময়ীর চোখ দেখলে তোমার গন্তব্যও বিগড়ে যেতে পারে। তাই এখন সকলের মনের ডিসকোর্স বদলে গেছে। আর মেটাফরে ডুবে গেলে, তোমার মনের অলংকারও গিলটিমার্কা হয়ে যেতে পারে। তুমি তো চাইবে, এ জীবনে খাঁটি কিছু হোক। সে তো সব সময় ফড়িংয়ের, দোয়েলের হবে না।
এ বড়ো কঠিন সময়। এখন প্রতিদিন মনে হচ্ছে হলুদ রবিবার। যেন আলাদা রবিবারটি ভ্যানিস। এই রবিবারে ছুটির আলাদা স্বপ্ন, স্বাদ,স্বাধীনতা নেই। আড্ডা নেই। সাহিত্য সম্মেলনে নেই। তাসের প্যাকেট বিছিয়ে নো ট্রাম,টু স্পেড,থ্রি ডায়মন্ড বলার বন্ধু নেই। ফ্যামিলি নিয়ে জলের কাছে, অরণ্যের কাছে, টিলার ওপরে যাওয়া নেই। মাটনের দোকানে লাইন দেওয়া নেই। শিবের গাজনে যাওয়া নেই। মুদ্রিত পাতায় প্রকাশিত সেই সব অসামান্য লেখকদের রবিবাসরীয় লেখা নেই। অনেক কিছুই আর নেই!
তাহলে কী আছে। আছে? একটা ম্যাজিক আছে। বাস্তবের ম্যাজিক। ম্যাজিকের বাস্তবতা। ম্যাজিক রিয়ালিজম। আমরা দূর থেকে সবাই সবাইকে দেখছি। দেখা যাচ্ছে। আবার দেখা যাচ্ছে না। অথচ আমরা আছি। ওই যে সেই মায়ামুখ হারিয়ে গেছে। সে তো হারায়নি। সে তো আছে। দূরে। অদৃশ্যে।
যেমন অদৃশ্যে রয়েছে ওই প্যানডেমিক ঘটানো বস্তুটি। যাকে চোখে দেখা যায় না। তবু সে আছে। আমাদের এই সব রবিবারের চোখগুলিকে এড়িয়ে সে ছুটে চলেছে…তাকে অনেক আগেই কবি দেখেছিলেন। না হলে কেনই বা তিনি লিখতেন–পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন….।
(চলবে)