জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৮৪ চিন্ময় দাশ
যোগী দেউল, দেউলী (বেলদা)প্রতিষ্ঠা-লিপি নাই যে মন্দিরে, তার আয়ুষ্কাল নির্নয় হয় স্থাপত্যশৈলী বিচার পদ্ধতিতে। মেদিনীপুর জেলার এমন তিনটি মন্দিরের কথা আমরা জানি, যেগুলিকে এভাবে ছাড়া বিচারের অন্য বিকল্প নাই– ১. খড়গপুর থানার জিনশহর গ্রামের জৈন মন্দির। ২. বিনপুর থানার ডাইনটিকরী গ্রামের আর একটি জৈন মন্দির (বর্তমানে ‘রংকিনী মন্দির’ নামে পরিচিত )। ৩. তৃতীয়টি রয়েছে বেলদা থানার দেউলী গ্রামে। সেই মন্দিরটি নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা।
সভ্যতার বিকাশ হয়েছে নদীপথ ধরে, যেমন সিন্ধু সভ্যতা। প্রাচীন জৈন ধর্মগ্রন্থ ‘আচারাঙ্গ সূত্ত’ থেকে জানা যায়, মহাবীর এবং তাঁর শিষ্যগণ রাঢ়দেশ পরিভ্রমণ করেছিলেন। জৈনদের পরেপরেই আসেন বৌদ্ধরা। পরেশনাথ বা পার্শ্বনাথ পাহাড়ের সমেত শিখর থেকে চারটি নদী উৎপন্ন– দামোদর, দ্বারকেশ্বর, শিলাবতী এবং কংসাবতী। রাঢ় বাংলায় জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশ হয়েছিল এই চারটি নদীপথেই। পুরুলিয়া জেলায় দামোদরের তীরে তেলকুপি; বাঁকুড়া জেলায় দ্বারকেশ্বরের তীরে সোনাতপল ও বহুলাড়া, কংসাবতীর তীরে অম্বিকানগর; মেদিনীপুর জেলায় কংসাবতীর তীরে ডাইনটিকরী ও জিনশহরের প্রাচীন মন্দিরগুলি তারই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।দেউলী গ্রামের অবস্থান ঠিক কোনও নদীর তীরে না হলেও, যোগী দেউল নামে সেই গ্রামের মন্দিরটির গড়ন, তার উপাদান হুবহু পূর্বোক্ত অন্যান্য মন্দিরগুলির মতই। ( তুলনার জন্য, এই নিবন্ধে শ্রদ্ধেয় অমিয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থ থেকে বাঁকুড়ার অম্বিকানগর এবং শ্রদ্ধেয় তারাপদ সাঁতরার গ্রন্থ থেকে মেদিনীপুরের জিনশহর দুটি গ্রামের দুটি জৈন মন্দিরের ছবি একেবারে শেষে দেওয়া হোল। )
দেউলী গ্রামের এই মন্দির কোন সময়কালে কিংবা কার হাতে গড়া, জানা যায় না। জানা যায় না, কোন বিগ্রহ পূজিত হতেন এখানে, সেকথাটিও। গ্রামের নামকরণের বহু উৎস বা উপাদান থাকে। প্রাচীন মন্দির থাকবার কারণে, জনপদটি ‘দেউলী’ নামে পরিচিত হয়েছে। শত শত বছর পরিত্যক্ত থাকবার পর, কিছুকাল এক সন্ন্যাসী এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন এখানে। সন্ন্যাসীর প্রয়ানের পর, আবার মন্দিরটি পরিত্যক্ত, শূন্য।
মন্দিরটি যে প্রাচীন, তার একটি সূত্র আমরা দিতে পারি। যোগী দেউল-এর অদূরেই রয়েছে চম্পকেশ্বর শিবের মন্দির। তার প্রাঙ্গণে এখনও ইতস্তত ছড়ানো কিছু প্রত্নবস্তু দেখা যায়– কষ্টিপাথরের একটি নন্দীমূর্তি, একটি বিষ্ণুমূর্তির মস্তক অংশ, ২টি ভিন্ন ভিন্ন মূর্তির নিম্নাংশ ইত্যাদি। বিষ্ণুমূর্তিটি বিচার করে, সম্ভবত ১২-১৩ শতকে নর্মিত বলে অনুমান করেছেন স্থাপত্যবিদরা। অর্থাৎ, অতীতে দেউলী গ্রামে এই এলাকাটিতে সমৃদ্ধ কোনও দেবালয় ছিল– আমরাও এমন অনুমান করতে পারি।
মন্দির এবং গ্রামের নামকরণ সম্বন্ধে কেউ বলেন, নন্দী-মূর্তি প্রমাণ দেয় যে, শিবের মন্দির ছিল এখানে। সেসময় শিব উপাসক নাথ সম্প্রদায়ভুক্ত যুগীদেরও নিশ্চয় উপস্থিতি ছিল এই এলাকায়। তাঁদের কারণেই মন্দিরটি ‘যোগী দেউলী ‘ নামে পরিচিত হয়েছিল। তা থেকেই গ্রামের নাম হয়েছে দেউলী।আবার যাঁরা বেশি পিছনে তাকাতে চান না, তাঁরা বলেন– মন্দিরে সন্ন্যাসী বা যোগীর অবস্থান থেকেই ‘যোগী দেউলী ‘ নামের উৎপত্তি। গ্রামের দেউলী নাম গড়ে উঠেছে সেকারণেই।
