Homeএখন খবরজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-১০৭ ।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-১০৭ ।। চিন্ময় দাশ

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ১০৭                                                                   চিন্ময় দাশদামোদরমন্দির, হোগলা (থানা– তমলুক মেদিনীপুর)
হোগলা– এই গ্রামেই জন্মেছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা।ইতিহাসে যিনি ‘গান্ধী বুড়ি’ নামেই পরিচিত। রূপনারায়ণ নদের পশ্চিম তীরে তাঁর জন্মভিটা পরিক্রমায় গিয়ে, সন্ধান পাওয়া গেল আকাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সুবিশাল এক শিখর দেউল মন্দিরের।
রূপনারায়ণের পশ্চিম তীর জুড়ে এক সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল বহু প্রাচীন কাল থেকেই। বর্তমান তমলুকের একদিকে নাটশাল, অন্য দিকে রঘুনাথবাড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা। সেই এলাকায় মৃত্তিকা গর্ভ থেকে যেসকল পূরাবস্তু আবিষ্কার হয়েছে, সেগুলি কুষাণ, গুপ্ত, পাল এবং মধ্যযুগের বলে বিশেষজ্ঞদের অনুমান।

এদিকে, একেবারে আধুনিক কালে, এদেশে ইংরেজ আসবার পূর্ব থেকেই, এইসকল এলাকায় রূপনারায়ণের জলপথে ব্যবসা-বাণিজ্যের ধারা প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন কৃষিজ সম্পদ, লবণ, মাদুর, কার্পাসবস্ত্র ইত্যাদি তো ছিলই। তার সাথে যুক্ত হয়েছিল তুঁত, নীল আর রেশম-এর ব্যবসাও। ফলে, এলাকার অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়েছিল। ধনবান হয়ে উঠেছিল বহু পরিবার।পরে, ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা’র সুবাদে, ছোট-বড় মাপের জমিদারিও প্রতিষ্ঠা করেছিল কিছু পরিবার।
তেমনই একটি জমিদার পরিবারের বসবাস আছে হোগলা গ্রামে। বর্তমান বংশধরগণ বলেন, তাঁদের পূর্বপুরুষ জনৈক সন্তোষ কর মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। তবে, মন্দিরে যুক্ত একটি লিপি-ফলকে জনৈক নিমাই চরণ কর-এর নামের উল্লেখ আছে।

‘দামোদর’ নামিত একটি শালগ্রাম শিলা মন্দিরে পূজিত হন। পুরোহিত, মালাকার, কুমোর, দাসী প্রমুখ কর্মীবাহিনীকে ‘জায়গীর সম্পত্তি’ দিয়ে সেবাপূজার কাজে যুক্ত করা হয়েছিল। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর, ৮-৯ পুরুষ অতিক্রান্ত হয়েছে। বর্তমানে বংশের সবগুলি পরিবারই দেবতার পূজার্চনার শরিক হিসাবে বহাল আছেন। নিত্যপূজা ছাড়াও, বারো মাসে তেরো পার্বণের ধারাটিকেও টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
শিখর-রীতির মন্দির। তবে সামনের নাটমন্দির এবং ভোগমন্ডপ অংশটি অনুপস্থিত। জগমোহন, অতি সংক্ষিপ্ত একটি অন্তরাল এবং বিমান বা মূলমন্দির– এই তিনটি অংশ নিয়ে মন্দিরটি নির্মিত।
জগমোহন চার-চালা রীতির। এটির পরিমাপ– দৈর্ঘ্য ১৪ ফুট ৯ ইঞ্চি, প্রস্থ ১৩ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট। বিমান সৌধটি সু-উচ্চতা সম্পন্ন, ৬৬ ফুট। পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় এত উচ্চতার আর কোনও মন্দির নাই। সম্পূর্ণ বর্গাকার সৌধ– দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ২১ ফুট হিসাবে। বিমান এবং জগমোহন দুই সৌধের মাঝে অন্তরাল অংশটি অতি সংক্ষিপ্ত– দৈর্ঘ্য পৌনে ২ফুট, প্রস্থ ১০ফুট এবং উচ্চতা ৮ ফুট।
জগমোহন-এ চারদিকে খিলান-রীতির চারটি দ্বারপথ। তবে, পরবর্তীকালে পশ্চিমের দ্বারটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর ভিতরের ছাদ বা সিলিং নির্মিত হয়েছে চার দেওয়ালে চারটি বড় আকারের চাপা-খিলান নির্মাণের পর, মাথায় গম্বুজ স্থাপন করে। আর, বাইরে চালা-রীতির গড়ানো ছাউনি দেওয়া।
অন্তরাল-এর সিলিং হয়েছে চার দেওয়ালে চারটি অর্ধ-খিলানের সাহায্যে। বাইরে, মাথায় সমতল ছাউনি।
বিমান সৌধটি শিখর-দেউল রীতিতে নির্মিত। বাইরের চার দিকের দেওয়ালে পঞ্চাঙ্গ বাঢ় এবং গন্ডি অংশ জুড়ে, সপ্ত-রথ বিভাজন করা। বরন্ড অংশটি প্রকট নয়। ভিতরে গর্ভগৃহের সিলিং হয়েছে ছোট আকারের আটটি খিলানের মাথায় গম্বুজ স্থাপন করে। শীর্ষক অংশে ক্রমান্বয়ে বেঁকি, বড় আকারের আমলক, কলস এবং বিষ্ণুচক্র স্থাপিত।
পাদপীঠ অংশের গড়নটিও বেশ রাজকীয়। চতুর্দিকে বর্গাকার খোপ-কাটা। সওয়া দু’শ বছর পরেও, আড়াই ফুট মতো উচ্চতা বজায় আছে। পাদপীঠের উপর, তিন ফুট প্রশস্ত একটি প্রদক্ষিণ-পথ রাখা হয়েছে।

