পলাশ খাঁ, গোয়ালতোড় :- সাধারণ বনরক্ষক থেকে হয়ে উঠেছিলেন তন্ত্র সাধক। পরে মায়ের স্বপ্নাদেশে গ্রামে ফিরে এসে শুরু করেছিলেন মা মনসার পুজো। সাধক ঋষি খাঁ এর শুরু করা সেই মনসা পুজো এখন সাড়ম্বরে পালিত হয় শালবনীর দেবগ্রামে। যা বর্তমানে গ্রামবাসীর পুজোতে পরিনত হয়েছে।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনীর দেবগ্রামে দীর্ঘ নয় দশক ধরে মা মনসা পূজিতা হন সাড়ম্বরে। আশ্বিন মাসের সংক্রান্তি তিথি যা ডাক সংক্রান্তি নামে পরিচিত সেই তিথিতে গোটা গ্রাম জুড়ে চলে উৎসবের আয়োজন।
মায়ের বর্তমান সেবক তথা গ্রামেরই বাসিন্দা আদিত্য খাঁ জানান, ” আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগের কথা। ব্রিটিশ দের পরাধীনে রয়েছে ভারতবর্ষ। সেই সময় গ্রামেরই এক যুবক ঋষি খাঁ জনৈক এক গাছ মহাজনের কাছে বন রক্ষকের চাকুরী নিয়ে আসাম যান। সেখানে বন রক্ষকের কাজ করতে করতেই একদিন সেই মহাজনের সাথে মা মনসার লীলা ক্ষেত্র কাউর কামাক্ষ্যা তে যান ঘুরতে। সেখানে যাওয়ার পর তার মনে এক পরিবর্তন ঘটে। শোনা যায় সেই মহাজনের কাছে বনরক্ষকের কাজ ছেড়ে দিয়ে তিনি কামাক্ষ্যাতেই থেকে যান মা মনসার তন্ত্র সাধনা করার জন্য। দীর্ঘদিন ধরে সেখানে তন্ত্রসাধনা করে এক যোগী পুরুষ হয়ে উঠেন। তারপরই মায়ের স্বপ্নাদেশ পান নিজের গ্রামে ফিরে গিয়ে তার নাম মাহাত্ম্য প্রচার করার। মায়ের সেই আদেশ শিরোধার্য করে তিনি গ্রামে ফিরে আসেন। পরে গ্রামের মাঝে প্রচীন এক বেল গাছের নিচে বাকুড়ার পাচমুড়া থেকে হাতি ঘোড়া নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করে শুরু করেন মা মনসার পুজো। তবে তিনি তন্ত্রসাধক থাকার কারনে বেশীরভাগ সময়টা কাটাতেন শ্মশানে। তাই মায়ের ঠিকঠাক দেখভাল করার জন্য এক ব্রাহ্মণ কে দিয়ে মায়ের পুজোর ব্যাবস্থা করেছিলেন৷ কিন্তু মা তাতে সন্তুষ্ট নন। তাই ফের তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে তার হাতেই পুজিতা হতে চান বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেন৷ তাকে ফের দুবছরের মাথায় ব্রাহ্মণ পুজক বাদ দিয়ে ঋষি খাঁ নিজেই পুজো করতে শুরু করেন৷ পরে তার অবর্তমানে তার ভাই গোবর্ধন খাঁ , পুত্র মথুর খাঁ পুজো করেন। বর্তমানে পুজো করেন আদিত্য খাঁ । কালের নিয়মে প্রাচীন সেই বেলগাছ অাজ পঞ্চভূতে বিলিন হয়ে গিয়েছে৷ সেই স্থানে গড়ে উঠেছে কংক্রিটের মন্দির।
ঋষি খাঁ এর শুরু করা পুজো এবার নব্বই বছরে পদাপর্ণ করছে। পুজো উপলক্ষে দুই ধরে চলে পুজো পাঠ ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পুরানো রীতি অনুযায়ী এখনো প্রতিবছর পাচমুড়া থেকে নতুন হাতি ঘোড়া এবং পোড়া মাটির মায়ের প্রতিমা আনা হয়। বিকেলে গোটা গ্রামের মানুষ একত্রিত হয়ে শাখী গান গাইতে গাইতে গোটা গ্রাম প্রদক্ষিণ করে গ্রামের শেষ প্রান্তের এক পুকুর থেকে বারি ডুবিয়ে ফের মন্দিরে ফিরে এসে শুরু হয় মায়ের পুজো। সারারাত ধরে চলে পুজো। পরের দিন গোটা গ্রামের মানুষ এসে মন্দিরে ভিড় জমান পুজো দেওয়ার জন্য। তবে এখানে পুজো বৈষ্ণবী মতে হওয়ার কারনে বলি প্রথা নেই।
কিন্তু এবার করোনা কেড়ে নিয়েছে মানুষের জীবন থেকে উৎসব আনন্দ। বাদ যায়নি দেবগ্রামের বাসিন্দারাও। তাই এবার অন্যান্য বছরের মতো সাড়ম্বরর হচ্ছে না মা মনসার আরাধনা। নিয়ম মাফিক সব কিছু হলেই এবার মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে মন্দিরে অযথা ভীড় না জমানোর অনুরোধ করা হয়েছে গ্রামবাসীদের। আরা যারা মন্দিরে আসবেন তাদের প্রত্যেকেই অবশ্যই মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যাবহার করতেই হবে।