মনুষ্যত্বের পূর্ন প্রতীক বিদ্যাসাগর বিনোদ মন্ডল
উনিশ শতকীয় নবজাগরণের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব-উপহার পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)। রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ব্যাপ্ত কালখণ্ডে সাধারণের প্রতি মমত্ববোধ তিতিক্ষা ও জীবন সংগ্রামে উন্মুখর এই মানুষটি জাতিনির্মাণে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাই তাঁকে মনুষ্যত্বের পূর্ণ প্রতীক বলি আমরা।
দুশো বছর ধরে তাঁকে নিয়ে বাঙালির আবেগ পুঞ্জীভূত হয়ে নানা মিথের জন্ম দিয়েছে। যে বিদ্যাসাগর জীবনে কোনদিন নীলদর্পণ নাটক দেখেননি, দীনবন্ধুর লেখা নাটক পড়েছেন মাত্র, বলা হয় — রোগ সাহেবের দ্বারা ধর্ষণ দৃশ্যে উত্তেজিত হয়ে তিনি চটি ছুড়ে মেরেছিলেন। আসলে এই জাতীয় রটনার মাধ্যমে বাঙালি নিজের ক্রোধকে প্রকাশ করে আনন্দ পেয়েছে। তখন এমন কোনও অনমনীয় ব্যক্তিত্ব ছিলনা বিদ্যাসাগরের মতো যিনি এ কাজ করতে পারতেন। এই ধাঁধার চমৎকার উত্তর দিয়েছিলেন ছোট লাট হ্যালিডে সাহেব।
অনেকে, সেকালের উচ্চবিত্ত হোমরা-চোমরা এসে ঘন্টার পর ঘন্টা তার সঙ্গে দেখা করার জন্য তার কক্ষে বসে থাকতেন। বিদ্যাসাগর এসে তার কক্ষে ঢুকে যেতেন অথবা সঙ্গে সঙ্গে ডাক পেতেন। হ্যালিডে অভিযোগের উত্তর বলেছেন — আপনারা আসেন নিজের নিজের দরকারে, কাজ আদায়ে। পন্ডিত আসেন আত্মস্বার্থে নয় সমাজ হিতৈষণার তাগিদে। আমরা আমাদের গরজে তাঁকে আগে সময় দিই। বাস্তবিক শাসকশ্রেণি তখন উপলব্ধি করেছিল — তাদের পক্ষে উনি কখনো বিপদজনক হয়ে উঠবেন না। তাই নিজেদের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে তাঁর সংস্কার কর্মসূচিকে সহায়তা দিয়েছেন।
নবজাগরণকে ইংরেজরা ততখানি সমর্থন করেছে যতখানি তাদের কাজ হাসিল করতে সহায়ক ছিল। নতুন সমাজ গঠনের মতো বিপ্লব সাধন তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। তারা চেয়েছিল ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বঙ্গসন্তানেরা রূপে হবে ভারতীয় কিন্তু অন্তরে হবে ইংরেজ। তাই মধুচক্রের মত কলকাতাকে কেন্দ্র করে চাকবাঁধা শুরু হলো।গ্রামীণ অর্থনীতিকে ধ্বংস করে কলকাতা গড়ে তোলার কর্মসূচি বিদ্যাসাগরের জন্মের আগেই শুরু হয়ে যায়। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হলো।কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি, হিন্দু কলেজ ১৮১৭ তে পথ চলা শুরু করলো। বিদ্যাসাগর যখন চার বছরের শিশু, মাইকেল যে বছর জন্মগ্রহণ করেছেন সেই ১৮২৪- এ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সংস্কৃত কলেজ । কোলকাতা তখন ফ্লোরেন্স অফ এশিয়া।
উল্টোদিক থেকে দেখলে বিদ্যাসাগর যদি আট বছর বয়সে দূরদর্শী বাবার ইচ্ছায় কলকাতায় পা না রাখতেন, তিনি এই সুউচ্চ মিনারে রূপান্তরিত হতে পারতেন না। আজও যেমন গ্রাম, শহরের, মফসসলের অসংখ্য প্রতিভা অন্ধকারে হারিয়ে যান তাঁরও তেমন দুর্গতি হতে পারতো। এটা বাস্তব যে সে সময় কোলকাতায় নাড়া না বাঁধলে কলকে পাওয়া যেত না। ইতিহাসে এমন অসংখ্য নজির ছড়ানো। আজও অভিযোগ শোনা যায় শিক্ষা-সংস্কৃতি এমনকি রাজ্যশাসনেও নাকি কলকাতার কলতান অব্যাহত।সেকালের মনীষীদের মধ্যে থেকে বিদ্যাসাগর তাই ছিলেন ব্যতিক্রম।
সমসময়ের সবচেয়ে বড় বাঙালি আইকন সৌরভ গাঙ্গুলী, কারো কাছে অমর্ত্য সেন। এদের সঙ্গে আরও অনেকের ছবি বা প্রতিকৃতি বাজারে সুলভ, এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বৈপ্লবিক রূপান্তরের পর। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে বিদ্যাসাগর তাঁর সময়কালে প্রবাদপ্রতিম রূপ লাভ করেছিলেন। তাঁর ছবি বিক্রির জন্য তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল, আসুন চোখ বুলিয়ে নিই —
