বঙ্গভারতীর বরপুত্র বঙ্কিমচন্দ্র বিনোদ মন্ডল
‘বঙ্গভারতী সাথে মিলায়ে তোমার আয়ু গনি,
তাই তব করি জয়ধ্বনি।’-রবীন্দ্রনাথ
রামমোহন, বিদ্যাসাগর এবং মধুসূদনের পদরেখা অনুসরণ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে উনবিংশ শতকের অন্যতম অশ্বারোহী পথিকৃৎ ছিলেন যে মানুষটি, তিনি সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (২৬.০৬.১৮৩৮–০৮.০৪.১৮৯৪)। রবীন্দ্রনাথ যার মূল্যায়ণ করতে গিয়ে ‘লেখক কুলগুরু’ শব্দবন্ধ প্রয়োগ করেছেন।
বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন বিরল বহুমুখী প্রতিভাধর পরিশ্রমী মনীষী। ঔপন্যাসিক এবং প্রাবন্ধিক ছিলেন, ছিলেন সাংবাদিক, সংবাদপত্র সম্পাদক। সমাজ চিন্তক। যে সামাজিক প্রেক্ষাপট বঙ্কিমের বিকাশে সহায়তা করেছে, তা মাথায় রেখে তাঁর সম্বন্ধে আলোচনা করা জরুরি। ১৮৫৮ তে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি যখন বি.এ পাশ করলেন তখন বাংলা সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্র পত্রিকার প্রচার ক্রমবিকশিত হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর এর তিনি নিয়মিত তরুণ সেনানী। বাংলা সাহিত্যের নানা শাখা স্বচ্ছন্দ গতি পেতে শুরু করেছে পূর্বোক্ত তিন পূর্বসূরীর হাত ধরে। সঙ্গে আরো অনেক বন্ধু। সমাজ জীবনে নব্য হিন্দুত্ববাদের উত্থান ঘটেছে চুপিসাড়ে। সিপাহী বিপ্লব ঘটে গেল। পাশ্চাত্য শিক্ষার বিশেষত: ইংরেজি শিক্ষার প্রভাব পড়েছে কলকাতা ও কলকাতা সংলগ্ন গঙ্গার দুই পারে। মুৎসুদ্দিগিরি, মজুত দারিসহ শিল্পোদ্যোগে মেতে উঠেছে একশ্রেণীর দেশীয় জমিদার। জন্ম নিচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণী। শিক্ষা সংস্কার যজ্ঞে যুক্ত হচ্ছেন একদল মনস্বী বাঙালি।
বঙ্কিমবাবু সচেতনভাবেই আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পেশা নির্বাচন করলেন। বাবার পদাঙ্ক মাথায় ছিল। যৌথ পরিবার। স্বভাবতই (এম.ও.ই.এস) সাব অর্ডিনেট এক্সিকিউটিভ সার্ভিসে যোগ দিচ্ছেন। পদোন্নতির পর হচ্ছেন ডি.এম.ডি.সি। অর্থাৎ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এন্ড ডেপুটি কালেক্টর। যে পদ এখনও চালু রয়েছে। এই চাকরীর প্রভাব সরাসরি পড়েছে তাঁর সাহিত্য সাধনায়। বদলির চাকরির সুবাদে সারা বাংলায় জীবন কাটিয়েছেন। সাধারণ মানুষের সরাসরি সান্নিধ্যে এসেছেন। তাদের জীবনযাত্রার মান, আর্থিক পরিস্থিতি, পারিবারিক রোজনামচার হাঁড়ির খবর পেয়েছেন নিয়মিত। পাশ্চাত্য সাহিত্য অধ্যয়নের অফুরান সুযোগ পেয়েছেন।
ইতিহাস আশ্রিত রোমান্টিক উপন্যাস গুলি তাঁকে বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। তুঙ্গ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। পাশাপাশি বঙ্গদর্শন সম্পাদনা করতে গিয়ে লিখে ফেলেছেন অজস্র প্রবন্ধ। ধারে ও ভারে কথাসাহিত্য এবং প্রবন্ধ সাহিত্যে সমান মননশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। ১৮৭২–১৮৭৬, মাত্র ৪ বছর বঙ্গদর্শন সম্পাদনা করেছেন তিনি। এই সময়ে অসংখ্য লেখায় খিদে মিটিয়েছেন নিজের পত্রিকার।
