জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল চিন্ময় দাশ নারায়ণ মন্দির (বেঙদা নারায়নগড়)
মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণ দিক ঘেঁষে, বেলদা শহরের অবস্থান। একটি প্রাচীন দেউল বা মন্দির ছিল ঐ এলাকায়।তা থেকেই গ্রামটির নাম হয়েছিল দেউলী। অতীতকালে বাইরের এক জমিদারের হাত ধরে, সেই দেউলী গ্রামের উপর গজিয়ে উঠতে শুরু করেছিল এই বেলদা গঞ্জটি। দেউলীতে কোন জমিদার ছিল না। ছিল না কোন মন্দিরও। জমিদার আর মন্দির ছিল দেউলী বা আজকের বেলদা থেকে সামান্য উত্তরে, গড়কৃষ্ণপুর গ্রামে। জেলার ইতিহাস বইতেও পাওয়া যায় এই গড়, তার জমিদার আর মন্দিরের কথা।
গড়কৃষ্ণপুর গ্রামের লাগোয়া পশ্চিমে, আর এক গ্রাম– বেঙদা। ছোট মাপের একজন জমিদার ছিলেন এই গ্রামেও। জমিদারী ছোট মাপের হলেও, জাতিতে ব্রাহ্মণ নন্দ পদবীর জমিদারবংশটি ছিল অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ। সে সময় সারা জেলা জুড়ে বৈষ্ণবধর্মের প্রবল স্রোত বহমান। বসতবাড়ির সাথেই একটি বিষ্ণু মন্দির গড়েছিলেন নন্দরাও।
নন্দবংশের শেষ পুরুষ অনাদি নন্দন ছিলেন অপুত্রক। তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর দৌহিত্র সুকুমার মিশ্র এসে সম্পত্তি এবং মন্দিরের অধিকারী হয়েছিলেন। তাঁর উত্তরাধিকারীগণই বর্তমানে এই মন্দির এবং দেবতার ধারক ও বাহক।
নারায়ণের প্রতিভূ হিসাবে একটি শালগ্রাম শিলা মন্দিরের মুখ্য দেবতা হিসাবে পূজিত হন। এছাড়াও, ভগবতী দূর্গা, মহাদেব শিব, লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর ধাতুমূর্তিও পূজিত হয় এখানে। এছাড়া, লৌকিক দেবী মনসার একটি বিগ্রহও আছে সিংহাসনে।
মন্দিরের অধিকারীগণ ব্রাহ্মণ, নিজেরাই দেবতার সেবাপূজা করে থাকেন। জমিদারী উচ্ছেদ আইন চালু হবার পর থেকে, বাংলার সমস্ত মন্দিরেই দেবতার সেবাপূজায় বিঘ্নের সৃষ্টি হয়েছিল। বর্তমানে সেটি চরম সংকটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।অন্য সমস্ত মন্দিরের মত, এই মন্দিরও সেই একই সঙ্কটের আবর্তে নিমজ্জিত।
দেবতার জন্য পূর্বকালে পঞ্চ-ব্যঞ্জনের অন্নভোগ প্রচলিত ছিল। কিন্তু এখন আর নাই। এখন কেবল ফুল-তুলসী-বাতাসার নৈবেদ্য দিয়ে দু’বেলা পূজা সারা হয়। অক্ষয় তৃতীয়া, চন্দনযাত্রা, জন্মাষ্টমী, রাধাষ্টমী, রথযাত্রা, ঝুলন, দোল, চাঁচর– সবই আজও অনুষ্ঠিত হয়। তবে এখন পূজাগুলি আড়ম্বরহীন, কেবল নিয়মরক্ষা করে পালন করে যেতে হয় তিথিগুলি।
চতুস্কোণ খোপকাটা উঁচু পাদপীঠ। তার উপর ইটের তৈরী, পূর্বমুখী শিখর-রীতির মন্দিরটি অবস্থিত। একটি প্রদক্ষিণ-পথ মন্দিরকে ঘিরে আছে।
সামনে চালা-রীতির জগমোহন আর পিছনে শিখর-রীতির বিমান নিয়ে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে। জগমোহন আর বিমান– দুটিতেই একটি করে দ্বারপথ। গর্ভগৃহের সিলিং হয়েছে খিলানের মাথায় গম্বুজ রচনা করে। আর, অলিন্দে টানা-খিলানের সিলিং।জগমোহনটির পিছনের দেওয়াল গর্ভগৃহের সাথে লেপ্টানো।
বিমান সৌধের চার দেওয়ালে কলিঙ্গ প্ৰভাবে নব-রথ বিন্যাস করা হয়েছে। শীর্ষক অংশ আমলক, কলস, চক্র দিয়ে সাজানো। জগমোহনের শীর্ষকটিও অনুরূপ গড়নের।
জগমোহনের সামনের দেওয়ালটির উপর চোখ পড়লে, বেশ লাগে। যেন জগমোহনের দেওয়ালে, আর একটি ‘প্রতিকৃতি জগমোহন’ স্থাপিত হয়েছে। দ্বারপথটিতে দুই স্তরের খিলান। কার্ণিশের নীচে, দুই কোনাচ অংশের গায়ে দুটি সারিতে ছোট ছোট খোপ কাটা। কিন্তু অলংকরণের কোনও নিদর্শন নাই– খোপগুলি শূন্য। মূর্তি-ফলকে সাজানো হলে, রূপবান হয়ে উঠতে পারত মন্দিরটি।
কেবল বিমান সৌধে, বড় আকারের খোপের ভিতর, দু’-তিনটি বড় মূর্তি ছাড়া, অলংকরণের অন্য কোনও নিদর্শন নাই মন্দিরে।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী প্রদীপ মিশ্র, ত্রিদীপ মিশ্র– বেঙদা। গোবিন্দ মিশ্র– কান্তাবনি।
পথ-নির্দেশ : মেদিনীপুর বা খড়গপুর থেকে বেলদামুখী পথে শ্যামপুরা। সেখান থেকে পশ্চিমে ২ কিমি দূরে, গড়কৃষ্ণপুর জমিদারবাড়ি ছাড়িয়ে, বেঙদা গ্রাম। দ. পূ. রেলপথের বেলদা ষ্টেশন থেকেও শ্যামপুরা সামান্য দূরত্বে।