মহামান্য দেশহিতৈষী শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম দিগদিগন্তে ব্যাপ্ত হওয়াতে আপামর সাধারণ প্রায় সকলেই শ্রুতিগোচর করিয়াছেন , কিন্তু তাহার মধ্যে অনেকেই তাঁহাকে দৃষ্টিগোচর করেন নাই সুতরাং যাঁহারা তাঁহাকে দেখেন নাই তাঁহাদিগের দর্শন সুখ লাভার্থে উক্ত মহাশয়ের প্রতিকৃতি চিত্রিত করিয়া বিক্রয়ার্থ প্রস্তুত করা গিয়াছে, পটখানির পরিমাণ দেড় হস্ত হইবেক এবং মুল্য এক টাকা নির্ধারিত হইয়াছে,যাঁহার প্রয়োজন হয়, লালবাজারের ২৩নং ভবনে আমাদিগের নিকট মূল্য প্রেরণ করিলেই প্রাপ্ত হইবেন। (শ্রী এন সি ঘোষ কোম্পানি)
জীবদ্দশায় বিদ্যাসাগরের জনপ্রিয়তা ছিল ঈর্ষণীয়। লোকে কালীঘাটে তীর্থ করার পর বাদুড়বাগানে বিদ্যাসাগরের বাড়ির রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেত। চোখের দেখা — দেখার আশায় । এটা তিনি তাঁর কাজ, সেবা, ব্রত দ্বারা অর্জন করেছিলেন। আজ যখন সমগ্র ভারতবর্ষ ইহলোক নয় পরলোকের চর্চায় মগ্নমৈনাক, তখন বিদ্যাসাগর আমাদের ভক্তিবাদের থেকে যুক্তিবাদের দিকে চালিত করায় প্রয়াসী ছিলেন। তিনি শিখিয়েছিলেন শাস্ত্রের চেয়ে মানুষ বড়ো। শাস্ত্র দিয়ে শাস্ত্রকে খন্ডন করবার কাজ রামমোহন (১৭৭২-১৮৩৩) শুরু করেছিলেন। বিদ্যাসাগর সেই কাজকে বিকশিত করেছিলেন। তবে রামমোহনের মতো তিনি হিন্দু ধর্মের বিরোধিতা করে ব্রাহ্ম হননি। ধর্ম ও ঈশ্বর নিয়ে নীরব থেকেছেন। ওসব আলোচনা থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন। ধর্ম আন্দোলনের শামলা গায়ে চাপাননি। তাই রামকৃষ্ণ বলেছেন, ” বিদ্যাসাগরের বিদ্যা আছে, দয়া আছে, কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি নেই ” এটা দুঃখের যে তিনি বিদ্যাসাগরকে বোঝেননি। তবে মাইকেল ও রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন। বুঝেছিলেন বিবেকানন্দ, যিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে বিশ্ববন্দিত করেছেন। আবার বিবেকানন্দ যদি বিদ্যাসাগরের মানবিক অভিমুখ গ্রহণ না করে, শুধু গুরুদেবের আধ্যাত্মিক ভাবনায় ডুবে থাকতেন তাহলে আজকের যুগমানব বিবেকানন্দকে পাওয়া যেত না।
তত্ত্ববোধিনী সভায় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অক্ষয় কুমার দত্তের মধ্যে একবার মতবিরোধ বাধে। প্রথমজন ভগবত সাধক মার্গীয় এবং দ্বিতীয় জন যুক্তিবাদের পন্থী। বিদ্যাসাগর অক্ষয় কুমারের পক্ষে প্রকাশ্যে সায় দেন। তিনি দেবদেবতা মানতেন না। তাঁর মা,বাবাই তাঁর কাছে দেবদেবী, ঈশ্বর। তাই কাশীর পূজারি ব্রাহ্মণকেও অকপটে বলেছিলেন, ” এই যে দেখছেন আমার মা ইনিই আমার অন্নপূর্ণা, আর এই যে আমার বাবা – আমার বিশ্বেশ্বর বিশ্বনাথ।” আমৃত্যু এই বিশ্বাসেই তিনি অটল ছিলেন।
কুলীন ব্রাহ্মণ সন্তান হয়েও তিনি সেকালেই সন্ধ্যা আহ্নিক ছেড়ে দিয়েছিলেন। গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করতেন না। তাই তাঁর উইলে মন্দির খাতে কোনো অর্থ বরাদ্দ হয়নি। বিন্দুমাত্র অলৌকিকতা কখনো তাঁকে বিচলিত করেনি। আজ যখন অনবরত ক্যামেরার সামনে সমাজের নানা দিগন্তের উজ্জ্বল সেলিব্রিটিদের সালংকার দেখে মানুষ বিমোহিত বা বিড়ম্বিত হয়, তখন বিদ্যাসাগরের কথা ভেবে গর্ব হয়। কেননা তাঁর অঙ্গে কোনোদিনও মাদুলি ছিলনা কোনো আঙুলে কোনো আংটি ছিল না।
ভক্তিযোগের নয়, তিনি কর্মযোগের ভক্ত ছিলেন। তাই রামকৃষ্ণের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে দক্ষিণেশ্বরে ছুটে যাননি। বরং ১৮৮২ র ৫ আগস্ট তাঁর বাদুড়বাগানের বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলেন স্বয়ং রামকৃষ্ণ। সাগরের নোনা জলের স্বাদ পরখ করতে। বিবেকানন্দ একবার ভগিনী নিবেদিতাকে (১৮৬৭-১৯১৭) বলেছিলেন, ” রামকৃষ্ণের পর বিদ্যাসাগর তাঁর গুরু, মানুষের প্রতি এত ভালোবাসা, এত প্রেম তিনি আর কারুর মধ্যে দেখেননি। ” তাই তিনি মনুষ্যত্বের পূর্ণ প্রতীক, অপরাজেয় মনীষী।