জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল
চিন্ময় দাশ লক্ষীজনার্দন মন্দির, পাইকপাড়ি ( ডেবরা, পশ্চিম মেদিনীপুর)
পাইকপাড়ি– শ্যামল ছায়ায় ঢাকা একটি গ্রাম। পাইকদের বসতি ছিল, তাতেই এমন নাম হয়েছিল গ্রামটির। কোন রাজার পাইক, রাজ্য বা রাজধানীটাই বা ছিল কোথায়? দু’-চার কথায়, প্রথমে সে খবর জেনে নেওয়া যাক।
বর্তমানে যে এলাকা ‘ডেবরা থানা’ নামে পরিচিত, পূর্বে তা ছিল সাহাপুর আর কুতুবপুর পরগণা। এছাড়া, কেদারকুণ্ড, কিসমত কাশীজোড়া, গাগনাপুর পরগণার কিছু অংশও আছে তার ভিতর। সে যাই হোক, এই থানার একেবারে কেন্দ্রীয়ভাগে একটি গ্রাম– গড়কিল্লা, জে. এল. নং– ২২৮।
লোকশ্রুতি আছে, সুদূর রাজপুতানা থেকে জনৈক মুকুট নারায়ন রায় শ্রীক্ষেত্র পুরীধামে এসেছিলেন জগন্নাথ দর্শনে। দেবী বাসুলীর আরাধনা করতেন তিনি। প্রাচীন ‘নন্দ কাপাসিয়ার জাঙ্গাল’ ধরে ফিরবার সময়, দেবীর আদেশ পেয়ে, কেদারকুণ্ড পরগনায় থেকে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে নিজের একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাজধানী স্থাপন করেছিলেন যেখানে, সেটিই পরে ‘গড়কিল্লা’ নামে পরিচিত হয়েছিল। আজও তার উঁচু ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। পরে, কাশীজোড়ার রাজা জনৈক রাজনারায়ণ রায় কেদারকুণ্ড অধিকার করে নিয়েছিলেন।
যাইহোক, গড়কিল্লার অদূরেই নতুন একটি জনপদ গড়ে উঠেছিল, যেখানে বসত করানো হয়েছিল এইসব রাজাদের সেনাবাহিনীর লোকজনকে। সেটিই পরে ‘পাইকপাড়ি’ নামে গ্রাম (জে. এল. নং– ২৬১) হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
নদীবিধৌত ডেবরা থানা উর্বর কৃষিভূমির সুবাদে, পূর্বকাল থেকেই কৃষিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল। তার সাথে ছিল গ্রামীণ হস্তশিল্প। এই এলাকার দুটি শিল্প ছিল উল্লেখ করবার মত– রেশম উৎপাদন এবং কাঁসা-পিতলের সামগ্রী নির্মাণ। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, কাঁসা-পিতলের কাজে পাইকপাড়ি গ্রামের কয়েকটি পরিবার বেশ অর্থবান হয়ে উঠেছিল। একসময় কংসকারদের মধ্যে, বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন জনৈক জ্যোতীন্দ্রনাথ প্রামাণিক। ১৬৯২ শকাব্দ বা সন ১১৭৭ সালে (অর্থাৎ ইং ১৭৭০ সালে) তিনি দেবী সিংহবাহিনী-র জন্য একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
৫০ বছর পরে, বাংলা ১২২৮ সনে, সিংহবাহিনী মন্দিরের সামনেই ‘জোড়-বাংলা’ শৈলীতে একটি কালী মন্দির গড়েছিল প্রামাণিক পরিবার। পরে পরে গড়া হয়েছিল দুটি শিবমন্দিরও।
