নিজস্ব সংবাদদাতা: আর পাঁচটা দিনের মতই নিজের কমরেডদের নিয়ে নির্বাচনি প্রচার করছিলেন গড়াবেতা বিধানসভা কেন্দ্রের সংযুক্ত মোর্চা সমর্থিত সিপিএম প্রার্থী তপন ঘোষ। একটার পর একটা পাড়া গ্রাম ঘুরে ঘুরে মানুষের কাছে যাওয়া। বনকাটির গ্রাম পেরিয়ে যাচ্ছিল প্রচারের দলটা। সামনে তপন ঘোষ, পেছনে লাল পতাকা নিয়ে তাঁর কমরেডরা। ফাল্গুনের চড়া রোদ চুঁইয়ে পড়ছে খর তাপ হয়ে। কোলাহল শুনে সেই রোদের মধ্যে হেঁটে দুয়ারের বাইরে এসে দাঁড়ান বৃদ্ধা মানুষটি। দাঁত পড়ে গেছে প্রায় সব। পা অশক্ত, তবুও টলতে টলতে আসেন মিছিলের সামনে। হাত কুলোয়না, লম্বা দীর্ঘদেহী শ্যমবর্ন মানুষটির দিকে। নিজেই মাথাটি নিচু করেন তিনি বৃদ্ধার সামনে দাঁড়িয়ে। বৃদ্ধা প্রথমে মাথায় হাত বুলান তারপর চিবুকটা নেড়ে দিয়ে একটি চুমু খান নিজের হাতেই। পাশের একজন হাসেন। ছানি পড়া চোখের বৃদ্ধার প্রতি কৌতুক ঝরে পড়ে। জিজ্ঞাসা করেন, কে বলত দিদা? বৃদ্ধার চোখে কপিট রাগ। বলেন, কী ভাবলি চিনতে পারিনি? লকডাউনে আমার দরজায় কড়া নেড়েছিল রে! তপন ঘোষ।
করোনাকে কেউ কেউ ভুল করে করুণা বলেই ডাকতে পারেন। গ্রামের মানুষ, নতুন শব্দ হৃদয়ঙ্গম করতে, উচ্চারন করতে ভুল হতেই পারে কিন্তু লকডাউন শব্দে কারও ভুল হয়না। আপামর জনতার নাড়ি ধরে টান মেরেছে লকডাউন! সরকার তো লকডাউন ঘোষনা করেই খালাস। কিন্তু ভাষণবাজির শেষে রেশন কই? যাঁদের কার্ড রয়েছে ডিলারের কাছ থেকে প্রথম চাল পেতে তাঁদের সময় লেগেছে ১৫ দিন থেকে ১মাস! আর যাঁদের কার্ড নেই? নতুন কার্ড হয়নি কিংবা হারিয়ে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে? আর ১৫দিন পরে যাঁরা রেশন পেল তার আগের ১৫দিন তাঁরা কী খাবে? কী খাবে? কী খাবে কুন্ডলগেড়িয়া, কীর্তনবাড়, অর্জুনবাড়, তিলবেড়িয়া, কুলবেড়িয়া কিংবা নিজামপাড়া, মাঝিপাড়া, নায়েকপাড়া? অথবা মৌলাড়া, জগারডাঙ্গার একের পর এক গ্রাম? না, কেউ ভাবেনি, ভাবলেন ৭% হয়ে যাওয়া সেই তপন ঘোষ, দিবাকর ভূইঁয়া, সামাদ গায়েন, সরফরাজ খানের মতই মানুষরা।
২২শে মার্চ এক লম্বা চওড়া ভাষণ আর থালি বাজানোর আহ্বান জানিয়ে দেশ ব্যাপী লকডাউন শুরু আর ২৫শে মার্চ সারা পশ্চিমবাংলার বিস্ময় জাগিয়ে গড়বেতায় শুরু হল রসদ বিলির কাজ। গরিব ক্ষেতমজুর, রিকশা চালক, টোটো চালক, অটোচালক, পান দোকানি, সবজি দোকানি, ফুটপাতের হকারদের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছাতে শুরু করল ২কেজি চাল, ডাল, আলুর প্যাকেট। গড়াবেতা বিধানসভা এলাকার ১৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ২৫৯টি বুথের হাজার হাজার পরিবারে পৌছে গেল রেশন।
