নিজস্ব সংবাদদাতা: ১৮৯৭ সালে দাঁতনের মুন্সেফ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন কলকাতার খ্যাত নামা সাহিত্য বিশারদ বাবু কৃষ্ণধন মুখোপাধ্যায়। ইংরেজ সরকারের এই স্থানীয় আদালতটির প্রধান বিচারপতির পদ অলঙ্কৃত করার পাশাপাশি এই দাঁতন থেকেই তিনি সম্পাদনা করতেন তাঁর আধ্যাত্মিক বিষয়ক পত্রিকা ‘পন্থা’রও। বঙ্গীয় নবজাগরণের শেষ উত্তরাধিকার কালে যে সমস্ত মনীষা বাংলা সাহিত্যকে প্রোজ্জ্বল করেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন তাঁদেরই একজন। তাঁর সাহিত্য প্রীতি এতটাই প্রগাঢ় ছিল যে দাঁতনের মত একটি ক্ষীন যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পন্ন গঞ্জে বসেও ‘পন্থা’য় তিনি অবিচল ছিলেন। সম্প্রতি তাঁর একটি নাম ফলক আবিষ্কৃত হয়েছে দাঁতনে যাকে ঘিরে প্রবল উৎসাহ দেখা দিয়েছে দাঁতন বিষয়ক স্থানিক ইতিহাস চর্চাকার মধ্যে।
সেই বিষয় নিয়েই সম্প্রতি একটি আলোচনা সভা আয়োজন করেছিলেন দাঁতনের ‘দণ্ডভুক্তি একাডেমী’র সদস্যরা। আলোচনার মুখবন্ধে শিক্ষক তথা আঞ্চলিক ইতিহাসের গবেষক ও ‘দণ্ডভুক্তি’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক সন্তু জানা জানালেন, ‘ ঘটনা১২৩ বছর আগে যখন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তনী তথা দার্শনিক কৃষ্ণধন সম্পাদনা করেছিলেন ‘ পন্থা ‘ নামক একটি আধ্যাত্মিক পত্রিকার প্রথম প্রকাশ করছেন এবং তার চূড়ান্ত রূপটি তৈরি হয়েছে এই দাঁতনের মাটিতেই। তখন তিনি পেশাগত কারণে দাঁতনের মুন্সেফ। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই চলেছে পত্রিকা সম্পাদনার কাজও। ১৮৯৮ সালে ব্রিটিশ সরকার পত্রিকা প্রকাশের অনুমোদনও দিয়েছিলেন। এখনকার বিচারে একে আর. এন. আই বলা যেতে পারে। ”
কৃষ্ণধন কি জাতের সাহিত্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তা বোঝাতে গিয়ে সন্তু জানিয়েছেন, ‘১৯০৮ সালে বঙ্কিমচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় ‘ বঙ্গদর্শন ‘ পত্রিকার পাতায় ‘পন্থা’-র দশম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় । এমনকি, অক্ষয় কুমার সরকার সম্পাদিত সেকালের বিখ্যাত ‘ নবজীবন ‘ পত্রিকার লেখক সূচিতে রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের আগে কৃষ্ণধনের নাম ছাপা হয়েছিল।”
জানা যায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সম্মানিয় সদস্য বাবু কৃষ্ণধন ১৯০৪ সাল অবধি দাঁতনে ছিলেন এবং তাঁরই উদ্যোগে দাঁতনের প্রাচীন কলিচন্ডি মন্দিরের পশ্চিমমুখী ফটকটি নির্মাণ হয়। এই কাজে তাঁকে যোগ্য সহায়তা করেন রাজা রামচন্দ্র রায় বীরবর। এই ফটকেরই ভগ্ন প্রস্তর ফলকে লেখা থাকতে দেখা গিয়েছে ” শ্রীযুত কৃষ্ণধন মুখো ” ।
সম্প্রতি দাঁতনের ‘দণ্ডভুক্তি’ পত্রিকার তৃতীয় বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে দাঁতন বিষয়ক আলোচনায় উঠে এসেছে এমনই এক অজানা তথ্য যা উৎসাহিত করেছে দাঁতন প্রেমিকদের। এদিন সন্তু জানার এই বিশেষ গবেষণাপত্র সম্বলিত ‘দণ্ডভূক্তি’র বিশেষ সংখ্যাটির মোড়ক উন্মোচন করেন দাঁতন থানার ভারপ্রাপ্ত পরিদর্শক সুব্রত মজুমদার । মজুমদার বলেছেন, ” এখন কোন কিছু জানতে গেলে লোক গুগল খুলে বসে , কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে সন্তু বাবুর গবেষণায় জনসমক্ষে আসা কৃষ্ণধন বাবুর কথা আজ অবধি গুগলও জানে না ।”
প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ ইতিহাসের বহু পরম্পরার স্বাক্ষী এই দাঁতন, এমনটাই দাবি ইতিহাসকারদের। স্বর্ণালোকিত বৌদ্ধযুগ এখন তো মোগলমারি (মোগল-মাড়-ই)র হাত ধরে দাঁতন কে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ মানচিত্রে স্থান করে দিয়েছে। এরই মধ্যে উঠে আসল বঙ্গীয় নবজাগরণের কৃতি সন্তানদের সঙ্গে দাঁতন যোগের ইতিহাসও। দাঁতনের গৌরব মুকুটে এও এক অনন্য সংযোজন। দাঁতনের এই নিবিড় চর্চাকার সন্তু জানিয়েছেন, ” ব্রিটিশ যুগের দাঁতনের আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে কোনো গবেষণাই হয়নি এতকাল ।দীর্ঘ পরিশ্রম ও গবেষণার ফসল হিসেবে গত ৩০০ বছরের দাঁতনের এই অনুচ্চারিত ইতিহাস খুব শীঘ্রই গ্রন্থাকারে আসতে চলেছে জেলাবাসীর কাছে।”