ব্রতচারী প্রবর্তক
গুরু সদয় দত্ত বিনোদ মন্ডল
একুশ শতকের এক বিস্মৃত প্রায় অধ্যায় – ব্রতচারী অনুশীলন। অথচ গোটা বিশ শতক জুড়ে প্রায়,বিশেষতঃ স্বাধীনতার আগে থেকে শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত বাংলার মাঠ -ময়দান- প্রাঙ্গণ মুখরিত থাকত- ব্রতচারীদের কল-কাকলিতে । যার অনবদ্য উদ্ভাবক ছিলেন প্রবর্তকজী গুরুসদয় দত্ত (১০-০৫- ১৮৮২ — ২৫-০৬-১৯৪১)।
ষোলআনা বাঙ্গালি হ’
বিশ্ব মানব হবি যদি
শাশ্বত বাঙ্গালি হ ‘
বিশ্বায়নের দাপটে ,দূরদর্শন আর মুঠোফোনের দর্পণে মাঠমুখো মানুষ আজ শাশ্বত ঘরকুনো বিশ্ব মানবে পরিণত হচ্ছে। গুহাবাসী ছিল যে, সে আজ গৃহবাসী। ফলে শিশু কিশোরদের মাঠমুখো হয়ে সামজিকিকরণের প্রক্রিয়া আজ অচল। সকলের সংগে বাঁচা, সবার মধ্যে সব ভাগ করে বাঁচার পাঠ আজ কে দেবে? শুনবে বা কে এই আত্মকেন্দ্রিক জমানায়। তাই ভুলে গেছি মানুষটিকে – তাঁর ফুল্লকুসুমিত অবদানকে ।
অধুনা বাংলাদেশের সিলেট জেলার,জকিগঞ্জ উপ জেলার বীরশ্রী গ্রামে এই বর্ণময় মানুষটির আবির্ভাব ।পিতা রামকৃষ্ণ দত্ত চৌধুরী ছিলেন মস্ত জমিদার। রানীর রাজত্বে চৌধুরী খেতাব অর্জন করেন ।মাতা- আনন্দময়ী দেবী চৌধুরানী। নিজে অবশ্য নামের গায়ে ব্রিটিশের দেওয়া আলখাল্লা চাপান নি । গ্রামের স্কুল থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজ , নানা প্রতিষ্ঠানে মেধাবী বিচরণের শেষে বিলেত যান । ১৯০৪ সালে আই সি এস ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরেন।
এহেন মানুষটি ছিলেন চাকরিসূত্রে জেলা শাসক, কালেক্টর, কৃষি ও শিল্প সচিব। তার ফাঁকে ব্রতচারী আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্ব জোড়া। সেজন্য তাঁর যাবতীয় লেখালেখি। ১৯৪০এ চাকরি থেকে অবসর নেন। তখনকার দিনে দুরারোগ্য ক্যান্সার বহু মানুষের অকালপ্রয়াণের কারণ হতো। তিনিও ক্যান্সারে মারা যান। তবে তাঁর বিদুষী স্ত্রীর কথা না উল্লেখ করলে এই প্রবন্ধ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি সরোজ নলিনী দে (দত্ত)।
(১৮৮৭-১৯২৫)।তখনকার দিনে নারী সমাজের ঘুম ভাঙাতে এই মহীয়সী, বাংলাদেশের বহু জেলা শহরে মহিলা সমিতি স্থাপন করেন । ঘোড়ায় চড়া, টেবিল টেনিস খেলা, বেহালা বাজানোয় ছিলেন সিদ্ধহস্ত । ‘জাপানে বঙ্গনারী’ নামে একটি মননশীল গ্রন্থের লেখিকা।তাঁর অকাল প্রয়াণের পর গুরুসদয় দত্ত প্রতিষ্ঠা করেন “সরোজ নলিনী স্মৃতি সংঘ”। সক্রিয় এই সংঘের কাজ ছিল সমাজের আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা মহিলাদের জন্য প্রথাবহির্ভূত কাজে প্রশিক্ষণ প্রদান , স্বনির্ভর করার কাজে প্রয়াস গ্রহণ ।
যে ব্রতচারী আন্দোলন মানুষটিকে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা দিয়েছিল – সেই ব্রতচারী চর্চার তিনি একটা তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক ভিত্তি রচনা করে গেছেন । ব্রতচারী কারা? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন -মানুষের জীবনকে সব দিক থেকে সকল প্রকারে সফল, সার্থক ও পূর্ণতাময় করে তুলবার অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য যাঁরা একাগ্র চিত্তে কায়মনোবাক্যে ব্রত পালন করে তারাই ব্রতচারী । তাঁর মতে ব্রতচারী একটা সামাজিক আধ্যাত্মিক উন্নয়নের সোপান ।১৯৩২ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে এর সূচনা করেন তিনি । লক্ষ্য ঘোষিত হল ; দেশ প্রেম, জাতীয় চেতনা, নাগরিকত্ব বোধ জাগ্রত করা ।
মানুষের জীবনকে সার্থক ও আদর্শময় করে গড়ে তুলতে তিনি ব্রতচারী আন্দোলনের দর্শন ও তার তাত্ত্বিক দিক গুলোকে প্রচার করেছেন দেশে বিদেশে । তিনি মনে করতেন পবিত্র এই জীবনে জীবিকা গ্রহণের পূর্বে একটি কিশোরের চরিত্র গঠন জরুরি। যা সম্ভব পঞ্চব্রত পালনের মধ্য দিয়ে । সেগুলি হল:জ্ঞান, শ্রম, সত্য ,ঐক্য ও আনন্দ। জন্মভূমির প্রতি প্রেম, স্বদেশী -সংস্কৃতির সাধনা, সমাজ সেবা, নারীর মুক্তি, শিল্প ও কৃষির বিকাশ করাই হবে ব্রতচারীর কাজ । যারা এই ব্রত গ্রহণ করবে তাদের ব্রতচারী – পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হতে গেলে প্রথমেই প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে হবে তিনটি ভুক্তি । ভুক্তি১। আমি বাংলাকে ভালবাসি । ভুক্তি২। আমি বাংলার সেবা করব ।ভুক্তি ৩। আমি বাংলার ব্রতচারী ।