তখন কোথায় সরকার কোথায় হাই পার্সেন্টেজ পাওয়া রাজনৈতিক দল? কিছুদিন এরকমই চলল কিন্তু সমস্যা হল শুধু চাল,ডাল, আলুতেই তো হবেনা। তেল চাই, মশলাপাতি চাই। পরের লড়াইয়েও ইতিহাস সেই গড়বেতাই। মেদিনীপুর কলকাতা মহানগর থেকে ২০০কিলোমিটার দুরে গড়বেতার জেমুয়াশোল, ধোবাগেড়িয়া, খড়কুশমা, গনগনি, দুলেপাড়া, সর্বমঙ্গলা মন্দিরপাড়া, বনকাটি থেকে শুরু করে বেনাচাপড়া, চমকাইতলা, সন্ধিপুর, বড়মুড়া, সানমুড়া, ফুলবেড়িয়া আর গোয়ালতোড়, মৌলাড়া, জগারডাঙ্গা ইত্যাদি এলাকার শতশত গ্রামের হাজার হাজার মানুষ শুনলেন এক নতুন নাম ‘কমিউনিটি কিচেন!’ হ্যাঁ, খোদ কলকাতাও তখন এ জিনিস দেখে ওঠেনি। ১৬টি গ্রামপঞ্চয়েতে কোথাও ৭দিন, কোথাও ১৫দিন ধরে চলল সেই গণ রান্নাঘর। খিচুড়ি, ডিমভাত, সবজি ভাত পরিবেশন করা হল। কোথাও সাতশ কোথাও দু’হাজার মানুষ প্রতিবেলা পেট পুরে রান্না করা খাবার খেলেন।
।তার আগের ১০বছরে ৭জনের লাশ পড়ে গেছে। গড়বেতার সিপিএম নেতা দিবাকর ভূইঁয়া জানিয়েছেন, ‘বদলা নয়, বদল চাই বলে ক্ষমতায় এসেছিল বটে কিন্তু বদলার রাজনীতি শুরু হল গড়াবেতা দিয়েই। রেজাল্ট বের হওয়ার পরে পরেই খুন হলেন কমরেড জিতেন নন্দী। তারপর একে একে গণেশ দুলে, সইদুল ভাঙি, লক্ষীকান্ত সর্দার, চিত্ত রক্ষিত একের পর এক লাশ গুনেছি আমরা। শুরু হল শয়ে শয়ে গরিব মানুষের বাড়ি ভাঙা। পার্টির নেতাদের ওপর মিথ্যা মামলা। বন্ধ করে দেওয়া হল একের পর এক দলীয় কার্যালয়। ভয়ে মানুষ গুটিয়ে গেলেন। কেউ কেউ এদল ওদলে গেলেন প্রাণ বাঁচাতে। গরিব মানুষ কী করবে? সেই বন্ধ পার্টি অফিস গুলোতেই আমরা শুরু করলাম কমিউনিটি কিচেন। এগিয়ে এলেন গড়বেতার সাধারণ মানুষ, চাকুরি জীবী, শিক্ষক, অধ্যাপক, ছোট বড় ব্যবসায়ীরা। কেউ দিলেন ১০ টাকা, কেউ ১০ কিলো চাল, কেউ ডাল, কেউ আলুর বস্তা বাড়িয়ে দিলেন। শুরু হল কমিউনিটি কিচেন। এরমধ্যে চলে এল আমফান। মানুষের ঘরবাড়ি তছনছ। ফলে কোথাও কোথাও দুর্গতদের জন্য কয়েকদিন সময় বাড়ানো হল কমিউনিটি কিচেনের।”
