আলোর শিখা চন্দ্রমুখী বসু বিনোদ মন্ডল নারী-মুক্তি আন্দোলন হল নারীর আপন অন্তর্লোকের পূর্ণ জাগরণ। একজন নারীর সচেতনভাবে বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপটে নিজের মানবিক গুণগুলির বিকাশ সাধনের বহুমাত্রিক প্রয়াস। মানুষ হিসেবে নিজের তথা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সযত্ন উপলব্ধি। যার নিরিখে সচেতন নারী তার চলার পথে সমূহ অন্তরায় শনাক্ত করে এবং নিজের প্রতিভার স্ফূরণে প্রাণিত হয়। উনিশ শতকের নবজাগরণের ইতিহাসে এমনই এক ব্যক্তিত্বময়ীর নাম চন্দ্রমুখী বসু (১৮৬০ – ১৯৪৪)।
উপনিবেশিক ভারতে নারী শিক্ষা নিয়ে প্রথম আলোড়ন শুরু হয়, এই ভাবনা ঠিক নয়। ভারতে নারী মুক্তি, নারী শিক্ষার ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। বৈদিক ভারতে নারীর স্থান যথেষ্ট সম্মানজনক উচ্চতা লাভ করেছিল। বাস্তবে তখন শিক্ষা ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ ছিল না। উপনিষদে বিদুষীদের জন্য নানা ব্যাখ্যা বিশদে রয়েছে। বিবাহ কালে পুরুষের পাঁচটি কাঙ্ক্ষিত বিষয় হলো, কন্যা হবে ধন, রূপ, বিদ্যা, বুদ্ধি এবং বংশ কৌলিন্যে শ্রেষ্ঠা। পরবর্তীকালে নানা কারণে নারী এই মর্যাদা মন্ডিত স্থান থেকে বিচ্যুত হন। বিশেষত, মুসলিম যুগে রাজনৈতিক কারণে হিন্দু সমাজে নানা বিপর্যয় নেমে আসে এবং নারীসমাজ, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে যান।
১৮৬০ সালের ৩ আগস্ট হুগলি জেলার মহানাদ গ্রামে চন্দ্রমুখী বসু জন্মগ্রহণ করেন। প্রবাসী বাঙালি বাবা ভুবনমোহন বসু ধর্মমতে খ্রিস্টান ছিলেন। দেরাদুনের এ পি মিশন চার্চ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিনি। তাই তার বড় মেয়ে চন্দ্রমুখীর শৈশব ও কৈশোর দেরাদুনে কাটে। সেখানে দেরাদুন গার্লস স্কুলে তাকে ভর্তি করা হয়। প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসার জন্য শুরু হয় প্রস্তুতি। মনোযোগী ছাত্রী ছিলেন চন্দ্রমুখী। এই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা ছাত্রীদের জন্য খোলা ছিল না। ওই স্কুলের তত্ত্বাবধায়ক রেভারেন্ড হেরন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চন্দ্রমুখীকে পরীক্ষায় বসার অনুমতি দেওয়ার জন্য লিখিত আবেদন করেন।
বিষয়টি নিয়ে ১৫.১১.১৮৭৫ তারিখের সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট দীর্ঘ আলোচনা করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত আইনে এই সুযোগ না থাকায় প্রয়োজনীয় অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে সে যাতে হতাশ না হয়ে পড়াশোনার উদ্যম জারি রাখে তার জন্য তাকে সিন্ডিকেট উৎসাহিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় বসার সামর্থ্য যাচাই করার লক্ষ্যে সেই বছরের প্রশ্নপত্র প্রদান করা হয়। সালটা ছিল ১৮৭৭। চন্দ্রমুখী বসু যথেষ্ট কৃতিত্বের সঙ্গে নিজের মেধার প্রমাণ দেন। শুধু পরীক্ষকগণ নন, উপাচার্য হডহাউস সাহেবও বিস্মিত হন। তিনি সমাবর্তন উৎসবে চন্দ্রমুখীর বিষয়টি উল্লেখ করে নিজের অপারগতার জন্য ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করেন।
এই ঘটনায় সমাজে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। শিক্ষাজীবী মহলে নানা ভাবে ব্যক্তিগত স্তরে এবং যৌথভাবে নারীর উচ্চ শিক্ষা প্রসারের জন্য নানা প্রয়াস প্রচেষ্টা আন্দোলন শুরু হয়। মহিলাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা উন্মুক্ত করতে সুনির্দিষ্ট নীতি রচিত হয়। প্রথমে এন্ট্রান্স ও পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাপর পরীক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। যার প্রথম সুযোগ লাভ করে বেথুন স্কুলের ছাত্রী কাদম্বিনী বসু। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি অন্যান্য পরীক্ষার্থীদের সাথে পরীক্ষায় বসেন এবং প্রবেশিকা পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন।
এবার চন্দ্রমুখী ফিরে এলেন কলকাতায়। নানা স্তরে নানা আলাপ আলোচনা সভা সমিতির পর তার কৃতিত্বকে এন্ট্রান্স পরীক্ষার সমতুল্য বিধেয় করে তাকে এফ. এ. পড়বার অনুমতি প্রদান করা হয়। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফ্রী মিশন চার্চ স্কুল থেকে এফ. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন দ্বিতীয় বিভাগে। এবার ভর্তি হন বেথুন কলেজে। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কাদম্বিনীর সাথে বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ব্রিটিশ উপনিবেশে প্রথম মহিলা স্নাতক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম নথিভুক্ত করেন।
