জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল চিন্ময় দাশ রাধাবল্লভ মন্দির, বারাঙ্গা (রামনগর, মেদিনীপুর)
শ’-দুই বছর আগের কথা। ইংরেজ শাসনের প্রথম পর্ব তখন। ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা’ কার্যকরী হয়েছে বড়লাট কর্নওয়ালিশ-এর ব্যবস্থাপনায়। বড় জমিদাররা কিছু সম্পত্তি দিয়ে, ছোট ছোট জমিদার নিয়োগ করতে পারতেন। ইজারাদার, পত্তনীদার, দর-পত্তনীদার ইত্যাদি নাম ছিল তাঁদের। মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণ এলাকার একেবারে শেষ প্রান্ত। যেখানে দু’পা হাঁটলেই ওডিশার বালেশ্বর জেলা। সেখানে ছোট মাপের এক গ্রাম– ‘বারাঙ্গা”। পরগনা– বীরকুল। ব্রিটিশ শাসনের প্রথম পর্বে কলকাতায় হাঁসফাঁস করতেন ইংরেজ অফিসাররা। এই বীরকুলেই একটি স্বাস্থ্যনিবাস গড়ে তোলার ভাবনা এসেছিল তাঁদের মাথায়। বড়লাট হেস্টিংস তো উঠেপড়ে লেগেছিলেন সেই কাজে। কাজটা করে উঠতে পারেননি হেস্টিংস। আর, সেই বীরকুল গ্রামেরও কোনও অস্তিত্বই নাই আর। বর্তমান দিঘার কিছু দক্ষিণে ছিল সেই গ্রাম। সমুদ্রের তলায় কবেই তলিয়ে গিয়েছে। কেবল বীরকুল নামটা টিকে আছে সরকারের “পরগণা” হিসাবে, জরীপ বিভাগের খাতাপত্রে। সারা দিনমান লোনা বাতাসের ঝাপ্টা এসে লাগে সেই গ্রামে। এক পত্তনীদার জমিদারের বাস ছিল এই বারাঙ্গা গ্রামে।
বীরকুল এলাকার অতীত কথা জানা যায়, ১৭৮৭ সালের জুন মাসে লেখা, মেদিনীপুর জেলার এক ইংরেজ কালেক্টার (মি. হিউয়েট)-এর বিবরণে। জানা যায়, পূর্বে বীরকুল এলাকা ছিল ময়ূরভঞ্জের রাজার শাসনাধীন। ইং ১৫০০ সাল নাগাদ রাজার সনন্দ নিয়ে, জনৈক সাগর রায়, বীরকুল পরগনার জমিদার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তিনিই ছিলেন এখানে জমিদারি এবং রায়বংশের প্রতিষ্ঠাতা। … গ্রামে তাঁর নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত পাথরের তৈরি সাগরেশ্বর শিবমন্দিরটি এখনো দেখা যায়।
পরবর্তী কালে তাঁর বংশধরদের হাতে জমিদারি পরিচালনায় গুরুতর ঘাটতি শুরু হয়। তার ফলশ্রুতিতে, জমিদারি নিলাম, বিক্রয়, টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া ইত্যাদি নানারকম বিপত্তি ঘটেছিল। বাংলার নবাব মুর্শিদ কুলী খান (১৭২০-২৭) এবং সুজাউদ্দিন মহম্মদ খান (১৭২৭-৩৯)-এর শাসনকাল তখন।
এই বিপর্যয় পর্বে, বিভিন্ন তহশীলের দায়িত্ব গ্রহণ করে, অনেক ছোটছোট জমিদারের উদ্ভব হয়েছিল। পরে তাঁদের অনেকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। বারাঙ্গা গ্রামের জমিদারি সেই তালিকার অন্যতম একটি।
