প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, নয়া যুগের রাজকুমার বিনোদ মন্ডল ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব বাঁকে দাঁড়িয়ে আমরা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরকে স্মরণ করতে চাই। বর্ণময়, জেদি, লড়াকু, দূরদর্শী, স্বপ্নময় একটি মানুষ, যিনি আজ থেকে দুশো বছর আগে, সমুদ্রপথে চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে সফল হয়েছিলেন। এখন চিনা দ্রব্য চিনা অ্যাপস নিষিদ্ধ করছে ভারত। তারা এখন নানা সস্তা প্লাস্টিক খেলনা এবং অ্যাপসে আমাদের দেশের বাজার দখল করে নিয়েছে। আর ওই লোকগুলোকে তখন নুন এবং আফিমের স্বাদে মজিয়ে দিয়েছিলেন দ্বারকানাথ। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬)।
তিনি ইংরেজিতে চোস্ত হওয়ার জন্য সাহেবদের কাছে তালিম নিয়েছিলেন। সেকালের বিখ্যাত ব্যারিস্টার রবার্ট কাটলার ফার্গুসান সাহেবের কাছে আইনের পাঠ নিয়েছেন। এমন পাঠ নিলেন, নিজেই বিশেষজ্ঞ হিসেবে সেকালের রাজা-জমিদারদের কাছে মোটা অংকের বিনিময়ে মেধা ও পরামর্শ দিতে অফিস খুলে বসেছিলেন। ত্রিপুরার মহারাজা থেকে যশোরের রাজা এবং বিভিন্ন জমিদার বিষয়সম্পত্তি সংক্রান্ত জটিলতা ও মামলা-মোকদ্দমায় তাঁর সাহায্য নিতে ছুটে আসতেন। তখনকার দিনে দলিল-দস্তাবেজ সব আরবি ও ফারসি ভাষায় লেখা ছিল।
কোম্পানির আমলে সেগুলো ইংরেজিতে তরজমার প্রয়োজন পড়লেই দ্বারকানাথের সেরেস্তায় অনিবার্য আগমন ঘটতো জমিদারদের। নির্ভুল ইংরেজিতে অনুবাদ করে সেকালেই তিনি মাসে পনেরো হাজার টাকা রোজগার করতেন। সঙ্গে ছিল সুদে টাকা খাটানো। নিলামে ওঠা নানা জমিদারি কিনে নেওয়ার নেশা।দেখা যাচ্ছে, বর্ধমানের রাজার পরে কোম্পানি রাজত্বে তাঁর জমিদারি আয়তনে একসময় দ্বিতীয় বৃহত্তম হয়ে উঠেছিল। গবেষকগণ অংক কষে দেখাচ্ছেন, একসময় নিয়মিতভাবে কোম্পানি তাঁর কাছ থেকেই মাসিক এক লক্ষ টাকা খাজনা আদায় করেছে। এদেশে প্রথম কর্পোরেট জমিদার ছিলেন তিনি, যা দেখভাল করার জন্য দেশীয় নায়েব গোমস্তাদের ওপরে চার-চার জন ইউরোপীয় ম্যানেজার নিয়োগ করেছিলেন। জমিদার হিসেবে তিনি খুব কড়া ধাতের মানুষ ছিলেন। তবে প্রজারা কেউ বিপদে পড়ে তাঁর কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলে আর চিন্তা ছিল না, উদারতার মাধুর্যে মুগ্ধ হতেন।
দ্বারকানাথ ছিলেন সেকালের একজন সফল শিল্পপতি। আমদানি রপ্তানির ব্যবসায় চূড়ান্ত সাফল্য পেয়েছেন। তালিকায় কী ছিল না ? আফিম, নুন তো আছেই। নিজের জমিদারিতে ব্যাপক নীল চাষ করতেন। তা রপ্তানি হতো। এছাড়া রেশমের নানা দ্রব্য, চিনি, কাঠ, সোডা, চামড়া, কয়লা এমনকি মদ রপ্তানি করতেন। শোনা যায় পার্টনারের সঙ্গে বুয়েনস্ আইরিশে মদ (রাম) রপ্তানি করতেন নিয়মিত। মৌরি, জায়ফল ও আখের রস দিয়ে দেশীয় পদ্ধতিতে নিজের জমিদারিতে যা উৎপাদিত হত। এছাড়াও তাঁর নজর ছিল জাহাজ এবং সংবাদপত্র শিল্পে। ব্যাঙ্ক ব্যবসায়ও মেতে উঠেছিলেন তিনি। বিনিয়োগ করেন বীমা ক্ষেত্রেও।