নাম নিয়ে নানা কথা হোল, এবার মন্দির নিয়ে দু’চার কথা হোক বরং। নিম্ন বাংলায়, বিশেষত মেদিনীপুর জেলায়, প্রধানত ৪টি শৈলীর মন্দির দেখা যায়– দালান, শিখর, রত্ন এবং চালা। এছাড়া, পীঢ়া রীতির দুটি একটি মন্দিরও দেখা যায় এই জেলায়। শিখর মন্দির নির্মাতাদের হাতেই এই রীতির উদ্ভব– এমন অনুমান করেন অনেকে।
গুপ্তযুগে মন্দির নির্মাণের ধারায় যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছিল, তা থেকেই নাগর এবং দ্রাবিড় রীতির উদ্ভব। নাগর রীতি পূর্ব ভারত হয়ে কলিঙ্গ প্রদেশে পৌঁছে, বিবর্তিত হতে হতে শিখর-রীতির সৃষ্টি। এদিকে খিচিং অঞ্চলের শিখর মন্দিরের স্থপতিরাই পীঢ়া রীতির জন্ম দিয়েছেন, এমনটা বলা হয়।
কলিঙ্গ এবং বাংলা কেবল প্রতিবেশী রাজ্য, তাই নয়। রাজা শশাঙ্কের আমল থেকে সমগ্র দণ্ডভুক্তি এলাকা (বর্তমান আলোচ্য বেলদা অঞ্চলও যার অন্তর্ভুক্ত) জুড়ে যে ধর্মীয় পরিমন্ডল গড়ে উঠেছিল এবং দেবালয় নির্মিত হয়েছিল, সেকথাও আমাদের মনে রাখতে হবে। কলিঙ্গ প্রদেশ থেকে শিখর-রীতির সাথে সাথে পীঢ়া-রীতিটিও এসেছিল বাংলায়। তবে, মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণের এলাকাতেই এই মন্দিরের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি।
পীঢ়া মন্দিরের গন্ডী বা মাথার ছাউনি অংশের গড়ন হয় হুবহু পিরামিডের মত। চালগুলির ত্রিভুজের আকার, প্রতিটি প্রান্তই সরলরেখা। চালার নিচের প্রান্ত, যেটি আসলে মন্দিরের কার্ণিশ অংশ, সেটিও ভূমির সমান্তরালে সরলরেখায় নির্মিত হয়। আমাদের বর্তমান আলোচ্য এই মন্দির সেই রীতিতেই নির্মিত হয়েছিল।
মন্দিরটির দুটি অংশ– পিছনে বিমান (মূল মন্দির) এবং সামনে জগমোহন। রীতি অনুসারে এই দুই সৌধের মাঝখানে একটি অন্তরাল থাকবার কথা। এখানে সেই অংশটি নাই। পূর্বে উল্লিখিত তিনটি নদী তীরের মন্দিরগুলির সাথে এই মন্দিরের কতকগুলি সামঞ্জস্য দেখানো যেতে পারে– ১. সবগুলি মন্দিরই পূর্বমুখী। ২. মাকড়া পাথর বা ল্যাটেরাইটের ছোট-বড় বিভিন্ন মাপের বর্গাকার এবং আয়তাকার স্ল্যাব দিয়ে গাঁথা। ৩. সবগুলিই পীঢ়া রীতিতে নির্মিত। ৪,. কোনওটিতেই প্রতিষ্ঠালিপি নাই। ৫. এটিও পরিত্যক্ত মন্দির, বিগ্রহ নাই। ৬. এই মন্দির এলাকায়ও প্রাচীন প্রত্নবস্তুর নিদর্শন আছে। ৭. একেবারে তীরে না হলেও, এই মন্দিরও কংসাবতীর উপনদী কেলেঘাই-এর অদূরবর্তী। ৮. এই মন্দিরের দুটি চতুস্কোন দ্বারপথই সরলরৈখিক পাথরের স্ল্যাব ব্যবহার করে নির্মিত। (ইসলামী ‘গম্বুজ’ নির্মাণের কারিগরী তখনও আমাদের স্থপতিরা জানতেন না। সেকারণে, খিলান এখানে অনুপস্থিত।)। ৯. বিমান এবং জগমোহন দুই সৌধেরই ভিতরের ছাদ বা সিলিং গড়া হয়েছে ধাপে ধাপে খাঁজ কাটা লহরা বা করবেলিং রীতিতে। গম্বুজ রীতিতে নয়।
মন্দিরটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, বিষধর সরীসৃপকুলের নিশ্চিন্ত বাসভূমি। সুখের কথা, বিমান এবং জগমোহনের গন্ডীর বাইরের অংশ বিধ্বস্ত হলেও, শীর্ষক বা চূড়াগুলি বেশ প্রত্যক্ষ করা যায়। সেখানে বেঁকি, খাঁজ-কাটা আমলক, কলস ইত্যাদি স্থাপিত আছে, প্রত্যক্ষ হয়।
সাক্ষাৎকার : প্রয়াত শিবকালী মিশ্র, প্রয়াত সুধীর প্রধান। সর্বশ্রী তারকনাথ দে, তমোনাশ দে, গোপাল বসু, অতুল দত্ত, অমল সাহু, জন্মেঞ্জয় সাহু– বেলদা। প্রয়াত অধ্যাপক পিনাকী নন্দন চৌধুরী– শান্তিনিকেতন।
সমীক্ষা-সঙ্গী: শ্রীমতি মৌসুমী সামন্ত (ভট্টাচার্য্য)– স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্মী– বেলদা ।
যাওয়া-আসা : মেদিনীপুর বা খড়গপুর থেকে ট্রেন বা বাসযোগে বালেশ্বরমুখী পথে বেলদা। সেখানে বাজার থেকে সামান্য পশ্চিমে, গ্রামের ভিতর জীর্ণ মন্দিরটি অবস্থিত।