নিজস্ব সংবাদদাতা: ১৯৮৩ সালের ১০ই আগষ্ট খুন হয়েছিলেন সিপিএম নেতা জামসেদ আলি। পরে তার নামেই পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুরে সিপিএম তৈরি করেছিল শহিদ জামসেদ আলি ভবন। কেশপুর সিপিএমের সাবেক জোনাল কমিটির অফিসই ছিল সিপিএমের দুর্গ। সিপিএমের হিসাবে কেশপুরের মাটিতে আজ অবধি খুন হয়েছেন জামসেদ আলি সহ ৬৮ জন সিপিএম নেতা কর্মী। আর ১৯৯৮ মানে তৃনমূল পার্টির জন্মের পর মমতা ব্যানার্জীর সেই শ্লোগান, ‘কেশপুর হবে সিপিএমের শেষপুর’কেশপুরের মাটিতে তৃনমূলের হাতে এখনো পর্যন্ত ৪২ জন কে খুন হতে হয়েছে।
এমনটাই দাবি সিপিএমের আর সেই দাবি অনুযায়ী ২০১১ সালের পর থেকে শুরু হওয়া পরিবর্তনের জামানায় খুন হয়েছেন ৬ জন। ২০১১ সাল পর্যন্ত এই জামসেদ আলি ভবনই ছিল কেশপুর সিপিএমের হৃদপিন্ড। এখান থেকেই স্থানীয় পার্টি অফিস গুলোর মধ্য দিয়ে পরিচালিত হত সিপিএমের কাজ কর্ম। তৃণমূলের দাবি, তৃনমূল বিরোধী সমস্ত পরিকল্পনার উৎস ছিল জামসেদ আলি ভবন। এমনটা নয় যে জামসেদ আলি ভবন একাই মার খেয়ে গেয়েছে, পাল্টা লড়াইও দিয়েছে সে। ১৯৯৮ থেকে শুরু করলে তৃনমূলেরও ৫০ জন নেতা কর্মীর প্রান গিয়েছে এই সিপিএম বিরোধি সংগ্রামে।
২০১১ সালের পর কেশপুর সিপিএমের বিভিন্ন পার্টি অফিস দখল নিতে শুরু করে তৃনমূল। মারধর, জরিমানা, মামলা, বয়কট ইত্যাদির মুখে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয় সিপিএমের প্রায় সর্বস্তরের নেতৃত্ব। লালঝান্ডা তোলার লোকই পায়না সিপিএম। একে একে স্তব্ধ হয়ে যায় ৯৯% দলীয় কার্যালয়। জামসেদ ভবনেও বারবার হামলা চলে। একসময় বন্ধ হয়ে যায় জামসেদ আলি ভবন। অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে জামসেদ আলি ভবনে দাঁড়িয়ে আর জামসেদ আলি স্মরণ করা যায়নি। সেটা করতে হত ২০ কিলোমিটার দুরে মেদিনীপুর শহরে।
কিন্তু পালা ঘুরল এবার, ৯ বছর পেরিয়ে ১০বছরের মাথায় ফের লালে লাল জামসেদ আলি ভবন। কোভিড পর্বেও নজর কাড়া ভিড়ে জামসেদ আলি সহ ৬৮ জনকে স্মরণ করলেন সিপিএম নেতা কর্মীরা। কিন্ত কেন এই পরিবর্তন? উত্তর দুটো, এক, তৃনমূল নেতাদের বিরুদ্ধে পাহাড় প্রমান দুর্নীতির অভিযোগ আর দুই, নিজেদের মধ্যে প্রবল গোষ্টি দ্বন্দ্ব। পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে ঠিকাদারি সিন্ডিকেট, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা থেকে হাল আমলের আমফানের ক্ষতিপূরণ সর্বত্রই কাটমানি আর স্বজন পোষনের বিস্তর অভিযোগ। ২০১১ সালের পর প্রচুর গরিব মানুষের পাট্টা পাওয়া জমি বেদখল হয়েছে। লকডাউন দেখিয়ে দিয়েছে উর্বর মাটির কেশপুর, ধানের পাশাপাশি আলু উৎপাদনেও শক্তিশালী কেশপুরে ১২হাজার পরিযায়ী শ্রমিকের জন্ম হয়েছে।
পেটের দায়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে কেশপুরের বেকার যুবকের দল। অন্যদিকে নেতার বউয়ের আর নেত্রীর স্বামীর চাকরি হয়ে গেছে। দুর্নীতি যার স্বজন পোষনের এই চিত্রের পাশাপাশি রয়েছে গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের তীব্র চোরা স্রোত। বছর তিনেক আগে খুন হয়েছেন এক নেতাও। নিজের নিজের এলাকায় ব্যক্তি আধিপত্য আর আয় বজায় রাখতে দ্বন্দ্ব। বহু জায়গাতেই বোমা আর বারুদ মজুতের অভিযোগ রয়েছে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে পিছু হটা দুর্বল অংশ বিজেপির হাত ধরেছে। বিজেপির হাত ধরেছে মামলা মোকদ্দমায় জেরবার, বয়কট কিংবা ঘর ছাড়া হয়ে থাকা সিপিএমের এক শ্রেনীর সমর্থকও। অভিযোগ গোষ্ঠি দ্বন্দ্বের আবহ এতটাই শক্তিশালী যে নিজের সুরক্ষায় বন্দুক কিনতে চেয়ে প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছেন তৃণমূলের প্রাক্তন ব্লক সভাপতি। যদিও তাঁর বক্তব্য দুস্কৃতি হামলার ভয়ে। যদিও মানুষের মোহ ভেঙেছে বিজেপিতেও। ফিকে হচ্ছে গেরুয়া রঙ।
এই প্রেক্ষাপটে জামসেদ আলি ভবনের মধ্যে দাঁড়িয়েই জামসেদ আলির স্মরণ কিছুটা হলেও দ্যোতনা বহন করে বৈকি। ইতিমধ্যেই
কেশপুরের গ্রামীন পার্টি অফিসগুলি খুলতে শুরু করেছে আর পাল্টা কেশপুরেরই আনন্দপুর তৃনমূল পার্টি অফিসে তালা লাগিয়ে দিতে দেখা গেছে। কিছুদিন আগেই প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় কাটমানি নেওয়ার অভিযোগে একদল মানুষ তালা লাগিয়ে দেয় আনন্দপুর পার্টি অফিসে। তৃণমূলের পার্টি অফিসে এই তালা লাগানো আর অন্যদিকে জামসেদ আলি ভবন খুলে জামসেদ আলিকে স্মরণ কোনও ইঙ্গিত কিনা সেটা আগামী দিনই বলবে তবে লড়াই শুরুটা যে সিপিএম করেই ফেলল তা বলাই যায়।
এই স্মরণ সভায় উপস্থিত ছিলেন, পার্টির জেলা সম্পাদক তরুন রায় , রাজ্য জমিটির নেতা তাপস সিনহা, প্রাক্তন বিধায়ক রামেশ্বর দোলুই, মানিক সেনগুপ্ত। উপস্থিত ছিলেন জেলা নেতৃত্ব মেঘনাদ ভূঁইয়া, সৌগত পন্ডা। ছিলেন কেশপুর পার্টির নেতা আহমেদ আলি।