বাকিটা ইতিহাস কিন্তু তারও দুটো ঘটনা খুব চমকপ্রদ যা বদলে দিল সেই ইতিহাসের গতিকে। এপ্রিলের ১৮তারিখ কমিউনিটি কিচেন চালু হয়েছিল ধাদিকায় যা সর্বোচ্চ ১৫দিন চলে। সেই ধাদিকার কচি নায়েক। ৩২ বছরের কচি জানালেন, ‘ টানা চারদিন প্রায় উনুন ধরেনি ঘরে। আলু, আমানি, পচা পান্তা খেয়ে দিন কাটছে। বাড়ির বাচ্চা গুলাই খবর দিল খিচুড়ি দিচ্ছে পার্টি অফিস থেকে। আমরা ততদিনে মারধর খেয়ে, চাপে পড়ে, জরিমানা এড়াতে তৃনমূল। নইলে ১০০দিনের কাজ পাবনা। লকডাউনে আমাদের পাশে কেউ নেই। খিঁচুড়ির কথা শুনে বাচ্চারা বলল, যাব। আমি বললাম, না, ওটা ওদের পার্টির জন্য। যে যার পার্টি তাকে দেয়। বাচ্চারা বলল, না সবাইকেই দিবেক। তক্ক হল বেদম। তখন আড়াল থেকে গিয়ে দেখতে গেলাম। দেখলাম তপন ঘোষ বলছে,’ সবাই আসবেন এখানে। সবাই খাবার নিয়ে যাবেন। এটা পার্টি পার্টি লড়াইয়ের সময় নয়, গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর লড়াই। চোখ খুলে গেল দাদা। এই সেই আমার পার্টি, এই সেই আমাদের নেতা তপন ঘোষ! ভাবলাম কী ভুল করেছিলাম আমরা! লকডাউন আমাদের ভুল ভেঙে দিল।”
পরের ঘটনা সেই ধাদিকার ভাটমারায়। কমিউনিটি কিচেন শুরু করারদিনই এখানে রান্নার সরঞ্জাম ইত্যাদি ভাঙচুর করে বিজেপির কিছু নেতাকর্মী। জায়গাটা তপশিলি জাতি অধ্যুষিত নায়েক পদবিধারি মানুষদের বসবাস। শাসকদলের অত্যাচারে বেশকিছু মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন গেরুয়া শিবিরে। বিজেপির তান্ডবে রুখে দাঁড়ালেন সবাই। আওয়াজ উঠেছিল, ভাত দেওয়ার মুরোদ নাই কিল মারার গোঁসাই? মানুষের প্রতিবাদে সব জিনিসপত্র কিনে দিতে বাধ্য হল যারা ভেঙেছিল তারাই। তারপর প্রায় ৮০০মানুষ অংশ নিলেন পংক্তি ভোজনে। আর এখানেও সেই ঘরে ফেরা শুরু।
তপন ঘোষের এক ছাত্রের নাম মিজানুর। সেই মিজানুর জানালেন, “স্যার আমাদের বললেন অন্তত ৪৯দিন এই লকডাউন চলবে। কিন্তু চলল প্রায় ২মাস। আমরাও স্যারের সঙ্গে কমিউনিটি কিচেনে মেতে আছি। মানুষের সাহায্য তো আছেই কিন্তু স্যারের নিজের চলে গেছে ৫ থেকে ৬লক্ষ টাকা। স্যার কে বললাম, আপনার তো একবছরের বেতন চলে গেল স্যার। স্যার বললেন, নিজেরা না দিলে অন্য লোক দেবে কেন? এই যে এত লোক চাল, টাকা, আলু, সবজি, মশলা দিচ্ছেন তাঁদের কথা বল। আমরা শুরু করেছি বলেই তো এটা সম্ভব হয়েছে। এই আমাদের স্যার। স্যার ছিল বলেই না আমরা লকডাউনে সবার বাড়িতে গিয়ে কড়া নাড়তে পেরেছি! এবার স্যারের জন্য সবার বাড়ির কড়া নাড়ছি আমরা।”