Homeএখন খবরক্রান্তিকালের মনীষা -৪৫: রজনীকান্ত সেন ।। বিনোদ মন্ডল

ক্রান্তিকালের মনীষা -৪৫: রজনীকান্ত সেন ।। বিনোদ মন্ডল

কান্তকবি
রজনীকান্ত সেন
বিনোদ মন্ডল                                                                      ● বাংলা নবজাগৃতির ইতিহাসে সংগীতের সুদূরপ্রসারী অবদান সর্বজন স্বীকৃত।চলতি কথায় যাকে বলি বাংলা গান, আবার সেই বাংলা গানের ইতিহাসে হীরকদ্যুতি ছড়িয়েছে পঞ্চ দিকপাল । অতুলপ্রসাদ, রবীন্দ্রনাথ ,দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত এবং নজরুল ।আদতে ছিলেন কান্ত কবি ।রাজশাহীর পল্লী কবি । স্বদেশী আন্দোলনের ঝাপটায় হয়ে উঠলেন অবিভক্ত বাংলার জাতীয় কবি । তিনি রজনীকান্ত সেন (২৬-০৭- ১৮৬৫—১৩-০৯-১৯১০)।

মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়
মাথায় তুলে নেরে ভাই;
দীন দুঃখিনী মা যে তোদের
তার বেশী আর সাধ্য নাই ।
ঐ মোটা সুতোর সংগে মায়ের
অপার স্নেহ দেখতে পাই;
আমরা, এমনি পাষাণ ,তাই ফেলে ঐ
পরের দোরে ভিক্ষা চাই ।
ঐ দুঃখি মায়ের ঘরে, তোদের
সবার প্রচুর অন্ন নাই ।
তবু তাই বেচে কাচ, সাবান মোজা,
কিনে করলি ঘর বোঝাই।
আয়রে আমরা মায়ের নামে
এই প্রতিজ্ঞা করব ভাই;
পরের জিনিষ কিনবো না, যদি
মায়ের ঘরের জিনিষ পাই ।

অশ্রু এবং আগুনে মেশানো এ গান জন্ম নিয়েছিল ১৯০৫ এর আগস্টে। ৷ অগ্নিস্রাবী কলকাতায় । অক্ষয় কুমার সরকারের মেসে বসে রজনীকান্ত এর স্থায়ী এবং অন্তরা টুকু লেখেন । বাকি অংশ লেখা হয় বসুমতীর দপ্তরে । বলা ভালো জলধর সেনের টেবিলে । তাঁর মুখোমুখি বসে । একদিকে লেখা হচ্ছে । পাশাপাশি চলছে কম্পোজ । টাইপ সেটিং । ছাপাও হয়ে গেল ।সান্ধ্য বসুমতী ছড়িয়ে গেল কলকাতাময় । সেই সন্ধ্যাতেই জলধর সেন বিডন স্ট্রিটের একটি বাড়িতে কাজে গিয়েছিলেন। কথার ফাঁকে
হঠাত্‍ কানে এল – রাজপথে সম্মেলক সংগীত – মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়।কলকাতার দামাল ছাত্র সমাজ কণ্ঠে নিয়ে অবিনাশী গান, রাজপথে তুফান তুলতে শুরু করেছে ।
১৯০৫ সালে ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে আয়োজিত সভা রূপ নেয় জনসভায় । সেখানেই বক্তারা তুলে ধরেন স্বদেশি আন্দোলনের অভিমুখ ।একদিকে বিলাতি পণ্য বর্জন। অন্য দিকে স্বদেশি পণ্য গ্রহণ।আমেদাবাদ ও বম্বের অধিবাসীরা তখন অনেক এগিয়ে । তারা ইতোমধ্যে ভারতে তৈরী বস্ত্র পরিধান শুরু করে দিয়েছেন । যত দ্বিধা পূর্বাঞ্চলে । এই একটি গান মানুষের মনের সব জড়তা ও দ্বিধা কাটাতে বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করেছে সেদিন । এমন বহু মানুষ আছেন আজ,ঐ গানের বাণী শুনেছেন, কিন্তু স্রষ্টাকে গেছেন বেমালুম ভুলে ।

