নিউজ ডেস্ক: গয়ংগচ্ছ আর তল্পিবাহক প্রশাসনের বিরুদ্ধে ছটু রাজোওয়াড়ের উলঙ্গ প্রতিবাদ শেষ অবধি টনক নাড়িয়ে দিল পুরুলিয়ার প্রশাসনের। জেলা জুড়ে দেওয়া তদন্তের নির্দেশ। কিছুদিন আগেই ‘বাংলা আবাস যোজনা’ ও ‘প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা’য় অর্ধসমাপ্ত বাড়িগুলি দ্রুত সম্পূর্ণ করতে সম্প্রতি নির্দেশ দিয়েছিলেন পুরুলিয়ার জেলাশাসক রাহুল মজুমদার। বেগুনকোদর গ্রামপঞ্চায়েতের সামনে প্রশাসনকেই
‘ল্যাংটো’ আখ্যা দিয়ে দিনমজুর ছোটবাবু রাজোয়াড় বা ছোটু রাজোয়াড়ের জামা কাপড় খুলে উলঙ্গ হয়ে প্রতিবাদের ঘটনায় ওই দুই আবাস যোজনায় সঠিক মানুষ বাড়ি পাচ্ছেন কিনা তা দেখতেও জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দিলেন। পুরুলিয়া জেলা প্রশাসনিক সূত্রে এমনটাই খবর। যদিও অফিসিয়ালি এই ব্যাপারে কিছুই জানানো হয়নি।
‘এই পঞ্চায়েত উলঙ্গ, তাই আমিও লেংটা’এই কথা বলতে বলতেই জামা প্যান্ট খুলে নগ্ন হয়েছিলেন; পুরুলিয়ার বেগুনকোদরের ছোটবাবু রাজোয়ার নামে এক বয়স্ক ব্যাক্তি। ‘ল্যাং’টা পঞ্চায়েত’, প্রমাণ করতে; প্রকাশ্যে উল’ঙ্গ হন ছোটবাবু। জেলায় ছোটখাট একটা ‘বিপ্লব’ হয়ে যায় শনিবার বিকালে। পাকা বাড়ি তো দূরের কথা বারবার বলেও বর্ষায় জোটেনি একটা সামান্য কালো তার্পোলিন। গত ১০বছর ধরে জোটেনি আবাস যোজনার বাড়ি। এরপর সামান্য একটা তার্পোলিনও জুটবেনা? প্রতিবাদে ক্ষোভে ফেটে পড়েন ওই প্রৌঢ়। হঠাৎই নিজের জামা কাপড় খুলে ছুঁড়ে ফেলে জানিয়ে দেন, এই প্রশাসন উলঙ্গ, আমিও ল্যাংটা। মুহূর্তে সেল ফোন বন্দী হয়ে সেই দৃশ্য ভাইরাল হয়ে যায় সারা বাংলায়, এমনকি দেশেও। আর তারপরেই জেলা শাসকের এমন নির্দেশ বলে মনে করা হচ্ছে।
শোনা যাচ্ছে এবার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বিভিন্ন ব্লকে আবাস যোজনায় যাঁদের বাড়ি পাওয়ার কথা তাঁদের যারা তালিকায় নাম আছে কিনা, না থাকলে কেন নেই, থাকলে সেই কাজ কতদূর এগিয়েছে ইত্যাদি খোঁজখবর করে দেখা হবে। সঠিক উপভোক্তারা বাড়ি পাচ্ছেন তো? জেলার সমস্ত ব্লকগুলির বিডিও-সহ জেলা ও মহকুমা প্রশাসনের আধিকারিক-দের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য এই আবাস যোজনার মূল দায়িত্বে থাকে গ্রাম পঞ্চায়েত গুলি। সমস্ত কিছু তদারকির দায়িত্ব প্রধান, উপপ্রধান, গ্রাম পঞ্চায়েত সচিবের। যদিও বারবার অভিযোগ উঠেছে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব, স্বজন পোষন এই কাজকে প্রলম্বিত করে। অনেক সময় কাটমানি, কমিশন খাওয়াও চলে। অসহায় গরিব মানুষ, যার হয়ে তদ্বির করার লোক নেই তাঁরা দিনের পর দিন বঞ্চিত হয়ে থাকেন। সেরকমই এক ব্যক্তি এই ছোটু। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আর বছরের পর বছর গড়িয়ে গেছে যার নিজের নামে আবাসন প্রকল্প এসেছে কিনা খোঁজ নিতে নিতে।