খিদিরপুরের দুই সাহেবের সাথে যৌথ উদ্যোগে ‘ওয়াটারউইচ’ নামে জাহাজ বানানো হয় তাঁর তত্ত্বাবধানে। মন্দার কবলে পড়ে ম্যাকিনটোশ কোম্পানি যখন ধুঁকছে, তখন তাদের পাশে দাঁড়াতে তাদের ফর্বস্ স্টিমারটি কিনে নেন দ্বারকানাথ। জল পরিবহণে তাঁর উদ্যোগী ভূমিকার অন্যতম স্বাক্ষর হল দ্বারকানাথ নামাঙ্কিত একটি স্টিমার তখন যাত্রী পরিবহণ করতে চালু ছিল। তিনি প্রথমবার (১৮৪২) যে বিলেত যাত্রা করেন, তাও নিজের জাহাজ ইন্ডিয়াতে চেপে। হুগলি নদীতে পলি জমার ফলে একসময় বড় জাহাজ কূলে ভিড়তে পারত না। দূরদর্শী দ্বারকানাথ সেই সমস্যা স্থায়ী ভাবে সমাধানের লক্ষ্যে ইউরোপীয় জলপথ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে ক্যালকাটা স্টিম টাগ অ্যাসোসিয়েশন চালু করেন। যার ফলে জাহাজগুলোকে দ্রুত হুগলি নদীর মুখে টেনে আনা সম্ভব হল। একশো বছর পরে নাতি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে স্টিমার ব্যবসার হুজুগে এক সময় মেতে উঠবেন, তার প্রেরণাও সম্ভবত ঠাকুরদা দ্বারকানাথ, সন্দেহ নেই।
নব্যইংরেজি শিক্ষিত সমাজের সামনে সংবাদপত্র তখন নতুন ঊষার স্বর্ণ দ্বার খুলে দিচ্ছে। দ্বারকানাথ মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবেন কেন? আজ থেকে দুশো বছর আগে (১৮২১) রামমোহন প্রতিষ্ঠা করেন ‘সংবাদ কৌমুদী’ সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা। তার সম্পাদক ছিলেন দ্বারকানাথ। এছাড়া ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘বেঙ্গল হেরল্ড’ এবং বাংলা সাময়িক পত্রিকা ‘বঙ্গদূত’ কাগজের শুভ সূচনা হয় দ্বারকানাথের হাতে। ‘বেঙ্গল হরকরা’, ‘ইন্ডিয়া গেজেট’, ‘ইংলিশম্যান’ প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশের জন্য নিয়মিত অর্থ সাহায্য করতেন তিনি। আজকের দিনে কয়লা ব্যবসা নিয়ে নানা পুঁজি ও মাফিয়াদের মুখরোচক খবর শোনা যায় প্রায়শঃ। ভাবতে অবাক লাগে এই ব্যস্ত মানুষটি কয়লা ব্যবসায়ও মাথা গলিয়েছিলেন সেকালে। কালো সোনার ব্যবসায়িক মূল্য বুঝেছিলেন বলেই আলেকজান্ডার অ্যান্ড কোম্পানির কাছ থেকে রানীগঞ্জের নারায়ণ কুঠি এলাকায় ৭০ হাজার টাকা খরচ করে একটি আস্ত কয়লাখনি কিনে নিয়েছিলেন। শুধু কি তাই! সেই কয়লা তোলা ও তার সুষ্ঠু বিপণনের লক্ষ্যে গড়ে তোলেন ‘বেঙ্গল কোল কোম্পানি।’ কাজের নেশায় পাগল হয়ে ওঠা মানুষটির উদ্যমের অন্ত ছিল না। আপন যোগ্যতায় কোম্পানির অধীনে সেরেস্তাদার ও পরে ধাপে ধাপে আবগারি, লবণ ও আফিম বোর্ডের দেওয়ান পদে উন্নীত হন। কার অ্যান্ড টেগোর কোম্পানির আট আনার অংশীদার হন।
স্বভাবতই ব্যাংকিং সেক্টরে কাজ করবার নেশায় ১৮২৯ সালে সর্বসাধারণের জন্য ইউনিয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মতে দ্বারকানাথ চালিত ইউনিয়ন ব্যাংক তখনকার সবচেয়ে বড় ‘ভারতীয়’ ব্যবসা। প্রথমে এই ব্যাংক ম্যাকিনটোশ কোম্পানির উদ্যোগে চালু হলেও পরের দিকে দ্বারকানাথ ও তাঁর সহযোগীরা এই ব্যাংকের প্রধান অংশীদার হয়ে যান। যদিও এই ব্যবসার পরিণতি আখেরে লাভজনক হয়নি। এর আগে ১৮২২ সাল নাগাদ ওরিয়েন্টাল লাইফ ইনসিওরেন্স সোসাইটি নামক বিমা কোম্পানি স্হাপন করেছিলেন তিনিই।