রজনীকান্তের আর একটি সর্বজনবিদিত ভক্তিগীতি হল-” তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে।” এই গান প্রার্থনা সংগীত হিসেবে প্রচলিত । বিশেষতঃ নতুন বিদ্যার্থী বা কিশোর ছাত্র ছাত্রীদের চরিত্র গঠনে এই গান অনবদ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে শতাব্দী জুড়ে ।সাহিত্যের নানা আঙ্গিকে বিচরণ করেছেন রজনীকান্ত ।নাটক পরিচালনা ও অভিনয়ে বিশেষতঃ সংগীত পরিচালনায় বিভোর থেকেছেন যৌবনে। তবু আজকের দিনে তাঁর মূল্যায়ণ করতে গিয়ে তাঁকে সংগীতজ্ঞ বলতেই বেশি ভালো লাগে ।তিনিই গীতিকার তিনিই সুর স্রষ্টা বা প্রয়োগশিল্পী। তিনিই গায়ক বা কণ্ঠশিল্পী । একটানা পাঁচ সাত ঘন্টা গান গেয়েছেন বছরের পর বছর!দিনে-রাতে।

তাঁর লেখা গানগুলি প্রথমতঃ প্রকাশ পেত রাজশাহী শহরের উৎসাহ মাসিক পত্রিকায়। পরে কান্ত কবির জীবদ্দশায় গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় বাণী (১৯০২) কল্যাণী (১৯০৫) ও অমৃত (১৯১০) গীতি সংকলন।তাঁর প্রয়াণের পর অভয়া (১৯১০), আনন্দময়ী (১৯১০), বিশ্রাম (১৯১০), সদ্ভাবকুসুম (১৯১৩), এবং শেষদান (১৯১৬) প্রকাশিত হয় ।গবেষকগণ এই গানগুলির প্রকৃতি অনুযায়ী চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন ।সেগুলি হল; স্বদেশ, ভক্তি, প্রেম ও হাস্য পর্যায় ।এর মধ্যে হাসির গানের অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর বন্ধু কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ।অপরাপর গানে তিনি যেমন রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছেন তেমনি রবীন্দ্রনাথও নানা স্থানে তাঁর সংগীত পরিবেশন করে প্রচারে সহায়তা দিয়েছেন । একবার শ্রীহট্টে আয়োজিত মহিলা সমিতির সভায় সংগীত পরিবেশনের জন্য আমন্ত্রণ পান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । উপস্থিত সভ্যগণের অনুরোধে নিজের কয়েকটি গান পরিবেশনের পর কান্ত কবির “তুমি নির্মল করো ” প্রার্থনা সংগীতটি পরিবেশন করেন । তাঁর অবেগদীপ্ত গলা ও নিবেদিতপ্রাণ গায়কিতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যান অগ্রগণ্য মহিলা সমাজ ।
কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়, নীলা মজুমদার,পান্নালাল ভট্টাচার্য সহ মান্না, হেমন্ত, আরতি, সন্ধ্যা, উত্পলা সেন, অনুপ ঘোষাল ও শ্রীকান্ত আচার্য্যরা রজনীকান্তের গানের ডালি কণ্ঠে নিয়ে আসরের পর আসর জয় করেছেন ।

বর্ণময় সংগীত প্রতিভা তিনি পেয়েছেন বংশ সূত্রে ।বাবা গুরু প্রসাদ সেন ছিলেন প্রখ্যাত বৈষ্ণব পদকর্তা । তাঁর “পদচিন্তা মনিমালা” গ্রন্থটি তখনকার সমাজে পরিচিতি পেয়েছিল । গানপাগল ছিলেন বলেই পেশা জগতে সাফল্য চির অধরা রয়ে যায় তাঁর ॥১৮৯১ সালে আইন পাশ করেন (বি. এল.) । বাবা গুরুপ্রসাদ ছিলেন কালনা কোর্টের মুন্সেফ ।সাধ ছিল তাঁর তৃতীয় সন্তান রজনীকান্ত রাজশাহী কোর্টে চুটিয়ে ওকালতি করবে । মুন্সেফ হবে । মুন্সেফ হয়েও ছিলেন তিনি । কিছুদিন নাটোরে এবং নওগাঁয় অস্থায়ী মুন্সেফ ছিলেন কিন্তু মন পড়ে থাকতো সংস্কৃতি চর্চায় ।কিশোর বয়স থেকেই তিনি শ্যামা সংগীত রচনায় প্রবৃত্ত হন ।অন্তরে অটল ভক্তি নিয়ে অসংখ্য কালী সংগীত রচনা করেছেন ।তাই আচার্য্য দীনেশচন্দ্র সেন কবিকে বাংলার দ্বিতীয় রামপ্রসাদ অভিধায় অভিহিত করেছেন।