ছোটুর এই প্রতিবাদ মনে করিয়ে দিয়েছে কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীর উলঙ্গ রাজা নামের বিখ্যাত কবিতা কিংবা টলস্টয়ের দ্য নেকেড কিং। যেখানে অবোধ শিশুর প্রশ্ন ছিল, রাজা তোর কাপড় কোথায়? সেই উলঙ্গ রাজা যেন আমাদের প্রশাসন। সবাই দেখছে রাজা উলঙ্গ হয়ে সিংহাসনে বসে রয়েছে কিন্তু স্তাবক পরিষদরা বলছে রাজা জমকালো পোশাক পরে আছে। যেমনটা আমরা পৌরসভা থেকে পঞ্চায়েত কিংবা প্রায় সব সরকারি অফিসেই টাকার জন্য হাত পাতা দেখতে দেখতে অভ্যস্থ হয়ে গেছি আর ওটাকেই স্বাভাবিক মনে করছি। কবিতার সেই সারমর্ম যেন উঠে এসেছে পুরুলিয়ার কোটশিলার বেগুনকোদর গ্রাম পঞ্চায়েতে। আর তুলে এনেছে এক অতি সাধারন গরিব, খেটে খাওয়া দিনমজুর ছোটু। স্থানীয় পঞ্চায়েত এবং প্রশাসনের স্থবিরতা ও ধীরগতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠে নিজেকে নগ্ন করলেন বেগুনকোদর গ্রামপঞ্চায়েত ছোটু রাজোয়াড়। বেগুনকোদর গ্রাম পঞ্চায়েতের দপ্তরের সামনেই শরীর থেকে খুলে ফেলে দিলেন সমস্ত বস্ত্র। তাঁর একটাই কথা- ‘ আমার বাড়ি যখন নগ্ন, আমার বাড়ির মহিলাদের বর্ষার হাত থেকে বাঁচতে যখন অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হচ্ছে, আর যেখানে সব জেনেও পঞ্চায়েত নিজেকে অসহায় বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে, সেখানে সব নগ্নতা যখন সামনে বেরিয়ে আসছে, তাই নিজেকে নগ্ন করে দেওয়া ছাড়া উপায়টা কি!
সেদিন কী চেয়েছিল ছোটু? পাকা বাড়ি নয়, একটা কালো তার্পোলিন। ওই একটা একটা তার্পোলিনের জন্য কাকুতি-মিনতি। কিন্তু মেলেনি সেই
তার্পোলিন যা দিয়ে তিনি তাঁর লড়ঝড়ে হয়ে যাওয়া খড়ের চালের উপর আচ্ছাদন দিতে পারেন। অন্তত বর্ষার হাত থেকে ঘরে জল ঢোকাটা বন্ধ করতে পারেন! পঞ্চায়েতের না- স্বাভাবিকভাবেই আঘাত করে ছোটু-কে। দিনের পর দিন বেগুনকোদর গ্রাম পঞ্চায়েতের পরিচালনা নিয়ে ক্ষোভ জন্মেছে ছোটুদের মতো মানুষদের। কারণ, সরকার বলছে বিনামূল্যে রেশন- অথচ, ছোটুর অভিযোগ, সরকারের দেওয়া চারটি রেশন কার্ড বাড়িতে থাকলেও রেশন মিলছে না তাতে। এর বদলে পঞ্চায়েত থেকে ইস্যু করা একটি সবুজ কার্ডে রেশন দেওয়া হচ্ছে।
ছোটুর ঘরে শিশু সন্তানদের ধরে মোট ৬টা প্রাণী। কিন্তু সবুজ কার্ডে মাত্র ১ কিলো চাল ছাড়া আর কিছু মিলছে না। ছোটু জানিয়েছেন, বাধ্য হয়ে বাজার থেকে বেশি দামে চাল কিনতে হচ্ছে। স্থানীয় জঙ্গলে কাঠ, মরা গাছের ডাল-পালা কুড়িয়ে তা বিক্রি করা এবং শ্রমিকের কাজ করে কোনওমতে সংসারের জন্য অন্নের সংস্থান করেন ছোটু। লকডাউনে এই কাজেরও বেহাল দশা। এমতাবস্থায় স্থানীয় পঞ্চায়েতের উদাসীনতায় এখন তিনি ক্লান্ত ও অবশ্রান্ত। তাঁর মতে. এই প্রতিবাদের ভাষা কঠোর না হলে এই পঞ্চায়েতের ঘুম ভাঙবে না।
এমনকী ছোটুর অভিযোগ, দীর্ঘদিন আগে আবাস যোজনায় বাড়ি দেওয়া হবে নাম নথিভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তার এখন পর্যন্ত কোনও পাত্তা নেই। স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান শনি চরণ সিং মূড়া-ও স্বীকার করেছেন যে ২০১১ সালে আবাস যোজনায় বাড়ি দেওয়ার জন্য তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। সেই তালিকা মেনেই ঘর দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাতে ছোটুর নাম আছে কি না তা তাঁর জানা নেই। তবে, ১০ বছর ধরে যে তালিকা রয়েছে তাতে কেন আজও এই প্রকল্পের আওতায় থাকারা ঘর পেয়ে উঠলেন না? এর কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি শনি চরণ সিং মূড়া। অগত্যা উলঙ্গ না হলে ছোটু বোঝায় কী করে গোটা প্রশাসনটাই উলঙ্গ!