নরেশ জানা: সাড়ে চার বছর জেল খাটার পর জামিন মিলেছে ১লা এপ্রিল কিন্তু লকডাউনের জন্য বাস মেলেনি বাড়ি যাওয়ার। বন্ধ ট্রেনও আর পুলিশ বলেছে একজনের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারবেনা।ফলে বাড়ি আর যাওয়া হয়নি। অভুক্ত অর্ধভুক্ত হয়ে পড়ে রয়েছেন মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাসেই। অপেক্ষায় আছেন কবে লকডাউন উঠবে, দেখা হবে একমাত্র সন্তান কিশোরী কন্যটির সাথে। জেলে থাকলে দু’বেলা ভাত জুটত, এখন তাও জোটেনা।
পুরুলিয়ার ভোলানাথ সিং। বছর ৪০ য়ের যুবকের গত ৫০দিন ধরে অর্ধাহার আর অনাহারের কবলে পড়ে বারবার একটাই চাইছেন তাঁকে যেন ফের জেলেই ফিরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু জেল বাবুরা বলছেন সে আর হয়না, একবার জামিন পেলে ফের জেলে আসা যায়না। তাহলে কী করবে ভোলানাথ? আর একটা কিছু করে ফের জেলে চলে যাবে?
ঘটনা বছর ৫ আগে পুরুলিয়ার পুলিশ লাইন সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা ভোলানাথ সিংয়ের স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্যর জেরে গায়ে আগুন লাগিয়ে দেন। পরে হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার।
ভোলানাথ বলেন, সংসারে এই মনোমালিন্যর ঘটনা কিছু বিরল নয়, জেদে এবং অভিমানে সে গায়ে আগুন দেয়। মেয়েটি তখন খুব ছোট। পুরুলিয়ার একটি মিলের শ্রমিক ভোলানাথকে শ্বশুরবাড়ির অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ বাদী মামলা চলতেই থাকে। আর মামলা চলতে চলতেই বিচারাধীন বন্দী হিসেবে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে স্থানান্তর। তারপরও কেটে গেছে সাড়ে চার বছর। সম্প্রতি ১ এপ্রিল সরকারি আইনজীবীর বদান্যতায় জামিন পেয়ে জেল থেকে বের হন। বন্দী জীবন থেকে বেরিয়ে পুরুলিয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে গিয়ে আটকে পড়েন লকডাউন এর লক-আপে।
জেল থেকে হাফ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বুঝতে পারেন বাইরে লকডাউন চলছে ,তাই সমস্ত যানবাহন বন্ধ। এরপর বাসস্ট্যান্ডে বসে অপেক্ষা শুরু হয় তার। গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই বাড়িতে থাকা মা ও দুই ভাই কেউই যোগাযোগ করেনি। জগৎ ততদিনে বুঝে গেছেন ভোলানাথ। স্ত্রীর অতর্কিত ওই কান্ড, পরিবারের সদস্যদের নিরুত্তাপ। না জামিন চেয়ে আর আইনজীবী দাঁড় করাননি নিজের পক্ষে। সংসারে কেউ কারও নয়, শুধু একমাত্র কচি দুটো হাত বাড়িয়ে ‘বাবা’ বলে ডাকে একটা আধো গলা। জেলে আসার সময় সেই শুধু খুব কেঁদেছিল। সে আজ কিশোরী, কিন্তু মেয়ের কোনও খোঁজই পাননি ভোলানাথ। ফোন যোগাযোগও করতে পারেননি বাড়ির সঙ্গে । শুধু তারই জন্য জেল থেকে বেরিয়ে একবার পুরুলিয়া যেতে চান।
কিন্তু দেড় মাস ধরে মেদিনীপুর বাসস্ট্যান্ডেই বসে রয়েছেন । বিভিন্ন জায়গায় খাবার চেয়ে এক আধ বেলা খেতে পাচ্ছেন। নয়তো বাসস্ট্যান্ডের ট্যাপ থেকে জল সংগ্রহ করে খেয়ে থাকছেন টার্মিনাসের শেডের তলায় ৷ ভোলানাথ বলেন- ” জেল থেকে বেরিয়ে দেখি বাইরে লকডাউন চলছে ৷ বাস বা কোনো গাড়ি পাচ্ছিনা পুরুলিয়া যেতে ৷ থানায় গিয়েছিলাম , পুলিশ জানিয়েছে-একজনের জন্য কোনো গাড়ির ব্যাবস্থা করতে পারবোনা ৷ দেড় মাস বসে রয়েছি এখানে ৷ যে কোনো ভাবে শুধু একবার বাড়ি ফিরতে চাই মেয়েটাকে দেখার জন্য ৷ ওর কোনও খোঁজ পাইনি সাড়ে চারবছর ৷”
ভোলানাথের দাবি লকডাউনের পরিস্থিতির থেকে জেল জীবন অনেক ভালো ছিল । আর যাইহোক ভেতরে খেতে পাওয়া যেত। এত কষ্ট জেলের ভেতর নেই। তাই এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার হওয়ার জন্য পুলিশের দ্বারস্থ পর্যন্ত হয়েছিলেন। কেউই কোনো রাস্তা বের করে দিতে পারেনি। কখনো খেতে পান, কখনও মেদিনীপুর হাসপাতালের সামনে গিয়ে কেউ খাবার বিলি করলে সেখান থেকে খাবার সংগ্রহ করে খেতে পাই ৷ কখনো আবার টার্মিনাসের জল পুরনো প্লাস্টিকের বোতলের সংগ্রহ করে তা খেয়েই পড়ে থাকতে হয় অভুক্ত অবস্থায়।
ভোলানাথ বলেন, ” আমার বাড়ি যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।এ পৃথিবীতে আমাকে কারও প্রয়োজন নেই তাই চলে যেতে পারতাম যেখানে খুশি। শুধু একবার তাকে দেখতে চাই। এখন সে বড়, এখন সেও হয়ত সবার মত শিখে গেছে যে তার বাবা একটা খুনি। হয়ত সে আমাকে চিনতেও চাইবেনা, স্বীকার করতে চাইবেনা আমাকে বাবা বলে। তবুও, কাছে যাবনা শুধু একবার দুর থেকেই না হয় দেখব তাকে…….।” মেদিনীপুর বাস টার্মিনাসে বসে থাকে যেন রবীন্দ্রনাথের সেই কাবুলিওয়ালা, আরাকান পর্বতমালার ওপারে যে তার মেয়ের মুখটি দেখার অপেক্ষায় দিনভর প্রতীক্ষায় থাকে আর জেল থেকে বেরিয়ে ভাবে তার মেয়ে তাকে আর চিনতে পারবে তো?