Homeএখন খবরউচ্ছন্নেই স্থিত হল বিদ্রোহিনী রানীর গ্রাম, চোখের জলে প্রথম ত্রান দেখল ৭০টি...

উচ্ছন্নেই স্থিত হল বিদ্রোহিনী রানীর গ্রাম, চোখের জলে প্রথম ত্রান দেখল ৭০টি পরিবার

নিজস্ব সংবাদদাতা: কানের পাশ দিয়ে তিনদিন আগেই চলে গেছে উমপুন। চাল ওড়েনি ঘরের কিন্তু ঘুম উড়ে গিয়েছিল গ্রামের। গ্রাম বলছি বটে তবে ভাঙা চোরা ছিটে বেড়ার বাড়িই বেশিরভাগ। উমপুন তাই ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল গ্রামে। যে ঝড় পেরিয়ে যাওয়ার পর শনিবার রাতে খবর এল উচ্ছন্ন আসছে। শুনে অবস্থা আরও খারাপ গ্রামের বুড়ো বুড়িদের। ভাবল এও বুঝি নতুন কোনও ঝড়ের নাম, উমপুনের পর উচ্ছন্ন। ভয় ভাঙল অবশ্য গাঁয়ের যুবকদের কথায়। তারাই জানালো উচ্ছন্ন আসলে একটা হোয়াটস্যাপ গ্রুপ। ত্রান নিয়ে আসছে তারা।

এবার ভয় কাটিয়ে বিস্ময় হওয়ার পালা! পাক্কা দু’মাস হল লকডাউনের। এই দু’মাসে ত্রান কাকে বলে দেখেনি গ্রাম অথচ মেদিনীপুর শহরের গা ঘেঁষেই শিরোমনি গ্রামপঞ্চায়েত। শিরোমনি নামটা শুনলেই কেমন কেমন লাগে নিশ্চই। ঠিকই ধরেছেন ঝাঁসির রানীরও আগে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরা মহিলার নাম রানী শিরোমনি, রাজা অজিত সিংহের স্ত্রী যিনি তাঁর স্বজাতি আর প্রজাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ইংরেজ শাহীর বিরুদ্ধে। কর্নগড়ের রানী ‘ছোটজাত’ বলে ইংরেজরা এই বিদ্রোহের নাম দিয়েছিল চুয়াড় বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহী রানীরই জন্মভূমি এই গ্রাম আর তাঁরই নামে শিরোমনি গ্রামপঞ্চায়েত। সেই গ্রামপঞ্চায়েতেরই ধরমপুর গ্রাম। রানী গেছেন, ইংরেজও গেছে কিন্তু দারিদ্র গেল কই? রানীর স্বজাতিদের আজও ভরসা বাবুর ঘরে মুনিশ গিরি অথবা ক্ষেতমজুরি আর শহরে গিয়ে দিনমজুরি। লকডাউনে সে সব পাট চুকেছে। উঁকি মেরে দেখেনি শহর। দেখল সেই উচ্ছন্ন।

২০১৫ সালে দু’চার বন্ধু মিলে গড়ে তোলা একটা হোয়াটস্যাপ গ্রুপের নাম “উচ্ছন্ন”। মজা করেই শুরু হয়েছিল গ্রুপ। মেদিনীপুর শহরের পঞ্চুর চকের পান স্টলের মালিক স্বপন বেরা আর দু’য়েক জন মিলে নেহাৎই বিনোদনের জন্য চ্যাংড়া ছোকরা দের তৈরি সেই গ্রুপের সদস্য সংখ্যা এখন আড়াইশ ছুঁইছুঁই। হকার, বেকার, ডাক্তার, শিক্ষক, সাংবাদিক, মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটিভ কে নেই গ্রুপে। রবিবার সকালে এই উচ্ছন্নের উদ্যোগেই ত্রান বিলি করা হল বিদ্রোহিনীর জন্মভূমির মাটিতে। ধরমপুর গ্রামের ৭০টি অসহায় দুঃস্থ পরিবারকে ডাল,সোয়াবিন, তেল, হলুদ, ছাতু,বিস্কুট, চিনি, সাবান,লবন ও ওআরএস দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে নজির সৃষ্টি করল তারা।

গ্রুপ আ্যডমিন স্বপন বেরা জানালেন, “প্রায় প্রত‍্যেক সদস‍্যই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সদস্যদের মধ্যে যারা অনেকেই দূরে থাকেন তাঁরা অনলাইনে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন। লকডাউনের এই চতুর্থ পর্বে মানুষের কর্মহীন বেরোজগার পরিস্থিতির উপলব্ধি থেকেই এই প্রয়াস।এই সময় দুমুঠো খাদ্য সামগ্রী মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরে আমরা কৃতজ্ঞ।”
উচ্ছন্নের আরেক সদস্য মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটিভ সৌরভ ঘোষ জানালেন, ‘আমরা এর আগেও কিছু কাজ করেছি। যেমন কেরলের বন্যার সময় ওখানকার ত্রান তহবিলে কিছু দান করেছিলাম। তবে আজকের কাজ করে খুব ভাল লাগছে। মানুষের এত কাছে গিয়ে তাঁদের জন্য সামান্য কিছু করেও যে এত আনন্দ পাওয়া যায় তা আজ বুঝতে পারলাম।”

পরে আরও কী কী করা যায় তারই একটা পরিকল্পনা ছকতে ছকতে ফিরছিলেন সদস্যরা।   দুপুর গড়িয়ে গ্রাম থেকে বেরুতে বেরুতে আলো পড়তে শুরু করেছিল। গ্রামের শ্রীমন্ত দোলাই, পরেশ সাঁত, পলাশ দোলাইদের চোখে জল। এই উচ্ছন্নের জন্য কেউ কাঁদছে। শ্রীমন্ত বলেন, “আমরা তো ভেবেছিলাম আমাদের ভুলেই গেছে সবাই। এই যে শুনছি ওখানে ত্রান যাচ্ছে, সেখানে যাচ্ছে। অমুক নেতা তমুক বাবু, পুলিশ, রাজনৈতিক দল কাউকেই দেখিনি এই গ্রামে আসতে। এই প্রথম কাউকে দেখলাম কেউ এগিয়ে এল আমাদের জন্য।”

গ্রাম ছড়িয়ে আরেকবার দাঁড়াতে হল উচ্ছন্নকে। কতগুলো যুবক দৌড়ে আসছিল। কাছে এসো বলল, ” দাদা আমরাও উচ্ছন্নে যাব। আমাদেরও আ্যড করে নিন।” এই প্রথম কাউকে নিজে থেকেই উচ্ছন্নে যাওয়ার কথা শুনল স্বপন,সৌরভরা। চটপট নম্বর গুলো নিয়ে নেয়। গ্রুপের সদস্য আরও বাড়াতে হবে, আরও কাজ করতে হবে যে। উচ্ছন্নে যাওয়ার এত আনন্দ আগে কখনও পায়নি “উচ্ছন্ন”।

RELATED ARTICLES

Most Popular