রাজশাহীতে কবির পত্নী হিরণ্ময়ীদেবী এবং ছেলে মেয়েদের নিয়ে সময় কাটছিল খুব সুন্দর ।গান নাটক সাহিত্য চর্চায় একেবারে মশগুল ছিলেন এমন সময় পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসে। পরপর দুটি সন্তান প্রয়াত হয় । সেজ ছেলে ভূপেন্দ্রনাথ এবং বড় মেয়ে শতদল বাসিনী । পুত্রকে হারিয়ে গানে গানে আশ্রয় পেতে রচনা করেছেন —
তোমারি দেওয়া প্রাণে তোমারি দেওয়া সুখ
তোমারি দেওয়া বুকে
তোমারি অনুভব।
তোমারি দু -নয়নে ,
তোমারি শোকবারি
তোমারি ব্যাকুলতা
তোমারি হা হা রব ।
এরপর আঘাত এলো মর্মান্তিক । একান্নবর্তী সংসারের রাশ ধরে রেখেছিলেন যে জ্যেঠতুতো ভাই উমাশংকর, ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন তিনি ।বহু অর্থ ব্যয়ে ব্যর্থ চেষ্টার পর বিপুল ঋণভার সংসারের ঘাড়ে চাপিয়ে চলে গেলেন তিনি ।শিল্পী রজনীকান্তের কাঁধে এসে পড়ল সংসারের জোয়াল। বৈষয়িক বিষয়ে বিতৃষ্ণ মানুষটি চিঠিতে তাই লিখেছেন— “আমি আইন ব্যবসায়ী, কিন্তু ব্যবসা করিতে পারি নাই। কোন দুর্লংঘ্য অদৃষ্ট আমাকে ওই ব্যবসায়ের সহিত বাঁধিয়া দিয়েছিল। কিন্তু আমার চিত্ত উহাতে প্রবেশ লাভ করিতে পারে নাই ।”—

রজনীকান্তের দুর্ভোগের চূড়ান্ত আকার দেখা দিল এবার ।১৯০৯ সালে গলায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হন । নানা চিকিৎসায় কাজ না হওয়ায় কলকাতায় আনা হয় তাঁকে ।তাতেও কাজ হয়না। চলে যান কাশীতে ।থাকেন কয়েক মাস ।কোনো পরিবর্তন নেই ।আর্থিক দুরবস্থার কারণে ” বাণী” ও “কল্যাণী “কাব্য গ্রন্থ দুটির স্বত্ব বিক্রি করেন মাত্র চারশো টাকায় । এবার কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয় তাঁকে।১৯১০ এর ১০ ফেব্রুয়ারি ডেনম্যান হুয়াইট এর নেতৃত্বে একদল চিকিৎসক ট্রাকিওটমি অপারেশন করেন কবির । সাময়িক আরোগ্য লাভ করলেও আজীবন বাকরুদ্ধ থেকে যান তিনি ।হাসপাতালের ১২ নং কটেন ওয়ার্ডে পাকাপাকি ঠাঁই হয় তাঁর ।

১১জুন দেখতে আসেন রবীন্দ্রনাথ । তখন কবির পুত্র ক্ষিতীন্দ্রনাথ এবং কন্যা শান্তিবালা হারমোনিয়াম বাজিয়ে বাবাকে গান শোনাছিল- -আমায় সকল রকমে কাঙাল করেছে।বিশ্বকবিকে দেখে আনন্দ বিহ্বল কান্ত কবি সেদিনের রোজ নামচায় লিখেছিলেন–‘আজকে রবি ঠাকুর আমাকে বড় অনুগ্রহ করে গেছেন । আমাকে তিনি বলেছেন আপনাকে পূজা করতে ইচ্ছা করে । শুনে আমি লজ্জায় মরি ‘।শান্তিনিকেতন থেকে তাঁর গুণমুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে লিখেছিলেন –`সেদিন আপনার রোগশয্যায় পার্শে বসিয়া মানবাত্মার একটি জ্যোতির্ময় প্রকাশ দেখিয়া আসিয়াছি । শরীর হার মানিয়াছে কিন্তু চিত্ত কে পরাভূত করিতে পারে নাই ।কণ্ঠ বিদীর্ণ হইয়াছে কিন্তু সংগীতকে নিবৃত্ত করিতে পারে নাই ।`

RELATED ARTICLES

Most Popular