নিজস্ব সংবাদদাতা: শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৮টা নাগাদ যখন সবং থানার তেমাথানিতে এসে পৌঁছালেন তখন গোটা শরীর অবসন্ন, হাত আর পা সহ সারা শরীর ছিঁড়ে যাচ্ছিল যন্ত্রনায়। তেমাথানিতে সবং থানার পুলিশ আর স্থানীয় সবং পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ পার্থ প্রতিম মাইতি সহ কিছু মানুষ খাবার দাবার ও জলের ব্যবস্থা করেছিলেন। বাড়ি তখনও প্রায় ১২ কিলোমিটার। রাস্তার পাশেই শরীর এলিয়ে দিয়ে পড়ে রয়েছেন ১৭ বছরের সৈকত মাইতি আর ৩০ বছরের শুভেন্দু মান্না। হায়দ্রাবাদের থেকে হেঁটে এসেছেন তাঁরা। হেঁটেছেন গত ১৪ দিন ধরে। মাঝখানে অবশ্য ওড়িশার ভদ্রক পুলিশ এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের সীমান্ত মোহনপুর অবধি।
রাত ১২ টার সময় শুভেন্দুর সাথে ফোনে দ্য খড়গপুর পোস্ট যোগাযোগ করলে শুভেন্দু জানান, ”আজ আর কথা বলার মত অবস্থায় নেই আমরা। মাঝের ৩০০ কিলোমিটার পথ বাদ দিলে পুরো রাস্তাই হেঁটে এসেছি। শরীর চলছেনা, কাল কথা হবে।” সবং থানার বুড়াল গ্রামপঞ্চায়েত এলাকার শীতলদা গ্রাম, যেখানে তাঁদের বাড়ি সেখান থেকে কিছুটা দুরে মাঠ ঘরে ঠাঁই নিয়েছেন দুজনে। রাতে বাড়ি ফিরেও বাড়ি ঢোকা হয়নি। তেমাথানি থেকে বাকি পথটা যদিও বাইকে করে তাঁদের নিয়ে গেছিলেন এক যুবক।
৯ বছর পার হতে চলল মা-মাটি-মানুষের সরকারের। মূখ্যমন্ত্রী হয়ত জানতেই পারেননা কোথায় আছে মানুষ। কথা ছিল এরাজ্যের মানুষকে বাইরে যেতে হবেনা কিন্তু সেকথা বলছেনা শীতলদা গ্রামের সৈকত মাইতির পরিবার। মাত্র ১৭ বছর বয়স। অসীম দারিদ্র্যের জন্য ক্লাশ নাইনেই পড়াশুনার ইতি। ঝুপড়ি বাড়িটাতে কার্যত হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হবে। সংসার বাঁচাতে তাই শুভেন্দু মান্নার সাথে হায়দ্রাবাদ পাড়ি দিতে হয়েছিল তিনমাস। কিশোর সৈকতের পা ফুলে ঢোল, ফোস্কা পড়ে লাল।
শুভেন্দু জানালেন, ”মানুষ শখে নিজের জায়গা ছেড়ে অন্যত্র যায়না কাজ করতে। তিনমাস আগে একজন পরিচিতর মাধ্যমে খোঁজ পাই এই নির্মাণ সংস্থার। বিভিন্ন কোম্পানির আবাসন, অফিস ইত্যাদি বানায় এরা। একাই যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু খবর পেয়ে সৈকত কাকুতি মিনতি করে ওকেও নিয়ে যাওয়ার জন্য।এরপরই দুজন রওনা দিই। হায়দ্রাবাদের নালেগোন্ডার নিলমপুরী এলাকায় কাজ চলছিল। মাস দুয়েক কাজ করার পরই শুরু হল লকডাউন। প্রায় ২৫দিন অসহনীয় অবস্থার মধ্যে কেটেছে। টিনের চালের নিচে ঝুপড়িতে কাটিয়েছি। আস্তে আস্তে পয়সা শেষ হতে শুরু করল। বাড়ির জন্য কিছু টাকা বাঁচানোর দরকার কারন না খেতে পেয়ে মরার অবস্থা এদিকেও। তাই হেঁটেই বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেই। তারপর থেকে হাঁটছি।”
বাড়ি ফিরে অবশ্য বাড়ি ঢোকা হয়নি শুভেন্দু আর সৈকতের। পুলিশ এবং পঞ্চায়েত সতর্ক করে দিয়েছিল বাড়িতে থাকা যাবেনা। নিজেরাও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মাঠ ঘরেই থাকবে কারন বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা মা, ছোট বাচ্চারা রয়েছে। তাই ধানের ক্ষেতে জলসেচের জন্য যেখানে পাম্প রাখার ঘর রয়েছে সেই মাঠ ঘরেই রাতে চলে যায় তারা। আপাতত সেখানেই আছে, কোয়ারেন্টাইনে। বাড়ির লোক খাবার আর জল পৌঁছে দিচ্ছেন। এখনও শরীর অবসন্ন গায়ে হাতে ব্যথা তবুও স্বপ্ন সেই হায়দ্রাবাদেরই। লকডাউন উঠলে আবারও সেখানেই যেতে হবে। এখানে কাজ কোথায়? জানালেন সৈকত।