নিজস্ব সংবাদদাতা: সবাই আছে কিন্তু কেউ নেই! আছে শুধু হিম শীতল নিঃসঙ্গতা, আছে জ্বর, আছে শ্বাসকষ্ট, আর আছে করোনা। সেই নিঃসঙ্গতা, সেই জ্বর, কাশি আর করোনা নিয়ে নিঃশব্দে মৃত্যু হল ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধের। বাড়ির মালিক যিনি এই কটা দিন ওই বৃদ্ধকে দু’বেলা খাবার পৌঁছে দিতেন, বৃহস্পতিবার সকালে উঠে দেখেন নিথর , নীরব দেহ পড়ে রয়েছে। সাকিন খড়গপুর শহর। খড়গপুর পৌরসভার ১৪নম্বর ওয়ার্ড মালঞ্চ এলাকার বিবেকানন্দপল্লীর ঘটনা।
যে বাড়িতে বৃদ্ধ ভাড়া থাকতেন তাঁর মালিক শহরের একটি রাজনৈতিক দলের নেতা শৈবাল চ্যাটার্জি জানিয়েছেন, “কয়েকদিন ধরেই জ্বরে ভুগছিলেন, দুর্বলতা ছিল। কোভিড ধরা পড়েছিল। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। স্ত্রীও ছিলেন না। আমরাই দু’বেলা খাবার দিয়ে যেতাম। ডাক্তার দেখাতে বলেছিলাম কিন্তু রাজি হননি। শেষ অবধি মারা যাবেন ভাবতেই পারিনি।” শৈবাল বাবুই ফোন করে মেয়েদের জানান। বৃহস্পতিবার দুপুর নাগাদ এসে পৌঁছান তাঁরা। এরপর প্রশাসন দায়িত্বভার নেয় সৎকার করার জন্য।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে রেলের অবসরপ্রাপ্ত ওই কর্মীর তিন মেয়েরই বিয়ে হয়েছে রাজ্যের বাইরে, ওড়িশায়। কিছুদিন আগেই মেয়েদের কাছে গেছিলেন বৃদ্ধের স্ত্রী। তারপর থেকে একাই ছিলেন বৃদ্ধ। নিজেই বাজার ঘাট ও রান্না করে খাচ্ছিলেন। দিন পাঁচেক আগে জ্বর আসে সঙ্গে কাশি পরে করোনা ধরা পড়ে। যদিও প্রথম দিকে মৃদু উপসর্গ ছিলেন। তা স্বত্ত্বেও খড়গপুর টাউন থানার পুলিশ যোগাযোগ করে তাঁর সাথে। কোনও সাহায্য চাই কিনা জিজ্ঞাসাও করে। অসুবিধা হলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথাও বলে কিন্তু বৃদ্ধ রাজি হয়নি।
জানা গেছে রেল হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোনও হাসপাতালে যাননি ওই বৃদ্ধ কিন্তু স্যানিটাইজেশনের কারনে রেলের হাসপাতাল কয়েকদিন বন্ধ থাকায় সেখানে যাওয়ার উপায় ছিলনা তাঁর। এদিকে শরীর খারাপ হওয়ার পরও পাশে কাউকে না পেয়ে অভিমান আরও বেড়ে যায় তাঁর। যে কারনে তিনি পুলিশ বা বাড়ি ওয়ালার কোনও পরামর্শ না মেনেই এক প্রকার স্বেচ্ছা মৃত্যুই বরন করেছেন। নিঃসঙ্গতা যেমন তাঁকে অত্যন্ত হতাশাগ্রস্ত করে তোলে অন্যদিকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। হয়ত জীবন থেকে মুক্তিই চেয়েছিলেন তিনি। খড়গপুর মহকুমা হাসপাতালের সুপার কৃষ্ণেন্দু মুখার্জী জানিয়েছেন, শহরের মালঞ্চ প্রান্তে এক বৃদ্ধের মৃত্যুর খবর পেয়েছি। করোনা আক্রান্ত ছিলেন তিনি।
মনোবিদরা জানাচ্ছেন, নিঃসঙ্গতা ক্রমশ মনের মধ্যে একটা অবস্থা তৈরি করে যা তাঁর বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাকেই নষ্ট করে দেয়। পরিবারের সবার প্রতিই এক তীব্র অভিমান তৈরি হয়। মানুষটি ভাবতে শুরু করেন, যাদের জন্য এত করলাম, যাদের বড় করলাম প্রতিষ্ঠিত করলাম, তারা আজ কেউ নেই আমার অসুস্থার পাশে। মনোবিদরা আরও বলেছেন, ‘মানুষ তার চূড়ান্ত বিপদে একা লড়াই করতে পারে কিন্তু গভীর অসুস্থায় প্রিয়জনের সাহচর্য চায়। না পেলে বঞ্চনার অভিমান চেপে বসে, নিজের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে, বাঁচার ইচ্ছা নষ্ট হয়ে যায় আর যে কোনও গভীরতর অসুখে ওষুধ আর পথ্যের পাশাপাশি বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাও জরুরি।”
করোনা আক্রান্ত অবস্থায় খড়গপুর শহরের এই ১৮তম মৃত্যুটি স্বেচ্ছামৃত্যু কিনা তার উত্তর এখন আর পাওয়া যাবেনা কিন্তু এটা ঘটনা যে বয়স্ক নাগরিকরা এখন পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে আরও একটু সময় আশা করে, আরও একটু সাহচর্য।