অশ্লেষা চৌধুরী: ‘কাউকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এভাবে অপমান করা যায় না। এটা রাজনৈতিক নয়, সরকারি অনুষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে কড়া বার্তা দিয়ে আর কোনও রকম বক্তব্য না রেখেই পোডিয়াম ছেড়ে নেমে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে ২৩শে জানুয়ারি শনিবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের অনুষ্ঠানে এই অপ্রীতিকর ঘটনাটি ঘটে।
নেতাজীর জন্মদিবস উপলক্ষ্যে এদিন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দু’জনেই। শুরুটা হয়েছিল ভালভাবেই। প্রধানমন্ত্রীকে উত্তরীয় পরান মুখ্যমন্ত্রী। তাঁরা একসঙ্গে ঘুরে দেখেন নেতাজি গ্যালারি। দেখেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কিন্তু এরপর মুখ্যমন্ত্রী বক্তব্য পেশ করার জন্য মঞ্চে উঠতেই ছন্দ কাটে। আসলে মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চে ওঠার সময়কালেই দর্শকদের মাঝখান থেকে ভেসে আসতে থাকে জয় শ্রী রাম ধ্বনি। আর তাতেই ভীষণ অপমানিত বোধ করেন মমতা।
ক্ষুদ্ধ হয়ে তিনি বলেন, ‘কাউকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এভাবে অপমান করা যায় না। এটা রাজনৈতিক নয়, সরকারি অনুষ্ঠান। সরকারি অনুষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষা করা উচিৎ। এটা কোনও রাজনৈতিক দলের অনুষ্ঠান নয়। কলকাতায় এই অনুষ্ঠান করার জন্য আমি প্রধানমন্ত্রী ও সংস্কৃতি মন্ত্রককে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু প্রতিবাদ জানিয়ে আমি বক্তব্য রাখছি না।’ এরপর ‘জয় হিন্দ, জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মঞ্চ ছেড়ে নিজের আসনে গিয়ে বসে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী।
সফরসূচি অনুযায়ী, এদিন নেতাজি ভবন থেকে প্রথমে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যান প্রধানমন্ত্রী। নেতাজির মূর্তিতে পুষ্পার্ঘ্য দেন। বিকেল ৪টে ১৪ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী পৌঁছন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। সরকারি অনুষ্ঠান হলেও, আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী-সহ বিজেপি নেতারা। প্রধানমন্ত্রীকে অভিবাদন জানিয়ে তাঁকে প্রণাম করেন শুভেন্দু। কিছুক্ষণ পরে ভিক্টোরিয়ায় পৌঁছন মুখ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাঁকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। এরপর একসঙ্গে নেতাজি নামাঙ্কিত গ্যালারি ঘুরে দেখেন তাঁরা। কিছুক্ষণ পর পরীঘরের সামনে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে নেতাজি পত্রাবলী নামে একটি বইয়ের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর নেতাজি স্মারক ডাকটিকিট এবং স্মারক মুদ্রা প্রকাশ হয়।
কিন্তু এই সব কিছুর মাঝে ব্যাঘাত ঘটায় জয় শ্রী রাম স্লোগান। বক্তব্য না রেখেই নিজের আসনে ফিরে যান মুখ্যমন্ত্রী। তবে এই বিষয়টি ভালো চোখে দেখেননি পদ্ম শিবিরের নেতারা। কৈলাস বিজয়বর্গী ট্যুইটারে নিজের প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে লিখেছেন, ”জয় শ্রীরাম স্লোগান তো মুখ্যমন্ত্রী সহ্যই করতে পারছেন না, এ কেমন রাজনীতি!” সায়ন্তন বসুর বক্তব্য, ”জয় শ্রীরাম বা জয় মা তারা – যে স্লোগানই উঠুক না কেন, মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ না দিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে যাওয়া কাম্য নয়।”
তবে এই বিষয়ে মমতার পক্ষ নিয়েছেন বাম-কংগ্রেস নেতারা। বাম নেতা মহম্মদ সেলিমের প্রতিক্রিয়া দিয়ে জানান, ”রাজনৈতিক দিক থেকে আমাদের আদর্শ পৃথক হতেই পারে। তবে কেন্দ্রীয় সরকারি অনুষ্ঠানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে এ ধরনের স্লোগান নিন্দনীয়, কুরুচিকর। এতে বোঝা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের অনুষ্ঠানের দর্শক আসন কারা ভরিয়েছেন।” এ নিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর মত, ”উনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তাই ওঁকে অপমানিত হতে দেখলে খারাপ লাগে। যা হয়েছে, তা কাম্য ছিল না। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুখ্যমন্ত্রীকে অপমান করা হয়েছে।“
একই সুরে সুর মিলিয়েছেন তৃণমূল নেতা কুনাল ঘোষ, ”একটা সরকারি অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক স্লোগান! ভাবা যায়? এতে রুচিবোধের পরিচয় ঘটে, সংস্কৃতিবোধের অভাব স্পষ্ট হয়। ওঁরা জানেন না, নিজেরাই নিজেদের কতটা ছোট করলেন।” তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, ”নেতাজির জন্মদিনে কেন্দ্রীয় সরকারে অনুষ্ঠানে দলীয় স্লোগান উঠছে। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, কারা বাংলার গৌরব, মনীষীদের সম্মান ভূলুণ্ঠিত করছে। বাংলার মানুষজন এই দৃশ্য দেখলেন। তাঁরা বাকিটাও বুঝে নেবেন। এই স্লোগান তুলে কার্যত মুখ্যমন্ত্রীকে অপমান করা হল। নিন্দনীয় ঘটনা।”