তখনকার সমাজে এই ঘটনার প্রভাব ছিল সুদূর প্রসারী। সাময়িক পত্র গুলো অধিকাংশই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে কশায়িত করেছে। বিদ্যাসাগর মশাই তাদের সাফল্যকে, তার প্রচেষ্টার ‘প্রথম পুরস্কার’ হিসেবে অভিহিত ও অভিনন্দিত করেছেন। সেবারের সমাবর্তন উৎসবের ভাষণে উপাচার্য হার্বার্ট জন রেনল্ডস্ দুই কৃতী ছাত্রীকে পৃথকভাবে অভিনন্দিত করেন। তিনি বলেন, “এই ঘটনা শিক্ষায় নারীর অধিকারকে স্বীকৃতি দেবে এবং তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা পুরুষের কর্তব্য হিসেবে নির্দেশিত করবে।”
শুধু এদেশে নয় লন্ডনেও তখন মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে সমাজে নানা টানাপোড়েন চলছিল। স্বাধীনতাকে অনেকেই স্বেচ্ছাচারিতা হিসেবে দেখেছেন। আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, মেয়েরা শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে তাদের নারীসুলভ চরিত্র হারিয়ে ফেলবে। ইংল্যান্ডে মেয়েদের শিক্ষা প্রসারের বিরুদ্ধে পুরুষরা প্রবল আপত্তি শুরু করে। লন্ডনে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে এই নিয়ে নীতি নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। অনেকেই উচ্চ শিক্ষা লাভের অনুমতি প্রার্থনা করতে লিখিত আবেদন পেশ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পার্লামেন্ট পর্যন্ত নানা স্তরে শয়ে শয়ে মহিলা দরখাস্ত পেশ করেন। তবুও ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আইনসভা তা কর্ণগোচর করেনি। ইতিহাস বলে, ১৯২০ তে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এই স্বীকৃতি প্রদান করে।
কাদম্বিনী বসু মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু চন্দ্রমুখী বসু ১৮৮৪ তে ইংরেজিতে এম.এ. পাস করেন। তিনি এদেশের প্রথম মহিলা যিনি এই বিরল কৃতিত্বের স্বাক্ষর দিয়েছেন। বিদ্যাসাগর তাঁকে শেক্সপিয়ার রচনাবলী উপহার দেন। ধীরে ধীরে শিক্ষাঙ্গনে নারীর পদচারণা স্বাভাবিক ছন্দ লাভ করে। ১৮৮০ তে কামিনী সেন ও সুবর্ণপ্রভা বসু এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে অবলা দাস, কুমুদিনী খাস্তগীর (বেথুন স্কুল), ভার্জিনিয়া মিত্র (কানপুর বালিকা বিদ্যালয়), নির্মলা মুখোপাধ্যায় (ফ্রি চার্চ স্কুল), প্রিয়তমা দত্ত (আপার ক্রিশ্চান স্কুল) চন্দ্রমুখীর বোন বিধুমুখী বসু (ডেরা স্কুল) এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে সমাবর্তন ভাষণে উপাচার্য গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ডিগ্রীপ্রাপ্ত ছাত্রীদের আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, “no community can be said to be an educated community unless its female members are educated “. এবার শুধু ব্রাহ্ম বা খ্রিস্টান মেয়েরা নন, অবহেলার পাথর সরিয়ে শিক্ষার আলোয় পথ চলা শুরু করলেন হিন্দু মেয়েরাও।
চন্দ্রমুখী বসু এম.এ. পাশ করবার পর কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন বেথুন স্কুলকেই। তিনি প্রধান শিক্ষকের পদে বৃত হন। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পদোন্নতি ঘটে। ওই স্কুলের লেডি সুপারেনটেনডেন্ট হন তিনি। ১৮৮৮ তে বেথুন কলেজ যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে আলাদা ভাবে বেথুন কলেজের স্বীকৃতি লাভ করে, তখন চন্দ্রমুখী বসুকেই তার (১৮৯৩) লেডি প্রিন্সিপাল পদে নিয়োজিত করা হয়। দক্ষতার সঙ্গে কলেজ পরিচালনা করে ১৯০১ এর ১১ অক্টোবর স্বাস্থ্যের কারণে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। জে. এস. সি স্লেটার ছিলেন তদানীন্তন ডি.পি. আই। তিনি চন্দ্রমুখীর অবদান প্রসঙ্গে লিখেছেন, – “Miss Bose had to work among a people extremely conservative, especially in the matter of female education and labouring under have beneful custom of child marriage and she will be looked upon as the pioneer of higher education of native female in Bengal.”
ঈশ্বরচন্দ্রের প্রয়াণের পর বেথুন কলেজের হলঘরে চন্দ্রমুখী বসুর আহ্বানে প্রথম শোক সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সমবেত বেথুন স্কুলের শিক্ষিকাগণ অষ্টম শ্রেণীর মেধাবী বালিকাকে প্রতি বছর ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’ প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। গঠিত হয় ট্রাস্ট। যা আজও চালু আছে। অন্য ফর্মে। এভাবে বিদ্যাসাগরের প্রদর্শিত পথে আলোর শিখা হয়ে চির জাগরূক আছেন তিনি, চন্দ্রমুখী বসু।