চুন-সুরকির উপাদানে নির্মিত দক্ষিণ-মুখী মন্দির। তবে, মন্দিরের আরোহনের সিঁড়িটি পশ্চিমে রচিত।
কোনও টেরাকোটা ফলক বা পঙ্খের কোনও অলংকরণ মন্দিরে নাই। আছে কয়েকটি জ্যামিতিক নকশা বা ‘যন্ত্র’– পশ্চিম দেওয়ালের বাঢ় অংশে।
অতি জীর্ণ একটি লিপি-ফলক আছে, বর্তমানে পাঠের অযোগ্য। প্রয়াত পুরাবিদ তারাপদ সাঁতরা, তাঁর ‘পুরাকীর্তি সমীক্ষা : মেদিনীপুর’, ১৯৮৭ গ্রন্থে যার পাঠ উদ্ধার করেছিলেন– “শ্রীশ্রী সম্বোধমেসু। শ্রীনিমাই / চরণ করস্য পঞ্চ সহোদর পা / দপদ্বো-বত্রিত সকাব্দ ১৭২০ / সন ১২০৫ সাল তারিখ ৫ অঘ্রাণ “। (বানান ও যতিচিহ্ন অপরিবর্তিত) অর্থাৎ, অঙ্কের হিসাবে ইং ১৭৯৮ সালে মন্দিরটি স্থাপিত হয়েছিল।
জমিদার বংশের ৩ জন উত্তর-পুরুষের নামাঙ্কিত একটি ‘সংস্কার-লিপি’ও আছে এই মন্দিরে– ” ওঁ শ্রী ক্ষুদিরাম কর, মনিমোহন কর, জ্ঞানদা চরণ কর “।
জীর্ণতার ছাপ পড়তে শুরু করেছে মন্দিরে। অবিলম্বে পদক্ষেপ না করলে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিশালাকার এই সৌধটি।
চালা-রীতির মন্দির বহু সংখ্যায় আছে মেদিনীপুর জেলায়। তবে ‘চার-চালা মন্দির’ সংখ্যায় নেহাতই কম। গ্রামে ঢুকে, চলার পথেই দেখতে পেয়েছিলাম ‘চার-চালা’ রীতির জীর্ণ পরিত্যক্ত একটি দেবালয়। তার ছবিটিও দেওয়া হল।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী সুদেব চন্দ্র কর, গোবিন্দ কর, যুধিষ্ঠির কর– হোগলা। বলদেব চক্রবর্তী (পুরোহিত)– ডুমরা।
পথ-নির্দেশ : হোগলা গ্রামের ভৌমিক অবস্থান ২২.৩৬৬ উত্তর অক্ষাংশ, ৮৭.৯০৫ পূর্ব-দ্রাঘিমা। তমলুক জেলা শহর এবং দ.পূ. রেলপথের হাওড়া-খড়গপুর সেকশনের মেচেদা স্টেশনের সংযোগকারী রাস্তায় কাকটিয়া বাজার। সেখান থেকে পূর্ব মুখে, দেড়-দু’ কিমি দূরত্বে হোগলা গ্রাম। নিয়মিত টোটো চলাচল করে এই পথে।

RELATED ARTICLES

Most Popular