সমসময়ে সংবাদ প্রভাকর ছাড়াও সমাচার দর্পণ, সংবাদকৌমুদী ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় সমাজ, সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব, বিজ্ঞান এমনকি রাজনীতি বিষয়ক নানা লেখা ছাপা হচ্ছে। কখনো কখনো তিনি এখানে লিখেছেন। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, বঙ্গদর্শনে একটা নতুন ধারা চালু করার চেষ্টা করেছেন তিনি। সে ধারা ভিন্নধর্মী সমালোচনার ধারা। হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে নতুন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন নিয়মিত। কৃষ্ণচরিত্র, ধর্মতত্ত্ব, শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা প্রভৃতি ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে বঙ্গদর্শনে।
১৮৮০ সালের পর বঙ্কিম সাহিত্য স্পষ্ট নতুন পথে মোড় নিচ্ছে। ১৮৮২ তে প্রকাশিত হচ্ছে বহু আলোচিত তিনখানা উপন্যাস। কিছু আগে পরে আসছে সেগুলো। আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরানী ও রাজ সিংহ। ১৮৮৮ তে প্রকাশিত হচ্ছে সীতারাম।প্রথম দুখানি উপন্যাসে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে হিন্দুর বিজয়বার্তা ঘোষিত হচ্ছে।পরবর্তী দুখানি উপন্যাসে মুসলমানের বিরুদ্ধে হিন্দুর যুদ্ধ ও জয় লাভ।সবমিলে এই সময়ের বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যসম্রাট থেকে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রে উন্নীত হচ্ছেন। তিনি তখন নব্য হিন্দুবাদের প্রচারক। একক হিন্দু জাতি গঠনের প্রবক্তা। হিন্দু দেশপ্রেম, হিন্দু জাতীয়তাবাদের মতাদর্শ সংক্রমিত হচ্ছে উপন্যাসের পাতায় পাতায়। ব্যাখ্যা দিচ্ছেন অনুশীলন তত্ত্বের। বন্দেমাতরম, মাতৃভূমি, জন্মভূমি, স্বরাজ, মন্ত্র প্রভৃতি শব্দ তাঁর কাছে তখন দেশপ্রেমের নতুন বীজ মন্ত্র।
১৮৮৫ তে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। মধ্যপন্থি নেতারা সবাই পড়ে ফেলেছেন আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরানী। তবে প্রথম প্রথম তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না তাকে।বিশ শতকের শুরুতে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন বঙ্কিম। স্বদেশী আন্দোলনে ‘বন্দেমাতরম’গানটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। জাতীয় কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে ‘বন্দেমাতরম’ স্লোগানে। যত জনপ্রিয়তা ততো বিতর্ক জন্ম নিচ্ছে তখন। উপন্যাস ও প্রবন্ধের সংলাপ, বচন উদ্ধৃত করে বিরুদ্ধবাদীরা তাঁর অন্তরে জমে থাকা ধর্মবিদ্বেষ নিয়ে কাটাছেঁড়া করছেন অহরহ।
আধুনিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে ১৯ শতকের শেষ তিন দশকে প্রায় ৭০০ পত্রপত্রিকা ঊর্মিমালার মতো জন্ম নিয়েছে বাংলায়। বঙ্কিমের লেখা ছাপতে হাপিত্যেশ হয়ে ধরনা দিচ্ছে বাড়িতে। শেষ জীবন কেটেছে যেখানে, সেই কলকাতা মেডিকেল কলেজের সামনে, প্রতাপ চ্যাটার্জী গলিতে। যেখানে ১৮৯৪ তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বঙ্কিমচন্দ্র। না, অনুরোধ-উপরোধে সাড়া দিচ্ছেন না তিনি। এক,ব্যস্ততা। দুই, অসুস্থতা। শুধু লিখেছেন সুনির্বাচিত কয়েকটি পত্রিকায়। নিজের ঘনিষ্ঠ অক্ষয় সরকার সম্পাদিত সাধারণী পত্রিকায়, নবজীবন পত্রিকায়,জামাতা রাখাল চন্দ্র সম্পাদিত প্রচার পত্রিকায়। রাখালকে সামনে রেখে প্রচার এর সমস্ত কাজ নিজে তত্ত্বাবধান করেছেন।
বাংলা সাহিত্যের বিকাশে এমনই অনন্য যে মানুষটির ভূমিকা,তাঁকে যোগ্য মর্যাদা দেওয়ার কাজটি বাঙালি এখনো সেভাবে শুরু করতে পারেনি, এটাই আক্ষেপের। সবচেয়ে আশ্চর্যের, গুরুত্বপূর্ণ পদে যিনি দীর্ঘদিন কাজ করেছেন, সততা, নিষ্ঠা, আত্ম মর্যাদার সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট সংখ্যক প্রতিকৃতি দুর্লভ। ব্রিটিশদের কাছে রায়বাহাদুর খেতাব অর্জন করেছিলেন তিনি। কিন্তু খেদের কথা তারাও সেভাবে সুবিচার দেখাননি। আজও বঙ্কিমচন্দ্রের নামে কোনও বহুমুখী গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা যায়নি। তাঁর নামাঙ্কিত একটি বঙ্কিম পুরস্কার রাজ্য সরকার অনিয়মিত প্রদান করে, যাতে প্রাপকের যোগ্যতামান নিয়ে মাঝে মাঝে প্রশ্ন ধূমায়িত হয়।
যেকোনো সমৃদ্ধ ভাষার অগ্রগণ্য স্রষ্টার প্রকাশিত গ্রন্থ গুলির প্রথম সংস্করণ সংরক্ষিত রয়েছে। এক্ষেত্রেও বঙ্কিম বঞ্চিত। এমনকি সব গ্রন্থের সব সংস্করণ আজও সর্বত্র সহজলভ্য নয়। প্রতিটি সংস্করণে তিনি সংশোধন ও সম্মার্জন করতেন নির্মমভাবে। শুধু দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসের ১৩টি সংস্করণ তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছিল।চাইলেই সেসব গবেষণার স্বার্থেও খুঁজে পাবেন না আজ। সমস্ত অপ্রকাশিত রচনা আজও উদ্ধার করা যায়নি। সব চিঠি পত্রের সুসম্পাদিত সংকলন এখনো প্রকাশিত হয়নি।এমনকি বঙ্কিমচন্দ্রের সব উপন্যাসের ইংরেজিতে অনুবাদ কার্য সম্পন্ন হয়নি। বহির্বিশ্ব তাঁকে চিনবে কীভাবে? একটা আন্তর্জাতিক মানের বঙ্কিম ভবনের সন্ধান বাংলার কোনো শহরে রয়েছে কিনা, আমার জানা নেই। যে ভবনে, মিউজিয়াম, লাইব্রেরী, রিসার্চ হল, ওয়ার্কশপ,আর্কাইভ, প্রেসক্লাব, কনফারেন্স হল থাকা দরকার। না, নেই। এ জ্বালা কখন জুড়োবে?
বঙ্কিমচন্দ্র আক্ষেপের সুরে লিখেছেন ‘বাঙালি জাতির ইতিহাস নেই।’তাঁরই সুভাষণ ধার করে বলতে ইচ্ছে হয়- বাঙালি জাতির জন্য, বাঙালি দ্বারা, বাঙালি বঙ্কিমচন্দ্রের একবিংশ শতকেও কোন ইতিহাসের হদিশ নেই।