নিজস্ব সংবাদদাতা: মাত্র ১রাতের বৃষ্টিতেই বেআব্রু হয়ে গেছে খড়গপুর পুর প্রশাসন, দেখিয়ে দিয়েছে শহর আর শহরবাসীর প্রতি কী পরিমাণ উদাসীনতা নিয়ে থাকেন শহরের দন্ডমুন্ডের কর্তারা। পরের দিন কে কত জলে নেমে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারে তার ফটোশেসন। এক নেতা হাঁটু জল ভাঙেন তো অন্য নেতার পাছায় জল ছুঁয়ে যায়। দলীয় কর্মীরা ফেসবুকে নিজ নিজ নেতার সেই জনদরদী ছবি দিয়ে ক্যাপশন দেয়, হামারা নেতা মহান হ্যায়। সব দোষ গিয়ে পড়ে বৃষ্টির ওপর। বৃষ্টিটাই ভিলেন! আর বাস্তব বলছে নেতাদের চোখের সামনে কোথাও বা নেতাদের প্রত্যক্ষ মদতে, প্রশাসনের কিছু অসাধু আধিকারিকের সাহায্য নিয়ে গোটা খড়গপুর শহর জুড়ে যে পুকুর আর জলাশয় লুট হচ্ছে তারই পরিণাম ভুগতে হচ্ছে খড়গপুর বাসীকে। নেতা আর জমি হাঙর মিলে পুকুর খাচ্ছে আর এখন পুকুর উঠে আসছে খড়গপুরবাসীর দুয়ারে।
নেতা প্রশাসন আর জমি হাঙর কতটা শক্তিশালী ও সক্রিয় তার একটি সহজ উদাহরণ সাঁজোয়ালের ২৪নম্বর ওয়ার্ডের তেলমিলের বাগানবাড়ির অন্তর্গত উধাও হয়ে যাওয়া পুকুরটি। পুকুর ভরাট করে গড়ে উঠেছে ১২০/১২৫টি ফ্লাটবাড়ি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, ওই বাগানবাড়ির অন্তর্ভুক্ত পুকুর এবং সংলগ্ন ডাঙা জমি একই অবস্থানে। ডাঙা জমি ছোট ছোট পল্ট করে কিনেছেন প্রায় ১৫জন মালিক। এই ১৫জন এখনও জমির রেকর্ড করাতে পারেননি কিন্তু পুকুর হস্তান্তরের পর জমির চরিত্র বদল করে মিউটেশন হয়ে বিল্ডিং প্ল্যান পাশ হয়ে আবাসন তৈরী হয়ে গিয়েছে। এই গোটা প্রক্রিয়াদের কারা কারা থাকতে পারে ভাবা খুব কঠিন কাজ নয়।
কৌশল্যা এলাকার এক তৃনমূল নেতা জানাচ্ছেন, ডিএমএস কলেজের রাস্তায় আয়রনমিল সংলগ্ন পালেদের পুকুর বলে পরিচিত পুকুরটি ভরাট হয়ে গেছে আর পাশেই হরনাথ আশ্রম সংলগ্ন পুকুরটি হস্তান্তর হওয়ার পর সেটিকে ভরাট করে ফ্লাট বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। যদিও আমরা প্রাণপন চেষ্টা করছি প্রক্রিয়াটি আটকানোর জন্য। ওই নেতা আরও জানিয়েছেন সিলভার জুবিলী স্কুলও তার নিজস্ব একটি জলাশয় বুজিয়ে ফেলেছে ফলে চূড়ান্ত দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হচ্ছে স্থানীয় মানুষদের।
