জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৯১
চিন্ময় দাশ লক্ষ্মীজনার্দন মন্দির, চক কুমার (থানা– ডেবরা। মেদিনীপুর)
আজকের জার্নালে যে মন্দিরের কথা, সেই মন্দির আর তার দেবতার আবির্ভাব একেবারে কিংবদন্তির মত। বিগত ১০/১১ পুরুষ ধরে মন্দিরের সেবাইত বংশ সযত্নে লালন পালন করে আসছেন কিংবদন্তির মত কাহিনীটিকে। প্রথমে সেটি জেনে নেওয়া যাক।
সেকালের সাহাপুর পরগণায় (বর্তমান ডেবরা থানা) বেশ বড়সড় মাপের জমিদারী ছিল জনৈক সুদাম চরণ দাস বেরার। বিশাল অট্টালিকা। হাতিশালে হাতি। অট্টালিকার পুরো একটা মহল নিয়ে কাছারীর সেরেস্তা। দাস-দাসী, লোক-লস্করে গমগম করত জমিদারবাড়ি।
জমিদারবাড়ির সারা বছরের ডালশস্যের যোগান আসত ঝাড়গ্রামের জঙ্গল মহল এলাকা থেকে। বস্তা বস্তা ডাল আসত হাতির পিঠে ছালায় ভরে। ঢেঁকিশাল ছিল বিরাট আকারের। সেখানে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে ডালের খোসা ছাড়াতো কুটুনি মেয়েরা।
শ’ আড়াই বছরের কিছু আগে-পরের কথা। একবার তেমনই ডাল ভাঙানোর কাজ চলছে। রাতে জমিদার সুদাম চরণ স্বপ্নাদেশ পেলেন– ” কলাইর বস্তাতে ভগবান বিষ্ণুর শালগ্রাম শিলা ছিল। মেয়েরা কালো পাথর ভেবে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে খোসার গাদায়। তুলে এনে যেন প্রতিষ্ঠা করা হয়।”
আনন্দ যেন ধরে না জমিদারের ! দেবতা স্বয়ং দোরগোড়ায় এসে উপস্থিত হয়েছেন ! এত সৌভাগ্য ক’জনের হয় !
শিলা খুঁজে পেতে দেরি হোল না। ভক্তিভরে উদ্ধার করা হল সেটিকে। একটি দ্বার, চারটি বিষ্ণুচক্র এবং বনমালা চিহ্নিত আছে শিলার গায়ে। ব্রাহ্মণ পন্ডিত বিচার করে পরিচয় জানালেন– লক্ষ্মীজনার্দন শিলা।
বড় করে পঞ্চ-রত্ন মন্দির গড়া হোল প্রাসাদের লাগোয়া। সামনে কোরিন্থিয়াম-রীতির থাম দেওয়া অলিন্দ। রাসমঞ্চ গড়া হোল প্রাসাদের সামান্য পূর্বে। বিপুল আড়ম্বরে মন্দির প্রতিষ্ঠা করে, সেবাপূজার প্রচলন করা হোল দেবতার।
মন্দির কিংবা রাসমঞ্চ, প্রতিষ্ঠালিপি ছিল না কোনটিতেই। সঠিক জানা যায় না, মন্দিরটি কোন সময়ে স্থাপিত হয়েছিল। তবে, আমরা সুদাম চরণ থেকে একেবারে বর্তমান প্রজন্ম পর্যন্ত ১০ / ১১ পুরুষের বংশলতিকা সংগ্রহ করেছি সেবাইতবংশ থেকে। সেটি বিচার করে, আমাদের অনুমান, আড়াই শ’-পৌনে তিনশ’ বছর আগের ঘটনা ছিল সেটি। অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি, বা কয়েক বছর পরে, মন্দিরটি স্থাপিত হয়ে থাকতে পারে।বয়সের ভার আর কালের আঘাতে মন্দিরটি জীর্ণ হয়ে পড়েছিল। বিগত শতকের মাঝামাঝি সময়, জীর্ণ মন্দির ভেঙে নতুন একটি মন্দির গড়ে নেওয়া হয়েছে। আজ থেকে পৌনে একশ’ বছর আগের ঘটনা মাত্র। সুদাম চরণের এক বংশধর, ধনপতি দাস বেরার পুত্র, বংকুবিহারী বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। পরিচিতি এবং সন-তারিখ উল্লেখ করে দুটি মর্মর-ফলক আছে মন্দিরে।