রামমোহনের বিশ্বস্ত সহযোগী ছিলেন তিনি। যদিও রুচি, খাদ্যাভ্যাস, ধর্মচর্চা নানা বিষয়ে উভয়ের ফারাকও ছিল যথেষ্ট। তবুও ব্রাহ্ম-একেশ্বরবাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তিনি। এই ধর্ম প্রচারের জন্য ২৫০০ টাকা দান করেছিলেন। সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলনে রামমোহনকে স্বাক্ষর দানসহ সহযোগিতা করেছেন। এমনকি বিলেতে থাকাকালীন নানা কাজের ফাঁকে রামমোহনের জীর্ণ সমাধিক্ষেত্র ‘আর্নোজ ভেল’ এ স্থানান্তর ও সৌন্দর্যায়নে প্রবৃত্ত হন দ্বারকানাথ। আবার রামমোহনের বিপরীত মেরুতে অবস্থানকারী রাধাকান্ত দেব যখন মাতৃভাষার উন্নয়নে ‘গৌড়ীয় সমাজ’ স্থাপন করেন সেখানেও পাশে থেকেছেন তিনি। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় ১০,০০০ টাকা অনুদান ছিল তাঁরই।
বিলেতে থাকাকালীন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম এডওয়ার্ট গ্ল্যাডস্টোনের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় সামিল হন। বিষয় ছিল— সংসদে ভারতীয়দের প্রবেশাধিকার। এ দেশে রেলপথ স্থাপনের বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন তিনি। যদিও তখন সফল হননি। মানুষের আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়ানোর নিয়মিত অভ্যাস ছিল তাঁর। সাদাকালো নির্বিশেষে অকাতরে এ কাজ করেছেন আজীবন। দ্বিতীয় দফা বিলেতে যাওয়ার সময় চারজন শিক্ষানবীশ চিকিৎসককে শল্য চিকিৎসা পদ্ধতি শেখানোর জন্য সঙ্গে নিয়ে যান। সমাজমনস্ক এই মানুষটির মহার্ঘ্য পোশাকের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে সহমর্মিতা ভরা হৃদয়। বিস্মৃতির ধুলো সরালে এখনো তা নজরে আসে। পুত্র দেবেন্দ্রনাথকে চিঠিতে লিখেছেন— ‘বর্তমানে এদেশে প্রায় তিন লাখ লোকের কাজকর্ম নেই।… ভারতের ক্ষুৎপীড়িত হিল- কুলিদের নিয়ে এরা যতই বাগবিস্তার করুক না কেন, এ দেশে দুঃখ-দুর্দশা কম নয়।’ গ্লাসগোর বাইরে কর্মহীন বেকারদের আন্দোলনের খবর ভরা এই চিঠি ছাপা হচ্ছে পরে, বেঙ্গল স্পেক্টেটরে।
ইতিহাস মানুষটাকে মনে রেখেছে স্ফুর্তিবাজ এক ইংরেজ শাসনে সমর্থিত প্রাণ জমিদার হিসাবে। যাঁর সাথে রানীর সখ্য ছিল। যুবরাজের ওঠা বসা ছিল। চার্লস ডিকেন্সের যোগাযোগ ছিল। যাঁর রক্তে ছিল রঙ্গ রস। যাঁর কীর্তি বেলগাছিয়া বাগানবাড়ি। বাগবাজারের রূপচাঁদ পক্ষীর ছড়ায় তিনি রক্তমাংসে অমর হয়ে আছেন। ‘বেলগাছিয়ার বাগানে হয়/ ছুরি-কাঁচির ঝনঝনি। / খানা খাওয়ার কত মজা/ আমরা তা কী জানি?/ মদের কত গুণাগুণ/ আমরা তার কী জানি?/ জানেন ঠাকুর কোম্পানি।/
ধনতন্ত্রের সাধনা করেছেন বলেই মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই হয়েছে তাঁর। দেশের স্বাধীনতা নিয়ে স্বভাবতই মাথা ঘামাননি তিনি। যতখানি মাথা ঘামিয়েছেন, তা ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিসরেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। বিলেতে দ্বিতীয় দফায় গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন ১৮৪৫-এর জুন মাসে। ১ আগস্ট প্রয়াত হন। সেকালে বিলাতে মরদেহ দাহ করার রীতি প্রচলিত ছিল না। ফলে ‘কেনসল গ্ৰিন’ সমাধি ক্ষেত্রে তাঁকে সমাহিত করা হয়। অর্ধশতাব্দী পরে যে সমাধি ক্ষেত্রে ফুল দেবেন তাঁর যোগ্য উত্তরাধিকার বিশ্বনাগরিক পৌত্র রবীন্দ্রনাথ। জীবদ্দশায় তিনি যাঁর মুখ দেখার সুযোগ পাননি। তবে আপামর বাঙালির কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বিশ্বকবির ঠাকুরদা হিসেবে।