দুরন্ত ঘূর্ণি মধুসূদন বিনোদ মন্ডল যাঁরা শিক্ষকতা পেশায় আছেন, যাঁদের কাছে শিক্ষকতা জীবিকার চেয়ে বড়ো; এক মহত্তর ব্রত বা সাধনা, তাঁদের কাছে মাইকেল মধুসূদন দত্ত (২৫শে জানুয়ারি,১৮২৪ –২৯শে জুন,১৮৭৩) একটি সমীহ জাগানো নাম।
এই মন্তব্যের কারণ কী? ৪৯ বছরের অশান্ত জীবনে দুরন্ত ঘূর্ণির মতো নানা পেশায় ঘুরপাক খেয়েছেন মাইকেল। সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন মাদ্রাজের তিনটি কাগজে। ইউরেশিয়ান, মাদ্রাজ হিন্দু, ক্রনিকল পত্রিকায়।এছাড়াও সেকালের বিখ্যাত ইংরেজি কাগজ মাদ্রাজ স্পেক্টেটর-এর সহকারি সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন কিছুদিন। কাগজ গুলোতে কখনো ফিচার লিখেছেন, রিপোর্ট লিখেছেন, লিখেছিলেন এডিটোরিয়ালও। আর এসব করেছেন পেটের খিদে মেটানোর জন্য। কিন্তু পাশাপাশি মনের খিদে মেটাতে কবিতা লিখেছেন, সবই ইংরেজিতে। কাগজের পাতা ভরাট হয়েছে। আজন্ম লালিত স্বপ্ন রঙে রসে পুষ্ট হয়েছে গোপনে — বড় কবি হবেন। বায়রনের মত। যিনি ছিলেন তাঁর স্বপ্নের কবি।
মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় ফিরে পুলিশ কোর্টে জুডিশিয়াল ক্লার্কের চাকরিও করেছেন। ১২৫ টাকা মাসিক বেতনে। সৃষ্টিমুখর সে সময়। বিখ্যাত বাংলা নাটক, কবিতা মায় মেঘনাদ বধ কাব্য-এর মতো মহাকাব্য তাঁর কলমে লেখা হচ্ছে তখন। বিলেতে গিয়েছিলেন ব্যারিস্টার হতে। পাশ করে ফিরে আসেন কলকাতায়। কিন্তু কলকাতা হাইকোর্টে পাত্তা পাননি।
মাদ্রাজে থাকার সময় দুটো স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। বিশেষত অরফ্যান অ্যাসাইলাম স্কুলে কাজ করে তৃপ্তি পেয়েছেন। তাঁর শিক্ষকতা জীবন পূর্ণতা পেয়েছে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি সুনামের সাথে অধ্যাপনা করেছেন। পড়াতেন ইংরেজি ভূগোল ও ইতিহাস। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন- এর স্বপ্ন ছিল বিশ্বমানের কবি হওয়ার। তা ইতিহাস পূর্ণ করেছে।বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ দানের ব্রত তাঁর জীবনে বৈচিত্র্য ও মাধুর্য এনে দিয়েছে। তাই শিক্ষকতার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত মাইকেল তাঁদের সমগোত্রের — তা নিয়ে শ্লাঘা অনুভব করতেই পারেন।
দামাল মধুসূদনের দাপুটে জীবন উত্তাল বিদ্রোহে ভরা। যশোরের বিখ্যাত জমিদার নন্দন।স্বভাবতই সেকালের রেওয়াজ মতো এক সুশ্রী নাবালিকার সাথে (জমিদার তনয়া) বিয়ের উদ্যোগ নেন বাবা রাজনারায়ণ দত্ত। তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন সেই প্রস্তাব। সাহেবি কেতায় মানুষ হচ্ছেন। বিয়ে করবেন কোর্টশিপ করে। প্রেম করে। করেছেনও তাই। ১৮৪৮ সালের জুলাই মাসে ইংরেজ তনয়া রেবেকা ম্যাকটাভিসকে। অরফ্যান অ্যাসাইলাম স্কুলের ছাত্রী ছিলেন রেবেকা। পরে ফরাসি কন্যা এমিলিয়া আঁরিয়েতা সোফিয়ার সঙ্গে আলাপ। পরকীয়া। ১৮৫৬ সালে মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন তিনি। তারপর রেবেকা ও তার সন্তান-সন্ততির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি।বছর দুয়েক পরে সোফিয়া চলে আসেন কলকাতায়, ইতিহাস যাকে জানে হেনরিয়েটা নামে।
না, রেবেকার সঙ্গে ডিভোর্স হয়নি।আবার খাতা-কলমে বিয়েও হয়নি হেনরিয়েটার সাথে। তবে আমৃত্যু হেনরিয়েটা তাঁর পাশে থেকেছেন। দারিদ্র্য, লাঞ্ছনা, খামখেয়ালিপনার ঝড়ঝাপটা সহ্য করেছেন।
শেষ জীবনে মধুসূদন হতাশা, চরম অর্থাভাব ও অবসাদে উশৃঙ্খল জীবনযাপন শুরু করেন। যা নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থ চেষ্টা করেন হেনরিয়েটা। কৈশোরে যৌবনে কাউকে তিনি কেয়ার করতেন না। না মা জাহ্নবী দেবী কে। না বন্ধু গৌরচন্দ্র বসাককে। বাবার সামনে ধূমপান করতেন নিয়মিত। বাবার সঙ্গে বসে মদ্যপানও চলতো আকছার।তবে হিন্দু কলেজে পড়ার সময় সাহিত্যের অধ্যাপক ডেভিড লেস্টার রিচার্ডসন ছিলেন তাঁর রোল মডেল। মনে সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টির পেছনে রিচার্ডসন স্যার এর প্রভাব ছিল অপরিসীম।
পরবর্তীকালে ১৮৬২ সালে বিলেত চলে যাওয়ার পর থেকে আজীবন আরেকজন অপ্রতিম মানুষের কাছে চির ঋণী হয়ে যান পাকেচক্রে। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন তিনি বিদ্যাসাগর। শোনা যায়,দেশে ফিরে জুড়ি গাড়িতে চেপে বিদ্যাসাগরের সাথে দেখা করতে যান তিনি, উপহার হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যান দু বোতল বিলিতি মদ। বিদ্যাসাগর মহাশয় এর অনুরোধ ধমক তিরস্কারও সেই অবসাদ – অবসানে কাজ দেয়নি। আলিপুর হাসপাতালে যখন জুনের শেষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন, তখন চিকিৎসকগণ তাঁর প্রেসক্রিপশনে অসুখের যে লম্বা তালিকা সংযোজন করেন তাতে উল্লেখ রয়েছে লিভোসিরোসিস, ড্রপসি ; এছাড়াও গলার ক্ষত এবং হার্টের অসুখের খবর।
ধর্ম ত্যাগের জন্য হিন্দুরা খেপেছিলেন। ব্রজাঙ্গনা লিখেও প্রায়শ্চিত্ত করা যায়নি। সমাধির জন্য অ্যাংলিকান চার্চে স্থান পাননি তিনি। এমনকি বেরিয়ালের জন্য মেলেনি আর্চ বিশপের অনুমতি পত্রও। মধ্য কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোডে সেমেটারিতে হেনরিয়েটার সমাধির পাশেই শেষশয্যায় শায়িত আছেন তিনি।’মধু বিশ্রাম পথ’ পেরিয়ে সেখানে গেলে অনুজ্জ্বল প্রস্তর ফলক এ পড়া যাবে সেই অমর এপিটাফ — দাঁড়াও পথিকবর !…..