বিষ্ণুমন্দির, সেকারণে বারো মাসে তেরো পার্বণ। ঝুলন, দোল, রাস আয়োজিত হোত আড়ম্বরের সাথে। রাস উৎসব ছিল ৫ দিনের। হাতির পিঠে জমকালো হাওদায় চেপে পরিক্রমায় বেরোতেন বিগ্রহ। রাসমঞ্চের সামনে প্রশস্ত প্রাঙ্গনে মেলা বসত সপ্তাহ জুড়ে। অম্বুবাচী, ছাতু সংক্রান্তি, বা মকর সংক্রান্তির মত লোক-উৎসবগুলিরও কদর ছিল এই জমিদারবংশে।বিশেষ ঘটা দেখা যেত মকর পরবে। পৌষের সংক্রান্তি দিনে সূচনা হোত। উৎসব চলত সারা মাঘ মাস জুড়ে। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে মকর দেওয়া হোতই। মকর পৌঁছে যেত দূরবর্তী মহালেরও প্রজাদের বাড়িতে বাড়িতে। জমিদারী উচ্ছেদ হয়ে, সেসব জাঁকজমকের দিন উবে গিয়েছে কর্পূরের মত। এখন কেবল নিয়ম পালন করে যাওয়া হয় যেন। দাস বেরা বংশে এখন ১৪ / ১৫টি পরিবার। তাঁরা সকলেই দেবতার সেবাপূজার অধিকারী। চক্রবর্তী পদবীর ব্রাহ্মণরা বংশানুক্রমে পৌরহিত্য করেন এখানে।
পূর্বের মন্দিরটির স্থাপত্য সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। রত্ন-রীতির পঞ্চ-রত্ন মন্দির ছিল, এটুকুই বলা যায় কেবল। মন্দিরের কোনও চিহ্নই নাই আর। সেটির ভিতের উপরেই বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে।
দালান, শিখর, রত্ন কিংবা চালা– কোনও রীতিতেই নির্মিত হয়নি বর্তমান মন্দিরটি। মন্দিরের সাথে একটি রাসমঞ্চও নির্মিত হয়েছিল, আমরা বলেছি। বেশ উঁচু ভিত্তিবেদী। মঞ্চটি ছয়-কোণা, সপ্ত-রত্ন বিশিষ্ট। রাসমঞ্চের দ্বারপথগুলির খিলান দরুণ-রীতির। মেদিনীপুর জেলায় সিংহভাব রাসমঞ্চ নির্মিত হয়েছে, যেগুলির রত্ন বা চুড়াগুলি বিশেষ একটি আকারে নির্মিত। স্থানীয়ভাবে এগুলি ‘বেহারী রসুন চূড়া’ নামে অভিহিত হয়েছে। প্রখ্যাত পুরাবিদ ডেভিড ম্যাককাচন সাহেব তাঁর ‘ ইউরোপিয়ান ব্যারক আর্ট’ নামক গ্রন্থে এই রীতির উল্লেখ করেছেন।
লক্ষ্মীজনার্দন-এর বর্তমান এই মন্দিরটিও হুবহু তাঁর রাসমঞ্চের আদলে নির্মিত হয়েছে। নিচে গর্ভগৃহটি আট-কোণা। মাথায় ন’টি চূড়া নিয়ে, নব-রত্ন বিশিষ্ট সৌধ। কোনও অলংকরণ নাই মন্দিরে।
প্রয়াত প্রবীন ব্যক্তিদের পারলৌকিক কাজের সময়, ‘বৃষ-কাষ্ঠ’ উৎসর্গ করবার রীতি প্রচলিত আছে মেদিনীপুর জেলায়। এই মন্দিরের সামনে তেমনই একটি বৃষ-কাষ্ঠ স্থাপিত আছে, আমরা দেখেছি। আজ এই জীর্ণ বৃষ-কাষ্ঠ, শ্যাওলা ধরা রাসমঞ্চ, বা করিন্থিয়াম রীতির থামের ভগ্নাবশেষগুলিই কেবল টিকে আছে কেবল, এক বনেদি বাড়ির প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।
সাক্ষাৎকার : শ্রী বিদ্যুৎ বরণ দাস বেরা, শ্রী ত্রিদীব দাস বেরা– চক কুমার। পথ-নির্দেশ : ৬নং জাতীয় সড়ক মুম্বাই রোডের ডেবরা বাজার স্টপেজ এবং হাওড়া-খড়গপুর রেলপথের বালিচক স্টেশন। এই দুইয়ের সংযোগকারী পথের উপরেই ডেবরা কলেজ। সেখানে নেমে, পশ্চিমে সামান্য ২ ফাৰ্লং দূরে মন্দিরটি অবস্থিত।