নিজস্ব সংবাদদাতা: সাধারন মানুষ থেকে, বিরোধী নেতা, রাজ্যপাল সবাই সামনে এনেছেন প্রশ্নটা, মৃতদেহের প্রতি যে নূন্যতম সম্মান এই সভ্য দুনিয়ায় দেখানো হয় তার বিন্দুমাত্র কী অবশিষ্ট রইলনা?সংষ্কৃতির শহর বলে গর্বের কলকাতায় এ কোন দৃশ্য?লোহার লম্বা আঁকশিতে গেঁথে নেওয়া হচ্ছে ঘাড়ের দিকটা তারপর টেনে হিঁচড়ে তোলা হচ্ছে গাড়ির ভেতর।গলে গলে পড়ছে মাংস, রস। পচা গলা দেহ, খসে খসে পড়ছে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। এক ভয়ঙ্কর অমানবিক সেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে মহানগরের কোনায় কোনায় যা দেখে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সাধারন মানুষ থেকে বিরোধী দলনেতা, রাজ্যপাল সবাই।কলকাতা পুরসভার গাড়িতে তোলা একের পর এক সেই মৃতদেহ দেখে স্তম্ভিত মানুষ।
বুধবার রাত থেকেই সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল ঘুরছে সেই ভিডিও যা ঘিরেই তৈরি হয়েছে প্রবল বিতর্ক। কিন্তু সেই বিতর্ক প্রাতিষ্ঠানিক মাত্রা পায় বৃহস্পতিবার দুপুরে যখন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় ওই ভিডিয়ো প্রসঙ্গ তুলে একটি ট্যুইট বার্তায় বলেন, ‘‘আমাদের সমাজে মৃতদেহকে সম্মান দেখানোটাই রীতি। যে ভাবে ওই দেহগুলি দাহ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তা অবর্ণনীয় এবং অসংবেদনশীল। গোটা বিষয়টি আমাকে ব্যথিত করেছে। আমি স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে গোটা বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চেয়েছি।” বৃহস্পতিবার বিকেলে ফের একটি ট্যুইট করে তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রসচিব মেনে নিয়েছেন, ওই দেহগুলি দাহের ক্ষেত্রে সঠিক বন্দোবস্ত করা হয়নি। রাজ্যপালের দাবি, ভবিষ্যতে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে দেহ দাহ করা হবে বলেও তাঁকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রসচিব।
যদিও এরই মধ্যে একটি নতুন বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে কলকাতায় যেখানে বলা হয়, করোনা আক্রান্তদের দেহ পোড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ওই শ্মশানে কিন্তু স্থানীয় মানুষের বাধায় ও বিক্ষোভের জেরে পুরসভা ফেরৎ নিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যদিও সেই বক্তব্য ভিত্তিহীন বলে পুলিশের কাছে দাবি করেছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর।
জানা গেছে গড়িয়ার বোড়ালে অবস্থিত ওই শ্মশান কলকাতা পুলিশের বাঁশদ্রোণী থানা এলাকার অন্তর্গত। ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে, পরনে গামছা এবং পায়ে গামবুট পরে কয়েকজন ডোম শ্মশানের ভিতর থেকে মৃতদেহগুলির গলায় দড়ি বা লোহার আঁকশি জাতীয় কিছু দিয়ে মাটিতে ঘষটে টেনে পুরসভার গাড়িতে তুলছেন। প্রত্যেকটি দেহেই পচন ধরে গিয়েছে, চামড়া-মাংস খুলে হাড় বেরিয়ে গিয়েছে। প্রথমে মৃতদেহ গুলি শ্মশানে নামানো হয় পরে স্থানীয়দের বাধার মুখে ফের সেগুলি গাড়িতে তোলা হচ্ছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ওই দিন দুপুরে কলকাতা পুরসভার একটি শববাহী গাড়ি শ্মশানে ঢোকে। তার পর একের পর এক দেহ নামানো শুরু হয়। পচা-গলা দেহ হওয়ার গোটা এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। সেই দুর্গন্ধের উৎস খুঁজতে শ্মশানে ছুটে আসেন এলাকার মানুষ। তাঁরা জানতে পারেন, পুরসভার গাড়িতে করে একাধিক পচাগলা দেহ নিয়ে আসা হয়েছে সৎকারের জন্য। সেই দেহ থেকেই দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এর পর তাঁরা শ্মশানের মূল দরজা বন্ধ করে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করলে পুরসভার কর্মীরা শ্মশান থেকে ফের দেহগুলি তুলে নিয়ে চলে যান। ওই দেহগুলি কাদের এবং কোথা থেকে এল তা নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, দেহগুলি করোনা আক্রান্তদের।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ওই ভিডিয়ো ঘিরে বিতর্ক তৈরি হলে কলকাতা পুলিশের একটি সূত্র দাবি করে যে, স্বাস্থ্য দপ্তর তাদের জানিয়েছে দেহগুলি করোনা-আক্রান্তদের নয়।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে চেনা না যায়। চিকিৎসার অভাবে মারা গিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের মৃতদেহের প্রতি এই ব্যবহার! পুরসভার উচিত, যাবতীয় তথ্য দিয়ে মৃতদেহের তালিকা মানুষকে জানানো। অপদার্থ মেয়রকে দায় নিতে হবে। বাসি মেয়র হয়ে ক্ষমতা দখল করে বসে আছেন!’’
বিধানসভার বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী এ দিন বলেন, ‘‘ভিডিয়োটি আমি দেখেছি। পুরসভার প্রশাসক বোর্ডের চেয়ারম্যান ফিরহাদ হাকিমকে এ বিষয়ে চিঠিও লিখেছি। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে স্থানীয় মানুষ বিক্ষোভ দেখাবেন, সেটাই স্বাভাবিক। মানুষ সঠিক তথ্য জানতে চায়। এই ঘটনা সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য অবিলম্বে প্রকাশ করুক পুরসভা। না হলে জনমানসে সন্দেহ এবং বিরক্তি থাকবে।’’
তবে কলকাতা পুরসভা দাবি করেছে দেহগুলি করোনা আক্রান্তদের নয়, ওগুলি দাবি হীন মৃতদেহ যা কিনা ধাপাতে দাহ করা হত কিন্তু বর্তমানে ধাপায় করোনায় মৃত হিন্দুদের দেহ দাহ করার স্থান নির্ধারিত হওয়ায় পুরসভার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ওই দেহগুলি বোড়ালের গড়িয়া আদি মহাশ্মশানের ৪ নম্বর চুল্লিতে পোড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এও জানা গিয়েছে যে মৃতদেহ গুলি নীলতরন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মর্গে থাকা বেওয়ারিশ অর্থাৎ যার কোনও দাবিদার নেই। হাসপাতালের প্রিন্সিপাল বৃহস্পতিবার কলকাতা পুলিশকে জানায় যে হাসপাতালের মর্গ থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এবং বেওয়ারিশ তালিকাভুক্ত ১৪টি দেহ কলকাতা পুরসভাকে হস্তান্তর করা হয়েছিল দাহ করার জন্য। তবে দেহগুলি কোভিড আক্রান্তদের নয়। ঘটনা যাই হোকনা কেন, একসঙ্গে এতগুলো লাশ হঠাৎ করে চলে আসায় স্থানীয় বাসিন্দারা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন দেহগুলি করোনা আক্রান্তদের বলে। আর যে পদ্ধতিতে লাশগুলি বহন করা হয়েছিল তা অত্যন্ত অমানবিক।