তারপর পূর্বোক্ত পঞ্চ ব্রত, ব্রতচারীর প্রতিজ্ঞা ,ষোল পণ, ষোল পণের অতিরিক্ত এক পণ, ব্রতচারী ব্রতের মানা (বিধিনিষেধ), ব্রতচারী বৃত্ত ইত্যাদি আবৃত্তির শেষে তরুণ-তরুণীরা পরিবারভুক্ত হতেন । একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর জন্য যত ধরনের কর্মসূচি থাকা উচিত তা অনুসরণ করেছেন গুরুসদয় । গোষ্ঠির অভিবাদন ভঙ্গিমা, বেশভূষা ,মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, স্বাস্থ্য সচেতনতা, সত্যনিষ্ঠা, সংযম, প্রফুল্লভাব, অধ্যবসায়, আত্মনির্ভরতা প্রভৃতি দিক গুলি তখন প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করে । ব্রতচারীর এই দশ দিগন্ত প্রবর্তনের জন্য প্রধান সংগঠক হিসেবে তাঁকে প্রবর্তকজী অভিধায় সম্বোধিত করা হত ।
একটি সুসংবদ্ধ সমিতিকে পরিচালনার জন্য তার অফিস ঘর প্রয়োজন। তিনি কলকাতার ১২নং লাউডন স্ট্রিটে কেন্দ্রীয় অফিস চালু করেন । এরপরই আবশ্যকীয় বিষয় হল প্রচার মাধ্যম। ১৯৩৪ সালে ফরিদপুর ব্রতচারী সমিতি প্রথম “ব্রতচারী বার্তা ” নামে পত্রিকা প্রকাশের কাজ শুরু করে। তারপর ১৯৩৬ সাল নাগাদ “বাংলার শক্তি” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ শুরু করে -বাংলার ব্রতচারী সমিতি। তবে মনে রাখা দরকার, প্রাথমিক ভাবে এই আন্দোলন প্রচুর বাধার সম্মুখীন হয়। এক শ্রেণির মানুষের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে ,ইংরেজরাই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের অভিমুখ ভিন্ন বাঁকে সঞ্চালিত করতে তাদের পেটুয়া অফিসারকে কৌশলে কাজে লাগিয়েছে । যার বাবা আবার ঘটনাচক্রে ব্রিটিশের অনুগত জমিদার । তখনকার বাংলার গভর্নর স্যার জন আন্ডারসন ব্রতচারী আন্দোলনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সে কারণেও শিক্ষিত সমাজে এই দ্বিধা জন্ম নেয় ।
ইউরোপের বহু বিখ্যাত মনীষী এই আন্দোলনে আকৃষ্ট হন।তারা লন্ডন শহরে প্রতিষ্ঠা করেন দু দুটো ব্রতচারী সমিতি । ১। লন্ডন ইন্ডিয়ান ব্রতচারী সমিতি ।২। ব্রিটিশ ব্রতচারী গ্রুপ। ধীরে ধীরে আমেরিকার বহু বুদ্ধিজীবী আকৃষ্ট হন এবং এই সমিতির অন্তর্ভুক্ত হন।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ গুরুসদয় দত্তের কার্যকলাপে যারপরনাই আনন্দিত হন।
১৩৪০ বঙ্গাব্দের ২৫ আষাঢ় গুরুসদয়কে লিখিত আশীর্বাণী পাঠান- “ব্রতচারী অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ুক এই কামনা করি। এই ব্রতচারী পালন করলে প্রাণের আনন্দ, কর্ম্মের শান্তি,চরিত্রের দৃঢ়তা ও লোকহিত সাধনের উৎসাহ দেশে বল লাভ করবে, তাতে সন্দেহ নেই।” গুরুদেব যেমন গুণগ্রাহী ছিলেন, তেমনি বাংলায় এই সমিতির সক্রিয় সংগঠক ছিলেন যে সব উজ্জ্বল প্রতিভা – তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র, ভাষাচার্য সুনীতি কুমার, পল্লীকবি জসীম উদ্দীন, লোক – গবেষক দীনেশ চন্দ্র সেন প্রমুখ । তিনি পেশাগত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের ফাঁকে ফাঁকে সমিতির কাজ সেরেছেন।নিরলস গতিতে। তার সাথে সাথে লোকসাহিত্য সংগ্রহ করেছেন এবং তার সংরক্ষণে মনোনিবেশ করেছেন গুরুসদয়। বেণী বন্ধনের মত সৌকর্য্য ও নিষ্ঠায় পেশাগত বৃত্তি,আদর্শগত কাজ এবং গবেষণা ও গ্রন্থ প্রকাশকে একই সাথে সুসমঞ্জসভাবে সম্পন্ন করতেন তিনি ।ইংরেজি এবং বাংলায় রচিত সবগুলো গ্রন্থ আজ আর সর্বত্র সুলভ নয় ।সরকারি উদ্যোগ ও গুরুসদয় অনুরাগীদের যৌথ প্রচেষ্টায় তাঁর একটি সুসম্পাদিত রচনা সমগ্র প্রকাশিত হলে একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়কে প্রচ্ছদবন্দি করা যাবে।