বর্তমান আলোচ্য মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে বাংলা ১৩১৪ সনে। সেসময় মেদিনীপুর জেলা সহ সমগ্র দক্ষিণ বাংলা চৈতন্যদেবের গৌড়ীয় প্রেমধর্মে সম্পূর্ণ প্লাবিত। এবার আর পূর্বের মত, শৈব কিংবা শাক্ত ধারায় দেবার্চনা নয়। সম্পূর্ণ বৈষ্ণবীয় রীতিতে দেবার্চনার জন্য, বিষ্ণু মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হল। লক্ষ্মীজনার্দন নামিত একটি শালগ্রাম শিলা প্রতিষ্ঠা করা হল উপাস্য হিসাবে। সমীক্ষায় জানা যায়, মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রামাণিক বংশের জনৈক ত্রৈলোক্যনাথ প্রামানিক।
ত্রৈলোক্যনাথ মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন দালান-রীতিতে। ইটের তৈরী পূর্বমুখী মন্দির। পাদপীঠ বা ভিত্তিবেদী অংশটি এখনও বেশ উঁচু, ছ’ধাপ সিঁড়ি যুক্ত। চার দিকের বেদীই খিলান-রীতিতে খোপ কেটে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করা।
মন্দিরের কারিগরীটি একটু বিশিষ্ট রীতির। গর্ভগৃহের সামনে টানা একটি অলিন্দ অনেক মন্দিরেই দেখা যায়। কিন্তু এই মন্দিরে সামনের অলিন্দ তিনটি ভাগে বিভক্ত। তিনটি ভাগে প্রবেশের জন্য তিনটি দ্বারপথ। সবগুলিই খিলান-রীতির। মাঝখানের দ্বারটি দু’পাশের দুটির তুলনায় বেশি প্রশস্ত।
এই দুটি দ্বারপথে নির্মাণের বৈশিষ্ট দেখা যায়। দ্বারপথ দুটিকে, দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে– মাঝখানে একটি করে স্তম্ভ রচনা কর। ফলে, মাথার বড় খিলানের নিচে সৃষ্টি হয়েছে আরও দুটি খিলান। একান্তই একটি বিশিষ্ট রীতি এটি। সমগ্র মেদিনীপুর জেলায় এমন রীতি আর দেখা যায়নি।
গর্ভগৃহের দ্বারপথ একটিই। ভিতরে একটি দারু সিংহাসনে বিগ্রহের অবস্থান। গর্ভগৃহ এবং অলিন্দের ভিতরের ছাদ বা সিলিং নির্মিত হয়েছে খিলান-রীতিতে। তবে, মন্দির দালান-রীতির। সেকারণে, উপরের ছাদ সমতল। মন্দিরের দক্ষিণ দিকের অংশটি প্রায় বিধ্বস্ত।
সাধারণভাবে দালান মন্দিরে একটিই শীর্ষক বা চুড়া দেখা যায়। কেন্দ্রীয় দ্বদ্বারপথের মাথা বরাবর সেটি নির্মিত হয়। কিন্তু এই মন্দিরের অপর একটি বৈশিষ্ট হল, তিনটি দ্বারপথের মাথা বরাবর, তিনটি চূড়া নির্মাণ করা হয়েছে।
ভিত্তি থেকে একেবারে শীর্ষক বা চূড়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ সৌধটি বেশ অলঙ্কৃত করে গড়া হয়েছিল। সবই পঙ্খের কাজ। অলঙ্করণের প্রকরণটিও সচরাচর দেখা যায় না, বেশ অভিনব। কয়েকটি ছবি দেওয়া হল। পাঠক-পাঠিকা নিজেরাই প্রত্যক্ষ করতে পারবেন।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী সুজিত প্রামাণিক, রতন প্রামাণিক, রঞ্জিত প্রামাণিক, রাজীব প্রামাণিক, নেপাল ডাব– পাইকপাড়ি।
পথ-নির্দেশ : যে কোনও দিক থেকে ৬ নং জাতীয় সড়ক মুম্বাই রোড-এর ডেবরা কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথের বালিক স্টেশন থেকে, উত্তরমুখে মাড়োতলা বাজার। এবার পূর্বমুখে সামান্য কিছু দূরে পাইকপাড়ি গ্রাম।