ইন্দা যফলা রোডের শরৎপল্লী এলাকার এক বাসিন্দা দ্য খড়গপুর পোষ্টকে জানাচ্ছেন, “আমরা বাস করি পূর্ব ইন্দা শরৎপল্লী এলাকায়। অর্থাৎ কমলা কেবিন থেকে পূর্বমুখী যফলা রোড সংলগ্ন অঞ্চলে। ওই রাস্তায় সতীশ মিষ্টান্ন ভান্ডারের বিপরীত দিকে একটি ছোট পুকুর ছিল। তিন চার বছরে ধীরে ধীরে ওটা বোজানো হয়েছে। তার থেকে ৫০ /৬০ মিটার এগিয়ে রাস্তার ডানদিকে বেড়া দেওয়া একটি পুকুর ছিল, ওখানে এক অংশে বাড়ি হচ্ছে। বাকিটা বোজানো চলছে। রাস্তার পাশে ইন্দা বালিকা বিদ্যালয়ের পুকূরটির অবস্থা ও সঙ্গীন, আবর্জনা ফেলে ফেলে উত্তর এবং পশ্চিম দিক অনেকটা বুঝিয়ে ফেলা হয়েছে।” ইন্দা কলেজের সামনের দুটো বড় জলাশয়ের একটি বুজিয়ে বিলাসবহুল দোকানমালা সাজানো হয়েছে। এরপর রাস্তা বরাবর ডানদিকে বাঁদিকে শুধুই নয়ানজুলি ভরাট কাব্য।
পুকুর আর জলাশয়ের আরও একটি সমৃদ্ধ জায়গা ছিল সুভাষপল্লী, ভাবনীপুর। এখানে অতি সম্প্রতি কালীমন্দিরের পেছনের পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। ভাবনীপুরে অনুকূলচন্দ্র আশ্রমের পেছনের পুকুরটি ধিরে ধিরে কব্জা করা হচ্ছে। পাশের মমতাজ পুকুর অর্ধেকের বেশি ভরিয়ে ফেলা হয়েছে। সুভাষপল্লীতে চেষ্টা হয়েছিল পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কিন্তু ধোপে টেকেনি। কৌশল্যা এলাকার ২৫নম্বর ওয়ার্ডে জয়ন্ত দত্তরা এখনও লড়ে যাচ্ছেন পুকুর ভরাট আটকাতে কিন্তু কতদিন লড়তে পারবেন জানা নেই। ছোট ট্যাংরা, ঝুলি, ঝপেটাপুর, গোপালনগর মিলিয়ে ছোট বড় খান ২৫ পুকুর কিংবা জলাশয় ছিল। তার অর্ধেকের বেশি হাওয়া হয়ে গেছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই জল থৈ থৈ করে মহকুমা হাসপাতাল থেকে কৌশল্যা যাওয়ার রাস্তায়। খোদ পৌরসভা কার্যালয় ডুবে যায়। এরপর চলে আসতে পারেন খরিদা, মালঞ্চের উত্তর প্রান্তগুলিতে প্রতিদিনই যেন মৃত্যু গুনছে পুকুর।
গত ১০ বছরে ছোট বড় ৫০টি পুকুর আর জলাশয় উধাও হয়ে গেছে খড়গপুর শহর থেকে আর আরও ৫০টি পুকুর উধাও হয়ে যাবে আগামী ৫বছরেই। এই পুকুরগুলোর কোনওটা অর্ধেক আর কোনওটা এক তৃতীয়াংশ ভর্তি হয়ে গেছে। সারা বছর ধরে শুকোতে শুকোতে এই পুকুরগুলোর জল যখন একদম তলানিতে চলে যেত তখনই হুড়মুড়িয়ে নামত বর্ষা। শহরের জল গিলে খেত সেই পুকুর বা জলাশয় গুলি। মানুষের প্রয়োজনে লুকিয়ে চুরিয়ে একসময় একটা দুটো করে পুকুর বোঝানো শুরু হয়েছিল। তখন লোকলজ্জা ছিল, প্রশাসনের তৎপরতা ছিল, কিন্তু এখন খড়গপুরের ভাষায় ‘খুল্লাম খুল্লা’ পুকুর চুরি হচ্ছে। বহুতল বানাতে, শপিংমল বানাতে জমি হাঙরের দল পুকুর, জলাশয়, নয়ানজুলি ভরাট করছে। নেতার দৌলতে আর প্রশাসনের মদতে রাতারাতি জমির চরিত্র বদল হচ্ছে আর খড়গপুর শহরের জন্য যেন নতুন প্রকল্প হাজির করেছে প্রকৃতি যার নাম, দুয়ারে পুকুর। আমরা শুধু বৃষ্টি আর রেলের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে ক্ষান্ত থেকে যাই।