বারাঙ্গার জমিদারের বাস্তু গড়া হয়েছিল গড়খাই দিয়ে ঘিরে। আলোচ্য মন্দিরটি সেই বাস্তুর ভিতর, বসতবাড়ির লাগোয়া করে নির্মিত। কিন্তু মন্দিরে কোনও প্রতিষ্ঠা লিপি নাই। বারাঙ্গার এই জমিদার পরিবারের পূর্বাপর কুলপঞ্জীও পাওয়া যায় না। মাত্র শ’দুই বছরের ইতিহাস আছে আমাদের হাতে। সেই তালিকায় প্রবীণতম পুরুষ হলেন জনৈক কেশব চন্দ্র দাস। জমিদারবংশের অভিমত– কেশব চন্দ্রই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করে থাকবেন।
কেশব-এর দুই পুত্র– কাঞ্জিরাম এবং আন্দিরাম। এই দুই পুরুষের বংশধর এবং দৌহিত্রগন বর্তমানে ৮/১০ পুরুষে পৌঁছেছেন। তাঁরাই দেবতার সেবাপূজার ধারাটিকে বহাল রেখে চলেছেন।
বহু দিন হোল, দেবতার নামিত সম্পত্তির সবই বেহাত। সুখের কথা, তাতে সেবাপূজার কোনও অঙ্গহানি হতে দেয়নি এই সেবাইত বংশ। বর্তমানেও নিত্য তিনবার পূজা– সকাল সন্ধ্যায় ফল-মূল-মিষ্টান্নের নৈবেদ্য। দুপুরের পূজায় অন্তত পঞ্চ -ব্যঞ্জন সহ আতপচালের নিরামিষ অন্নভোগ। এছাড়া ভক্তদের নিয়ে আসা পূজাও লেগেই থাকে মন্দিরে।
শ্রীকৃষ্ণের মন্দির। সেকারণে, বারো মাসে তেরো পার্বনের আয়োজন। সম্বৎসরে দুটি বড় অনুষ্ঠান– ৫ দিনের রাস উৎসব এবং রথযাত্রা। রাস বসে চতুর্দশীর ব্রহ্মনিশিতে। তৃতীয়ায় ‘দধি’তে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি। একটি উন্মুক্ত রাসমঞ্চ আছে উৎসবের জন্য।
রাধা-কৃষ্ণ ছাড়া, জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রাও আছেন মন্দিরে। সেকারণে, রথযাত্রার আয়োজন করা হয়। রাসমঞ্চের লাগোয়া বিশাল একটি রথ-ময়দান আছে। সেখানে উৎসবটি আয়োজিত হয়। বড় আকারের একটি মেলাও বসে রথ উপলক্ষে। ঝুলন, দোলযাত্রা, জন্মাষ্টমী আর রাধাষ্টমীতেও বিশেষ ঘটা দেখা যায় এখানে।
রাধাবল্লভের পূর্বমুখী এই মন্দির দালান-রীতির, ইটের তৈরি। ভারতবর্ষে দালান-রীতির প্রাচীনতম মন্দিরটি আছে মধ্যপ্রদেশের সাঁচি-স্তুপের পাশেই। এছাড়া আছে, বুন্দেলখণ্ডের নাচনাকুঠার গ্রামের পার্বতী মন্দির কিংবা নগোধ স্টেটের ভুমরা গ্রামের শিব মন্দির। এগুলি নির্মিত হয়েছিল গুপ্তযুগে।
এইসকল সমতল ছাদ, বাঁকানো কার্ণিশ-বর্জিত দেবালয়ের নির্মাণ প্রকরণ ইত্যাদি উন্নত কারিগরীরই বিষয়। বোধকরি, দালান মন্দিরের এই সহজ নিরাভরণ রূপের জন্যই, কোন কোনও পুরাবিদ এগুলিকে “আর্য ও আর্যেতর ধর্মচিন্তার মিশ্রণের ফলশ্রুতি” বলে উল্লেখ করেছেন। অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, গাছতলায় বা মাটির বেদিতে লৌকিক দেবদেবীদের কৌলীন্যলাভের ফলে, পৌরাণিক দেবদেবীদেরও কিছুটা লৌকিকতার দিকে ঝুঁকতে হয়েছিল। সেসময় ‘সাধারণ দালান-মন্দিরে’ও তাঁদের আরাধনা হয়েছে।
সেসব কথা থাক। এখানে বারাঙ্গা গ্রামে এই রাধাবল্লভ মন্দিরের গড়নটি বেশ রাজকীয়। পাদপীঠের উচ্চতা এখনও ৪ ফুটের বেশি। গর্ভগৃহটিও বেশ উঁচু করে নির্মিত– দৈর্ঘ্য .. ফুট, প্রস্থ .. ফুট.. এবং উচ্চতা .. ফুট। বর্তমানে গর্ভগৃহের সামনে কোনও অলিন্দ নাই। তবে, সেবাইত পরিবার থেকে জানা যায়, অতীতে সামনে একটি অলিন্দ, করিন্থিয়াম-রীতির গোলাকার স্তম্ভ, মন্দিরকে ঘিরে প্রশস্ত প্রদক্ষিণ-পথ ইত্যাদি রচিত ছিল।
পূর্বমুখী মন্দির হলেও, মন্দিরে উঠবার সিঁড়িটি রচিত হয়েছে উত্তর দিকে। পূর্বদিকে মুখ্য দ্বারপথটি ছাড়া, উত্তর দিকেও একটি দ্বারপথ আছে।
মন্দির অলংকরণের কাজে টেরাকোটা-ফলকেরও কিছু ব্যবহার করা হয়েছে। সামনের দেওয়ালে সরলরৈখিক কার্নিশের নিচ বরাবর একটি সারি, এবং দু’দিকের কোনাচের গায়ে দুটি খাড়া সারিতে, ছোট-ছোট খোপে কিছু ফলক যুক্ত হয়েছে।
মন্দিরের কয়েকটি বৈশিষ্ট উল্লেখ করবার মতো– ১. পূর্ব এবং উত্তরে দুটি দ্বারপথেরই লাগোয়া দু’পাশে, দুটি করে ‘প্রতিকৃতি দ্বারপথ’ রচিত আছে।
২. দুটি করে ‘প্রতিকৃতি দ্বারপথ’ রচিত আছে পশ্চিম এবং দক্ষিণের দেওয়ালেও।
৩. মন্দির অলংকরণের একটি স্বাভাবিক রীতি হল দ্বারপথের দু’দিকে দুটি দ্বারপাল কিংবা দ্বারপালিকা মূর্তি রচনা করা। কোনও মন্দিরে আবার এগুলির বদলে, বাদক-বাদিকা মূর্তি দেখা যায়। এই মন্দিরে প্রত্যেকটি দ্বারপথ এবং ‘প্রতিকৃতি দ্বারপথ’-এর দু’দিকে দুটি করে মূর্তি রচিত হয়েছে।
৪. মূর্তিগুলির ভিতর দ্বারপাল, বাদিকা, নর্তকী সকলেরই সমাবেশ দেখা যায়।
৫. বিশেষ বৈশিষ্ট মূর্তিগুলির দৈহিক গঠন এবং অঙ্গের পোশাক পরিচ্ছদের বৈচিত্রে। কয়েকটি ছবি দেওয়া হল। পাঠক-পাঠিকা নিজেরাই প্রত্যক্ষ করতে পারবেন।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী ক্ষুদিরাম দাস, ঘনশ্যাম দাস, হরিহর দাস, বঙ্কিম দাস, বিনোদ বিহারী দাস– বারাঙ্গা।
পথ-নির্দেশ : মেদিনীপুর থেকে পানিপারুল হয়ে দিঘা গামী পথের উপর দেপাল। সেখান থেকে সামান্য ১ কিমি দূরে বারাঙ্গা গ্রাম। এছাড়া, কলকাতা বা মেচেদার দিক থেকে দিঘা গামী পথের রামনগর থেকেও দেপাল (৮ কিমি) আসা যাবে।